ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মঈনুল হাসান

গল্প ॥ এলিনের বাবা

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৩০ মার্চ ২০১৮

গল্প ॥ এলিনের বাবা

আমাদের পাড়ার শান্ত কাকা মানে এলিনের বাবা শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। এলিন আমার সমবয়সী বা বছরখানেকের বড় ছিল হয়ত। সেদিন সকালে গলির মুখের বড় আমগাছটার উপর সূর্যটা ঠিকমতো ওঠারও সময় পায়নি। কিন্তু, তারপরও কাকা চলে গেলেন। না..... কেউ আমাদের অত সকালে দরজায় কড়া নেড়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে খবরটা দেয়নি। প্রাত্যহিক গৃহকর্মের জন্য রাখা ফতের মা রোজ ঘরে ঢোকে সকালের নাস্তা খাওয়া হয়ে যাবার পর। পাড়ার খবরাখবর সে এনে দিলেও তাকে ছাড়াই কীভাবে যেন আমরা সব জেনে গেলাম। মায়ের মাথার কাছের পুবদিকের জানালাটা খুলতেই একটা মিহি ঠা-া বাতাস সেদিন ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ঘরময়। আমার শুধু মনে হয়েছিল বাতাসের আনাগোনার পথে ভীষণ একটা গরমিল হয়েছে কোথাওÑ কাকডাকা ভোরের কোথাও কিছু একটা ওলটপালট হয়েছে। ভোরের রোজকার প্রশান্তি স্তব্ধ হাওয়ার মতোই পরে মিলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। দিনটা বোধ হয় শনিবার ছুটির দিন ছিল। পেছনের বারান্দায় আয়েশ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে বাবা খবরের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। বাইরের চেঁচামেচি তখনও তার কান পর্যন্ত যায়নি। একসময় সে আওয়াজ আরও সরব হয়ে উঠলে আমি কান খাড়া করে সেদিকে দৌড়ে গিয়ে দরজার কপাট খুলে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। একটা চাপ চাপ ভিড়ের ধ্বনি হালকা থেকে জোরালো হচ্ছে ধীরে ধীরে। ‘এলিনের বাবার জয় হোক... জয় হোক, জয় হোক’... চেয়ে দেখি গলিমুখের প্রধান ফটক ডিঙিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে আসছে গোটা পঞ্চাশেক মানুষ, একসারি মিছিলের মতো অবাধ্য জনস্রোত। মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ‘লও লও লাল সালাম, কমরেড জিন্দাবাদ। এলিনের বাবা জিন্দাবাদ’। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম এ নতুন কিছু নয়। সময়টাই তখন উত্তাল, অস্থির। এমনি করে হয়ত আরও খ- খ- মিছিলের জন্ম হবে, মৌন পদযাত্রা হবে, মানববন্ধন হবে। সবাই বুঝে নেবে এলিনের বাবা তাদের পার্টিরই লোক। এলিনের বাবা সত্যিই কি কোন পার্টির লোক ছিলেন? আচ্ছা... এলিনের বাবাকে নিয়ে মিছিল হচ্ছে কেন? সবাই উনাকে এলিনের বাবাই বা বলছে কেন? শান্ত কাকার সুন্দর একটা নাম আছে বলে জানি। যদিও আমরা তাকে ‘শান্ত কাকা’ নামেই ডাকতাম। তাছাড়া আমার যতদূর মনে পড়ে কাকা প্রথমে ওসব কিছুর মধ্যেই ছিলেন না। যেদিন আমাদের গলির মুখের বুড়ো আমগাছের নিচে ঘটনাটা ঘটল, সবাই সবকিছুর সাক্ষী হয়ে রইল সেদিন থেকে কাকা যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। বছরখানেক আগের ঘটনা। এলিন তখন ঘাড় পর্যন্ত নামানো বাবরি চুল দুলিয়ে ঘুরে বেড়াত এখানে ওখানে। শুনেছি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে সে। পড়ালেখায় একেবারে মন নেই। দলবল নিয়ে শুধু ঘুরে বেড়ায়। ছাত্র রাজনীতির একেবারে পুরোধা মানুষ নাকি সে। ভেবে অবাক হই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তুখোড় ছাত্রনেতা ডানপিটে সে ছেলেটা একসময় ছিল আমার ইশকুল সহপাঠী। উচ্চ মাধ্যমিকের পর পড়ালেখায় কিছুটা হোঁচট খেতে হয়েছিল এলিনের। ব্যস, ঠিকমতো আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তারপরের ঘটনা ও তার পরম্পরা একদম চোখের সামনে ঘটেছিল। ছাত্রদের দুটি দলের প্রকাশ্য কোন্দল অথবা নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে পড়ে একদিন সন্ধ্যায় সেই আমগাছের নিচে কে বা কারা যেন ফেলে গিয়েছিল এলিনের গুলিবিদ্ধ লাশ। সকালে যখন তাকে ঘিরে পাড়ার লোকজন জটলা পাকিয়েছিল শান্ত কাকা তখন বাজারের দিকেই যাচ্ছিলেন। তিনি শুধু এলিনের মুখটা আলত করে স্পর্শ করেছিলেন। কোন আর্তনাদ নেই, বুকভরা রোদন নেই কেবল ছিল নিথর সে মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক থির দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা। শোকের আধিক্যে পাথরের মতো নিস্তব্ধতা বুঝি এমনই হয়। এদিকে পিঠে জমাট বাঁধা রক্তের নিচে গুলির তাজা চিহ্ন নিয়ে আমরা দেখলাম এলিন শুয়ে আছে রাজপথে। আজও মনে পড়ে কয়েকদিন ধরে বেশ থমথমে ছিল আমাদের পাড়াটা। গাছের নিচে চাপ চাপ রক্তের কালসিটে লাল দাগ তাজা ক্ষতের মতো সবকিছু মনে করিয়ে দিচ্ছিল বার বার। কোন একটি দল মিছিল নিয়ে এসে সেখানে এক টুকরো পাথরখ- রেখে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে যায়। তারপর... বেশ কয়েকটি পাল্টাপাল্টি মিছিল। পিঁপড়ার মতো সারিবদ্ধ মিছিলের কেবল আগমন ও প্রস্থান। তারপর খ- খ- সমাবেশ থেকে নিহতের প্রতি সমবেদনা, শেষে আরও কঠোর কর্মসূচীর ঘোষণা। চারপাশে পুলিশের কঠিন ব্যারিকেডের মাঝে কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক মিছিলও হলো। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতাসহ যেখানে-যেখানে জায়গা হলো সম্ভাব্য সকল স্থানে সেসব খবরের আদ্যোপান্ত ছাপা হয়েছিল ফলাও করে। সময়ের প্রয়োজন বুঝতে আমাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি। কিন্তু, এতকিছুর মধ্যেও এলিনের বাবা ছিলেন প্রাণহীন কাঠের পুতুলের মতো নির্বাক। এলিনের বাবাকে আগে কেউ চিনত না। কিন্তু, তার চলে যাবার পর শান্ত কাকা রাতারাতি পরিচিত হয়ে উঠলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন বেশ তুঙ্গে। টেলিভিশনের পর্দা কিংবা পত্রিকার পাতাজুড়ে কেবল একটাই সংবাদ, ‘স্বৈরাচারের পতন আসন্ন’। শান্ত কাকা কোন একটা দলের কর্মী হয়ে যেন কাজ করছিলেন আগে থেকে। কিন্তু, ততদিনে অন্তরাল ছেড়ে একদম সক্রিয় সদস্য হয়ে রীতিমতো পার্টি অফিসে যাতায়াত শুরু করে দিলেন তিনি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার পিতৃপ্রদত্ত নামটা ঘুচে গিয়ে সবার মাঝে শুধু এলিনের বাবা হয়েই নীরবে রয়ে গেলেন শেষে। ২. এলিনের দ্বিতীয় মৃত্যু দিবসে সেই আমগাছের নিচে অস্থায়ী পাথরের বেদিতে ফুল দিয়ে সবাই এলিনকে স্মরণ করল। তার আত্মোৎসর্গ সম্পর্কে জ্বালাময়ী কথামালা চলমান আন্দোলনের মাঝে অগ্নি মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছিল আরেকবার। তাকে নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ স্মরণসভা চলছিল প্রশস্ত রাজপথজুড়ে। মাইকে এলিনের নামটা শুনে আমি কান খাড়া করে রাখি। এক পা দু’ পা করে এগিয়ে যাই অনুষ্ঠানস্থলের দিকে। ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া এলিন অরণ্যের বাবা আপনাদের সামনে এবার কিছু বলবেন।’ আমি সভামঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে শান্ত কাকার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকিÑ যেন সেদিনই প্রথম দেখছি। আসলেই অনেকদিন পর দেখছি। পার্টি অফিসে দিনরাত পড়ে থাকা কাকার ঢ্যাঙা রোগা দেহ আরও ঝুঁকে পড়েছে সামনে। গায়ের রং ফ্যাকাশে সাদা। বয়স পঞ্চাশের বেশি না হলেও দেখাচ্ছে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের মতো। ইতস্তত লম্বা পা ফেলে কাঁপতে কাঁপতে মঞ্চে গিয়ে উঠলেন। কথা বলছিলেন থেমে থেমেÑ যেন অনেকদিন বিশ্রাম নেয়া হয়নি তার। অমনি ভিড়ের মধ্য থেকে একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে, ‘দেখ, দেখ, ওটাই এলিনের বাবা। মানুষটাকে ভাল করে দেখ। কী শান্ত, ভীষণ অদ্ভুত মানুষটা’। আমি শান্ত কাকা নয়, এলিনের বাবার কথা শোনার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু, তিনি তেমন কিছুই বললেন না। বার কয়েক পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। হাতের আঙুলগুলো কাঁপছিল একেবারে সীমা অতিক্রম করে। ধরা গলায় শেষে বললেন, ‘এলিনের আত্মত্যাগকে তোমরা মনে রেখ।’ কথা তেমন বেশি নয়। কিন্তু, অল্প এ কয়েকটি কথাই উপস্থিত জনসমুদ্রকে জাগিয়ে তুলল তুমুলভাবে। আমি তখন ভাবছি কয়েকটি পঙ্ক্তির কী আশ্চর্য তেজশক্তি। এ আহ্বানই এলিনের বাবাকে নতুন করে চিনিয়ে দিল আরেকবার। এলিনদের বাসাটা আমাদের বাড়ি থেকে ঠিক দেখা যেত না। আমাদের বাসার সামনে দাঁড়ানো সাদা একটা তিনতলা বাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়েছিল ওদিকটা। বাড়িটাকে আমার সাদা পালতোলা জাহাজের মতো মনে হতো। তো, সে বাড়িটার পেছনে বরই গাছ ছাওয়া যে টিনশেড ঘরটা ছিল ওখানেই থাকতেন শান্ত কাকারা। ঘরটার সামনে যে এক চিলতে বারান্দা মুখের আদলে নাকের মতো খাপছাড়া বেরিয়ে এসেছিল সেখানেই থাকত আমার বন্ধু এলিন। ঘর থেকে বেরিয়ে মাটির উঠান মাড়াতেই চোখে পড়ল খ- খ- মিছিলের আকারে সারিবদ্ধ জনস্রোত গলি পেরিয়ে ঢুকছে জীর্ণ ওই টিনশেডের দিকে। মিছিল থেকে আসছে টুকরো টুকরো স্লোগান। ‘লও লও লও সালাম... এলিনের বাবা লও সালাম’। ‘শহীদ এলিনের বাবা তোমায় ভুলছি না...ভুলব না।’ নিমিষেই বুঝলাম এরা আগের দলটি নয়, তবে সে দলটিকে টেক্কা দেয়ার চেষ্টায় গগনবিদারি আওয়াজে ভরিয়ে তুলছে সরু গলিপথ, সঙ্কীর্ণ উঠান। অবাক হয়ে শুনছি আর ভাবছি এরপর কী হবে? ঠিক তখনই কিছুটা শান্ত পদব্রজে ঢুকে পড়ল ছোট্ট আরেকটি দল। এরা অবশ্য সবার চেয়ে আলাদা। কালো ব্যানারের গায়ে মলিন সাদা পাঞ্জাবির এলিনের বাবা হাসার চেষ্টা করছেন আড়ষ্ট হয়ে। প্রত্যেকের হাতে ধরা ছোট ছোট প্লাকার্ডে ক্লান্ত চেহারার এলিনের বাবা হাসছেন। ভ্যাবাচেকা খাওয়া আমার কানে ততক্ষণে এলিনের বাবা মানে আমাদের শান্ত কাকার রাজনৈতিক কর্মকা-ের গুণ-কীর্তন ও ক্লান্তিহীন শেষ দিনগুলো ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছিল বার বার। হতবুদ্ধিতার ধাক্কা সামলে নিয়ে ভাবছি এতসব কখন কিভাবে হলো? সময়ই বা পেল কোথায়? বাসার সামনে থেকে গলিমুখ, গলিমুখ থেকে রাজপথ পর্যন্ত সেসব স্লোগানের পৌনঃপুনিক প্রতিধ্বনি শুনছি শুধু। মিছিলের শব্দ শুনতে শুনতেই কোন একদিন সন্ধ্যার কথা মনে পড়ল আমার। শান্ত কাকা তখন পুরোপুরি রাজনীতির মানুষ হয়ে গেছেনÑ যেন শহীদ এলিনের অসমাপ্ত কাজটুকু শেষ করার ব্রত নিয়েছেন তিনি। এক সময় অন্ধকার রাতে মাতাল হয়ে ঢুলতে ঢুলতে ঘরে ফেরার যে গল্প শুনতাম আমরা এলিনের কাছ থেকে সেই শান্ত কাকা তখন আমূল বদলে গেছেন। সংক্ষুব্ধ ডামাডোল তার শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল কিনা জানি না তিনি এসে একদিন কড়া নাড়লেন আমাদের দরজায়। বাবা তখন বাড়িতেই ছিলেন। পুরোদস্তুর রাজনীতির মানুষ হয়ে যাওয়ায় খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হতো না আমাদের সঙ্গে। বললাম, ‘কাকা ভেতরে এসে বসুন। বাবাকে ডেকে দেব’? উদভ্রান্তের মতো আমার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘এলিন কোথায় রে? ওকে যে এখন খুব দরকার আমাদের’। তারপর এলোমেলো পা ফেলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন অপেক্ষাহীন ব্যস্ত মানুষটা। কী আশ্চর্য মানুষ, এলিন যে নেই এটা একদম মনেই পড়ছে না তার। আমাকে অতিক্রম করে অনেকগুলো মিছিল বা মিছিলের ভাঙা অংশ একে একে জড়ো হতে লাগল এলিনদের ভাঙাচোরা বিবর্ণ উঠানে। এলিনের চলে যাবার দিন ঠিক এমনি করে বুকভরা শূন্যতা নিয়ে খ-িত মিছিলের মধ্যে শেষবারের মতো হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। শোকে স্তব্ধ একটি মৌন মিছিলের অংশ হতে পেরে সেদিন আমি ধন্য হয়েছিলাম। কিন্তু, এখন? এতক্ষণ খেয়াল করিনি। মৃদু পায়ে এই যে মৌন মিছিলটা ফুলের ডালি নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের সকলের চোখে কেমন যেন প্রচ্ছন্ন উপহাস দেখতে পাচ্ছি আমি। শান্ত কাকা কি এদের সকলেরই প্রাণের মানুষ ছিলেন? না, আর দাঁড়িয়ে থাকা নয়। মঞ্চায়িত এ শোকের মহড়া আমাকে কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে আজ। ৩. সকালবেলা দরজা খুলে আমি একাই বেরিয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে। দ্বিধান্বিত মনে ভাবছিলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমাকে যেতেই হবে। ঠিক এমন সময়ে দেখি মা আমার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। উৎকণ্ঠা নিয়ে তার প্রশ্ন, ‘কীরে খোকা, কী হয়েছে আজ? সকাল থেকে এত মিছিল ঢুকছে কেন’? ‘এলিনের বাবা আর নেই মা’। ‘নেই মানে? কোথায় গিয়েছে’? ‘একেবারে না ফেরার দেশে’। ‘কখন? কীভাবে’? ‘এই তো, ভোরের কিছু আগে মনে হয়’। ‘আহা! এলিনের মা একদম একা হয়ে গেল। বছরখানেক আগে গেল ছেলেটা। আর রাজনীতি করতে গিয়ে নিজেও শেষে শেষ হয়ে গেলেন শান্ত ভাই। ভীষণ কষ্ট লাগছে রে’। ‘আমি তখন মনে মনে দীর্ঘশ্বাসের গভীর শব্দটা চাপা দিয়ে ভিড় ঠেলে রাজপথের দিকে এগিয়ে গেলাম। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিতে চাই। গলার কাছে কাঁটার মতো কী একটা যেন আটকে আছে। একটু সুনির্মল বাতাস নিতে চাই প্রাণভরে। জনস্রোতের মধ্যেও একটা বিষণœ একাকীত্ব গ্রাস করে রেখেছে আমাকে। হাঁটতে হাঁটতে তাই দীলিপের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। পড়ালেখা ছেড়ে পাড়ায় ছোট্ট ফুলের দোকান দিয়েছে দীলিপ। এতে তার সংসার ও সাদামাটা দিনগুলো দুটোই দিব্যি চলে যায়। আচ্ছা, অত সকালে দীলিপের দোকানটা খুুলেছে তো? ভিড়ের মধ্যে অনেকের হাতে ফুল দেখে আমারও খুব ফুল দিতে ইচ্ছে হলো। ‘একটা সুন্দর গোলাপের ডালি দে তো দীলিপ’। ‘ডালি যে সব শেষ স্বাধীন ভাই’। ‘কী বলছিস এসব? এ সময়ে তো তোর দোকানই খোলে না অন্যদিন’! ‘বাড়ি থেকে ডেকে এনে আজ দোকান খুলিয়েছে পার্টির লোকেরা। সবাই বলছে শান্ত কাকা নাকি তাদেরই লোক ছিলেন। তুমি জানো নাকি কিছু স্বাধীন ভাই? ভোর থেকেই সবাই দোকান খালি করে ফুলের মালা, ডালি সব তুলে নিয়ে গেছে।’ ‘তুলে রাখা ওই তোড়াটা দে’। ‘ওটা দেয়া যাবে না স্বাধীন ভাই। হারুন ভাই ওটা নেবেন। ফোন করেছিলেন। পার্টির লোকেরাও বলে গেছে।’ হারুন পাশা বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের নেকনজরে সামনে কাউন্সিলর নির্বাচনের ছক কষছেন। স্বৈরাচারের পতন অনিবার্য হলে তখন যে নতুন নির্বাচনের প্রয়োজন হবে সে হিসাব মাথায় রেখে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। এমন জোর গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি চারদিকে। হয়ত সত্যিই তাই। শান্ত কাকাকে আর ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হলো না। তাই সে আশা ত্যাগ করে চলে এলাম এলিনদের সামনের উঠানটায়। সেখানে আর তিলধারণের জায়গা নেই, সমস্ত জায়গা গিজগিজ করছে চেনা অচেনা লোকে। ঘরের সামনে খাটিয়ায় রাখা শান্ত কাকার নিথর শরীরটা পড়ে আছে। ঘড়িতে তখন সকাল দশটার মতো বাজে। আত্মীয়-পরিজন সব আসতে শুরু করেছে। ভিড় ঠেলে এলিনের বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখি শোকে কাঠের মূর্তির মতো হয়ে আছেন এলিনের মা। এলিন মারা যাবার পর খুব একটা যেতাম না ওদিকে। আমাকে দেখেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন আরেকবার। চোখে জল নেই, সব শুকিয়ে গেছে। অশ্রুহীন সে চাপা আর্তনাদ আরও ভারি করে দিচ্ছিল আমাকে। বাইরে ততক্ষণে এলিনের বাবার দাফনের ব্যবস্থা নিয়ে কয়েকটি জটলার মধ্যে একটা উতোরচাপান চলছে। আত্মীয় স্বজনকে ঘেঁষতে না দিয়ে সকলে দাবি করছে এলিনের বাবা তাদের লোক। এলিনও শহীদ হয়েছে তাদের পার্টির রাজনীতি করে। তাই সব দায়িত্ব তারা কাঁধে নিতে চায়। এদিকে এখনও হারুন পাশার পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়নি। দলবল নিয়ে আসবেন বলে কিছুটা দেরি হচ্ছে তার। তার আসবার খবর পেয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের লোকজন বাড়তি ভিড়ের যোগান দিচ্ছে এলিনদের উঠানে। হারুন পাশার দলের লোকজন লাশের খাটিয়া আটকে রেখে ছোটখাটো হাঙ্গামাও তৈরি করে ফেলেছে অন্যদের সঙ্গে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে। আমি তখনও এলিনের স্মৃতি-গন্ধ নিয়ে স্থানুবৎ বসে আছি তার বিষাদঘেরা ছোট্ট বারান্দায়। আর বসে থাকতে না পেরে ছুটে গেলাম বাইরে। পাড়ার কয়েকজন বন্ধুকে ডেকে হাত লাগালাম খাটিয়ায়। চিৎকার করে বললাম, ‘অনেকদিন পর শান্ত কাকা আজ কেমন শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছেন। দয়া করে মিছিল বন্ধ করে তাঁকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দিন আপনারা।’
×