ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মার্চের ঘটনাবহুল দিন

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৩১ মার্চ ২০১৮

মার্চের ঘটনাবহুল দিন

(গত বুধবারের পর) ১৪ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ৪ দফা পূর্বশর্ত মেনে নেয়ার দাবিতে রাজধানীতে সর্বস্তরের জনগণের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জীবন-যাপনের জন্যই আমাদের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু রাতে এক বিবৃতিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশন অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান। পিপিপির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার সঙ্গে সংলাপ শুরু“করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান। ১১৫নং সামরিক নির্দেশের প্রতিবাদে দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা নগরীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বর্তমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ‘সোয়াত’-এর সমরাস্ত্র খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে। ১৫ মার্চ ১৯৭১ অহিংস আন্দোলনের চতুর্থ দিনে সারা বাংলায় অফিস আদালতে পূর্ণ কর্মবিরতি চলে। সরকারী ও বেসরকারী ভবনের শীর্ষে এবং যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কড়া নিরাপত্তার মধ্যে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। কিন্তু একটি প্রেস কনফারেন্সে ভুট্টো ঘোষণা দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করবেন না। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য প্রেসিডেন্টে প্রতি আহ্বান জানান। খুলনার হাদিস পার্কের জনসভায় বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বলেন, বাংলার প্রতিটি মানুষ আজ বঙ্গবন্ধুর পেছনে একতাবদ্ধ। তিনি বলেন রেডিও, টিভি, ইপিআর, পুলিশবাহিনী, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি আজ আওয়ামী লীগ প্রধানের আজ্ঞাবাহী। ১৬ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু সকালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান। দুই নেতার আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এলে সেখানে অপেক্ষমাণ দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আরও আলোচনা হবে। কাল সকালে আমরা আবার বসছি। ১৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ধানম-িস্থ ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানায়। বঙ্গবন্ধু সকাল ১০টায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক শুরু হয়। এদিন বৈঠক প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী চলে। প্রথম দিনের মতোই আলোচনা শেষে অপেক্ষমাণ দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তবে আলোচনার পরবর্তী সময়ও ঠিক হয়নি। আলোচনা চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনও চলবে। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পূর্ববাংলা এখন স্বাধীন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালী এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকা আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম কর্মসূচী ঘোষণা করে। ১৮ মার্চ ১৯৭১ অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবসে মুজিব-ইয়াহিয়া পরবর্তী বৈঠকের কোন সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সৌজন্য সাক্ষাতকারে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ওয়ালী ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান এক ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন। রাতে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়, আগামীকাল সকাল এগারোটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় বিমানবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ
×