ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নবরূপে মহাস্থানগড়

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৩১ মার্চ ২০১৮

নবরূপে মহাস্থানগড়

চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা আর বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর এবং মনসা সাপের কীর্তি নিয়ে সমৃদ্ধ যে পৌরাণিক কাহিনী, তারই ভিত্তি ভূমি মহাস্থানগড়। দেশের উত্তরাঞ্চলের মধ্যনগরী পু-্র বর্ধনভুক্তির রাজধানীখ্যাত মহাস্থানগড় বা পুন্ড্রনগরী আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন। এখানে তাম্র দ্বারের সন্ধান পেয়েছেন প্রতœতাত্ত্বিকরা। প্রাথমিকভাবে এখানে প্রাচীন প্রবেশদ্বার থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসেবে এই অঞ্চল খ্যাত। করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকালে এ নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তারই উজ্জ্বল নিদর্শন এই পুন্ড্রনগরী। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে রাজধানী। কিন্তু রয়ে গেছে তার অনেক নিদর্শন। মাঠ খুঁড়ে খুঁড়ে চাপা পড়ে যাওয়া সেই সব নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে বহু শ্রমে, ব্যয়ে। এখনও খনন কাজ চলে। আবিষ্কার হয় নিত্যনতুন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। যথাযথ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা একালে চলছে। কিন্তু এককালে এসব নিদর্শন বিনষ্ট হয়েছে মানুষেরই হাতে। তাদের অজ্ঞতারই কারণে। দু’বেলা দু’মুঠো প্রায় খেতে না পাওয়া একদা বাঙালীর কাছে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কোন মূল্য থাকার কথা নয়। তাই অনেক নিদর্শনই ধরে রাখা যায়নি। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এটিকে। এ ছাড়া বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান পাওয়া মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে চলছে ঢেলে সাজানোর কাজ। উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে অঞ্চলটি। ইউনেস্কোর সহায়তায় দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় মহাস্থানগড় এলাকায় পর্যটকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সংস্কার কাজ চালানো হচ্ছে। প্রাচীন আমলের যেসব ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, সে সব সংগ্রহ করে তা দিয়েই উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ করা হয়েছে মহাস্থানের পূর্ব দুর্গ প্রাচীরে। প্রাচীনত্ব বজায় রাখার জন্যই সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে এসব ইট ব্যবহার করা হয়। ঐতিহাসিক এই স্থাপনার ভগ্নদশাকে দৃশ্যমান করতে কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও ইটের গাঁথুনি কিছুটা এবড়ো-খেবড়ো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুযোগ, স্থানীয় জনগণকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি এবং বিভিন্ন কুটির ও হস্তশিল্পের বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ট্যুরিস্ট গাইডদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। গড়ের ভেতরাংশে যাতে পানি জমতে না পারে, সে জন্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পূর্ব দিকে নির্মাণাধীন ইট বিছানো পথ দিয়ে পর্যটকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করাসহ একটি কাঠের ওভারব্রিজও তৈরি করা হয়েছে। এখান দিয়ে পর্যঠক ও দর্শনার্থীরা দুর্গ প্রাচীরের ভেতর ঢুকে বৈরাগীর ভিটা ও পরশুরাম প্যানোস পরিদর্শন করে উত্তর পাশের দুর্গ প্রাচীরে যাওয়া যায়। এ ছাড়া কালিদহ সাগর থেকে করতোয়া নদী অভিমুখে বয়ে যাওয়া খালের মাঝামাঝি স্থানে একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মিত হচ্ছে। এ সেতু পার হয়ে সরাসরি জাদুঘর চত্বরে প্রবেশ করা যায়। সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ ছাড়াও এরই মধ্যে মহাস্থানে বেশকিছু স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। রেস্তরাঁ, স্যুভেনির কর্নার, পিকনিক স্পট, শৌচাগার, আবাসিক ভবন, জাদুঘরের প্রবেশ দ্বার, গাড়ি পার্কিং চত্বর, আনসার ক্যাম্প ও দর্শনার্থীদের বসার জন্য বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ থেকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি স্থানটির গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। মহাস্থানকে ঘিরে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে, ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা বেড়েছে। উন্নত মানের হোটেল না থাকায় খাবার ও আবাসিক সমস্যা হচ্ছে। সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ চালানোসহ পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে কিন্তু তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধার দ্বার অবারিত নয়। বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি দেশী পর্যটকদেরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো উচিত। শুধু সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। দর্শনার্থীদের দিকও বিবেচনা করা উচিত।
×