ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মদিন আজ

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ২ মে ২০২৪

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মদিন আজ

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৬তম জন্মদিন ও ৯৫তম জন্মবার্ষিকী আজ শুক্রবার। ১৯২৯ সালের ৩ মে তিনি অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পুত্র রুমী ও স্বামী শরীফ ইমামকে হারান। মুক্তিযোদ্ধার গবির্ত মা,  বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও  সংগঠক এই মহীয়সী নারীর নেতৃত্বেই গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে করা সেই আন্দোলন পেয়েছে চূড়ান্ত পরিণতি। চলছে মানবতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ। ইতোমধ্যে এই ঘৃণ্য অপরাধীদের অনেকেরই ফাঁসির দ- কার্যকর হয়েছে। সংগঠকের পরিচয়ের বাইরে সাহিত্যিক হিসেবেও জাহানারা ইমামের অবদান অসামান্য। তার লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ শুধু দিনলিপি বা স্মৃতিচারণ নয়, এই রচনা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের জীবন্ত ইতিহাস। দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান রোধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
জাহানারা ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে আজ বিকেলে ‘জাহানারা ইমামের আন্দোলনে তরুণদের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মহাখালীতে নির্মূল কমিটির মিলনায়তনে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সাধারণ সম্পাদক ড. তপন পালিতের সভাপতিত্বে এবং অনলাইন বহুভাষিক সাময়িকী ‘জাগরণ’-এর সহকারী সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী সুশীল মালাকারের সঞ্চলনায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও  লেখক মারুফ রসূল।
বক্তব্য প্রদান করবেন নির্মূল কমিটির আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর, কমিটির আইন সহায়ক কমিটির সদস্য ড. খন্দকার তানজির মান্নান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ইসমাত জাহান, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শামস রাশীদ জয়, গবেষক শরীফ নূরজাহান, সাংবাদিক আবু সালেহ রনি ও ছাত্রনেতা আশেক মাহমুদ সোহান। এর আগে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে সকাল ৮টায় মিরপুরে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে।
একাত্তরে একই সঙ্গে স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। জাহানারা ইমামের পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তার ১৯ বছর বয়সী বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ ত্যাগ করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রিয়জনকে হারানোর সেই বেদনা তার ভেতর জ্বেলে দিয়েছিল দ্রোহের আগুন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তার নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের মাধ্যমে একাত্তরের শীর্ষ নরঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী ফাঁসির দেওয়া হয়।

এরপর আমৃত্যু এই সংগ্রামী নারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদিত করেন। যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারে আওতায় আনার জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত উলেল্লখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ সময়ের ডায়েরি  ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তার এক অনন্য সৃষ্টি।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশের জনগণ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। জামায়াতের এই ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ৭০টি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ২১ জানুয়ারি গড়ে ওঠে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। পরবর্তীতে আরও বিস্তৃত কলেবরে ১১  ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।

সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযম এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে জনগণের আকাক্সক্ষায় ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে ঐতিহাসিক গণআদালত। শহীদ জননীর সভাপতিত্বে লাখ লাখ বিচার প্রার্থীর উপস্থিতিতে ঘাতকদের হোতা গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গোলাম আযমের মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তার কেটেছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে। এ সময় তার মনের মধ্যে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের পরিণতি পেতে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এসব বৃত্তান্ত তিনি দিনলিপি আকারে নানা চিরকুটে, ছিন্ন পাতায় ও গোপন সংকেতে লিখে রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের এ দিনলিপি ১৯৮৬ সালে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ শিরোনামে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। বাাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মর্মস্পর্শী এ বৃত্তান্ত জনমনে ব্যাপক সাড়া জাগায়।

স্বাধীনতার পর জাহানারা ইমাম লেখালেখি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় কাটান। মুক্তিযুদ্ধে ছেলে রুমীর আত্মত্যাগ এবং নিজের অবদানের কারণে সবার কাছে আখ্যায়িত হন শহীদ জননী হিসেবে। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েট শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
একজন সুসাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন জাহানারা ইমাম। তার লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি‘ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল। তার লেখা অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ  অন্য জীবন, বীরশ্রেষ্ঠ, জীবন মৃত্যু, চিরায়ত সাহিত্য, বুকের ভিতরে আগুন, নাটকের অবসান, দুই  মেরু, নিঃসঙ্গ পাইন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস ও প্রবাসের দিনলিপি।

×