ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যা ॥ হত্যাকা- থেকে উদ্দেশ্যের ব্যাপকতাই গুরুত্বপূর্ণ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২৭ মার্চ ২০১৮

গণহত্যা ॥ হত্যাকা- থেকে উদ্দেশ্যের ব্যাপকতাই গুরুত্বপূর্ণ -স্বদেশ রায়

‘তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস’- (রবীন্দ্রনাথ)। আর এটাই পৃথিবীর চরম সত্য। একদিকে একদল মানুষ বর্বরতা থেকে মুক্তি চাচ্ছে অন্যদিকে আরেক দল মানুষ বর্বরতাকে আঁকড়ে ধরছে। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নয়, প্রাগ-ঐতিহাসিক আমল থেকেই মানুষের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে এই বর্বরতা। জীব বিবর্তনের এক পর্যায়ে মানুষ যখন মানুষের আকৃতি ও মানব জীবনে রূপ নিতে থাকে, তখনই দেখা যায় এই বর্বরতাÑ যাকে আমরা ধরে নিতে পারি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম গণহত্যা। মানুষের আকৃতি ও মানুষ হওয়ার জীবনাচার নিয়ে দুটি প্রজাতি প্রায় একই সমান্তরালে এগিয়ে এসেছিল। একটি নিঅ্যান্ডারথ্যাল অপরটি হোমো স্যাপিয়েন্স। হোমো স্যাপিয়েন্সরা প্রায় সব নিঅ্যান্ডারথ্যালকে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই প্রথম গণহত্যা। যেহেতু এই হত্যাকাণ্ড কেবলমাত্র কোন ক্রোধ থেকে, কোন সাধারণ শত্রুতা থেকে হয়নি। এই হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য ছিল একটি প্রজাতিকে ধ্বংস করে আরেকটি প্রজাতির এককত্ব সৃষ্টি করা। বাস্তবে কোন প্রজাতি, কোন বর্ণ বা কোন জাতি বা কোন ধর্মের লোককে হত্যার মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়ে, ওই স্থানের ওপর যখন এককত্ব বা ধ্বংসকারীর শ্রেষ্ঠত্ব বজায়ের চেষ্টা হয়- সেটা আর তখন কোন সাধারণ হত্যাকা- থাকে না, তখন তা গণহত্যা হিসেবেই চিহ্নিত হয়। তাই গণহত্যার উদ্দেশ্য ও ব্যাপকতা দুই ভাবে দেখা যায়- এক. হত্যাকা-ে কত লোক মারা গেছে অর্থাৎ হত্যার ব্যাপকতা কতটা, দুই. হত্যাকা-ের উদ্দেশ্যর ব্যাপকতা কত। কখনও কখনও একজন ব্যক্তিকে হত্যা চেষ্টা বা হত্যা করাকেও গণহত্যার উদ্দেশ্যর ভেতর পড়ে। কারণ ওই হত্যার ভেতর দিয়ে সভ্যতা বা চেতনাকে ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। যেমন, সাম্প্রতিকালের দুটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০১৩ সালে যখন বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রকৃত শাস্তি দেয়া ও দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা, ওই সময়ে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা তরুণ বুদ্ধিজীবী রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়। রাজীব হায়দার একজন ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য কোন একক হত্যা নয়, এটা মূলত গণজাগরণ মঞ্চকে স্তব্ধ করতে ভীতি ছড়ানোর জন্য হত্যাকা-। এ হত্যাকা-ও একটি গণহত্যা। যদিও এখানে হত্যা করা হয়েছে একজন ব্যক্তিকে, কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য একটি ব্যাপক গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীর চেতনাকে ধ্বংস করা। অর্থাৎ রাজীব হায়দারকে হত্যার মাধ্যমে ভয় প্রদর্শন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পশ্চাতে ঠেলে দিয়ে তার ওপর মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য ছিল ওই হত্যাকা-টি। তাই রাজীব হায়দার হত্যা একটি গণহত্যা। যদিও হত্যাকা-টির বিচার সাধারণ হত্যাকা- হিসেবেই হচ্ছে। কারণ, আমাদের ট্রাডিশনাল বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্র পরিচালকবৃন্দ স্বাভাবিক চোখে দেখেছেন এখানে একজন ব্যক্তি মারা গেছে- তারা হত্যার উদ্দেশ্যর ব্যাপকতা দেখেননি। ঠিক এমনিভাবে জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টাটিও একটি গণহত্যা চেষ্টা। কারণ, এক. এখানে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি হলেও তাকে যে কারণে আঘাত করা হচ্ছে, তার ব্যাপকতা অনেক বেশি। জাফর ইকবাল বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনা শিশু মনে প্রোথিত করেন। দুই. তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে চান সমাজে। তরুণ সমাজের ওপর তাঁর প্রভাব ব্যাপক। তাই একজন জাফর ইকবালকে হত্যা করতে পারলে পশ্চাদপদ চিন্তা অনেক বেশি জয়লাভ করে। এ কারণে এখানেও হত্যা চেষ্টার উদ্দেশ্য বিচার করলে এটা গণহত্যার আওতায় পড়ে। এমনিভাবে পৃথিবীর তাবত গণহত্যার চরিত্র যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যায়, গণহত্যা থেকে গণহত্যার উদ্দেশ্য অনেক ভয়াবহ। আজ আমরা যে শোকাবহ দিনে এখানে সমবেত হয়েছি, সেই ২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল ব্যাপক। ২৫ মার্চের রাতে নির্বিচারে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। তা ছাড়া ২৫ মার্চ আমরা গণহত্যা দিবস হিসেবে স্মরণ করলেও মূলত ২৫ মার্চ গোটা নয় মাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৭১ সালের ৯ মাস জুড়ে যে গণহত্যা হয়েছিল সেই সব হত্যাকা-কে স্মরণ করার জন্য, সেই হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য ও ব্যাপকতা থেকে আত্মোপলব্ধি করার জন্যই আমরা ২৫ মার্চে নানাভাবে সমবেত হই। এমনকি আমরা যে যেখানে আজ ৪৭ বছর পরে এই গণহত্যাকে স্মরণ করতে দাঁড়িয়েছি, আমরা দেখতে পাই প্রত্যেকে কোন না কোনভাবে এই ১৯৭১ এর গণহত্যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত। কেউবা তার স্বজন হারিয়েছেন, কেউবা নিজের অঙ্গ হারিয়েছেন, আবার কেউ কেউ এমনভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যে, ৪৭ বছরেও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। বাস্তবে আমাদের ১৯৭১ এর গণহত্যার ভেতর দিয়ে কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে গেছে, কত পরিবার যে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্তে নেমে গেছে, কত পরিবার সর্বস্বহারা হয়েছে, কত সম্পদ লুঠ হয়েছেÑ গণহত্যার এ উদ্দেশ্যগুলো নিয়ে আমাদের সমাজে কোন গবেষণা হয়নি। এই গবেষণা না হওয়ার কারণ মোটা দাগে দুটি। এক. রাষ্ট্র সৃষ্টির সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে প্রতিবিপ্লবীরা অর্থাৎ গণহত্যাকারীদের পক্ষ থেকে ক্ষমতা দখল। দুই. বুদ্ধিজীবী হত্যার ফলে ওই প্রজন্মের গবেষক না থাকা। পাশাপাশি আরও একটি চরম সত্য আজ এই দুঃখের দিনেও আমাদের স্বীকার করা উচিত, বরং বেশি করে স্বীকার করা উচিত- কারণ দুঃখের দিনে স্মরণ করলে সেটা মনে গেঁথে থাকে বেশি। এই সত্যটি হলো, যে ধরনের সুশৃঙ্খলতা ও শিক্ষা একটি জাতির ভেতর গবেষণার বোধ আনে, গবেষণার প্রয়োজনীয়তাটি জাগিয়ে তোলে- ওই শিক্ষা ও শৃঙ্খলা এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি। যা হোক, এখন প্রশ্ন, ১৯৭১-এ কেন আমরা গণহত্যার শিকার হলাম? যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা আমরা ১৯৭১-এর মার্চ মাস থেকে ১৯৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর অবধি গণহত্যার শিকার হলাম। এই পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্রষ্টাও আমরাÑ এবং ওই নয় মাসে যারা নিহত হয়েছিলেন সেই ৩০ লাখেরও বেশি লোক, তারাই। কারণ, আমরা বাঙালীরা ১৯৪৬ সালের ভারতের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট না দিলে পাকিস্তান হয়ত সৃষ্টি হতো, তবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ না হয়ে ভিন্নভাবে ভারতের বাইরে একটি বড় রাষ্ট্র হতে পারত। সে সম্ভাবনা ছিল। তার বদলে আমরা তৎকালীন পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়ে এই অংশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি বাস্তবতা সৃষ্টি করেছিলাম। এখানে এসেও আরেকটি গবেষণার প্রয়োজন, শুধু কি ধর্মের নামে, ধর্মের কারণে এই ভোট দেয়া হয়েছিল? খুব বেশি দিন নয়, আজ থেকে মাত্র ৭২ বছর আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। তাই এখনও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা অনেক সহজ। আমাদের অন্তত একটি বিষয় গবেষণার মাধ্যমে পরিষ্কার হওয়া দরকার, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা কি শুধু ধর্মের জোসে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, না কলকাতাকেন্দ্রিক একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনাও তাদের পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমরা খুব মোটা দাগে দেখতে পাই, সে সময়ের ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পূর্ব বাংলা এক ধরনের একটি কাঁচামাল উৎপাদনের স্থান ছিল। সে কাঁচামাল থেকে যে অর্থ আসত তার বড় অংশ ব্রিটিশ তার নিজ দেশে নিয়ে যেত। তার পরেও যা থাকত তার বড় অংশ ব্যয় হতো কলকাতাকে ঘিরে। পূর্ব বাংলায় ওইভাবে তার কোন অংশ ব্যয় হতো না। পূর্ব বাংলা সব সময়ের জন্য এই শস্যভাণ্ডার থাকলেও মুঘল আমলেও দেখা গেছে একই ঘটনা। এখান থেকে রাজস্ব নিয়ে হয় দিল্লীতে ব্যয় হচ্ছে, না হয় দাক্ষিণ্যাতের যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। পূর্ব বাংলায় ব্যয় হচ্ছে না। এ কারণে পূর্ব বাংলার কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের মনের গভীরে একটা ক্ষোভ দীর্ঘদিনে তাদের অজান্তেই সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে এই ক্ষোভটির সঙ্গে ধর্মীয় রং লাগিয়ে ফজলুল হক, সোহ্রাওয়ার্দী এমনকি শেখ মুজিবের মতো তরুণ কর্মীরাও বিষয়টি পাকিস্তানের পক্ষে কাজে লাগিয়েছিলেন। এই ক্ষোভ এবং ধর্ম মিলেই ১৯৪৬ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ মুসলিমরা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেন। বলা যেতে পারে, তাদের ভোটেই সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের স্রষ্টা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর আরেক লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী দু’জনই বড় নেতা। জিন্নাহ অনেক বড় নেতা। তবে জিন্নাহ অনেক বড় নেতা হলেও তাঁর সব থেকে বড় ঘাটতি ছিলো তিনি ওপরতলার নেতা। ভারতের সাধারণ মানুষকে তিনি চিনতেন না, তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তাঁর কোন পরিচয় ছিল না। যে কারণে পূর্ব বাংলার মানুষের পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়ার অন্তর্নিহিত একটি কারণ ছিল দীর্ঘ বঞ্চনার ক্ষোভ- সেটা তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের এই অবধি এসে আরও একটি গবেষণা দরকার, জিন্নাহ-লিয়াকত আলীরা এই ক্ষোভকে জানতে পারলেন না, কিন্তু পূর্ব বাংলাকে যে শোষণ করতে হবে, যা মুঘল বা ব্রিটিশ করে গেছে, এই বিষয়টি অত দ্রুত তারা বুঝলেন কিভাবে? কারণ, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার অব্যবহিত পরেই যখন বাঙালীর ভাষাকে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা জিন্নাহর মতো আধুনিক লোকের পক্ষ থেকে করা হলো, তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তান ব্রিটিশ আমল বা মুঘল আমলের মতো পূর্ব বাংলাকে শোষণ করতে চায়। এখানে এসেই ইতিহাসের আরেক বাঁক দেখা যায়। অর্থাৎ ১৯৪৮ এ যখন তরুণ শেখ মুজিবসহ বেশ কয়েক তরুণ পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে মাতৃভাষাকে বাঁচানোর জন্য রাজপথে নেমেছেন। তখন বোঝা যায়, এরা সবাই ১৯৪৬ এ পাকিস্তান কায়েমের ভোটের কর্মী থাকলেও- ভোটের কাজে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে শুধু ধর্ম দেখেননি, বঞ্চনাও দেখেছেন। যা হোক, এই তরুণরাই হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে সংঘটিত হন। সে ইতিহাস সবার জানা। সে প্রসঙ্গ এখানে আর বলার কোন প্রয়োজন নেই। তবে যে কথাটি বলতে হবে, তা হলো ১৯৬৬-এর ৬ দফা। অর্থাৎ বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য শেখ মুজিব এ সময়ে তাঁর দেশের মানুষকে সংগঠিত করেন। শেখ মুজিব তখনও বঙ্গবন্ধু হননি, তবে তিনি যেদিন একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সংগঠিত করা শুরু করলেন, সেদিনই নির্ধারিত হয়ে যায় পূর্ববাংলার মানুষকে আবারও একবার গণহত্যার শিকার হতে হবে। কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, যখনই কোন জনগোষ্ঠী কোন বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি চায়, তখন একটি গণহত্যা অনিবার্য হিসেবে এসে হাজির হয়। কারণ স্বার্থভোগীরা তাদের শেষ অবস্থানটুকু ধরে রাখার জন্য এ কাজ করে। এর উদাহরণ ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা সর্বত্র। সে সব উদাহরণ টেনে নিবন্ধের কলেবর বাড়াতে চাই না। শুধু পূর্ব বাংলার ১৯৪৬ ও ৪৭ এর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। পূর্ব বাংলায় ১৯৪৬ ও ৪৭ এ যে দাঙ্গা হয়, তা আজও আমরা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও ভারত ভাগের অঙ্গ হিসেবেই জানি। বাস্তবতা কি তাই? মূলত ভারতবাসীদের অগ্রসেনানী হিসেবে বাঙালীরা ব্রিটিশের হাত থেকে বঞ্চনার অবসান চেয়েছিল। আর সে কারণেই তাদের জীবন দিতে হয়। ব্রিটিশরা পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের থেকে বেশি চতুর ছিল। তাই গণহত্যাটি এমনভাবে করিয়েছিল যেন সেটা ধর্মীয় দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়, যাতে আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের গণহত্যার দায়ে বিচারের সম্মুখীন হতে না হয়। অন্যদিকে ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা এত বেশি ক্ষমতা পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাদের সুচতুর, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান ব্রিটিশরা চমৎকারভাবে অতি সুকৌশলে ব্যবহার করে। তারা দাঙ্গার নামে গণহত্যা করে অন্তত নিজেদের সেফ এক্সিটটা বের করে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে সেটাকে গণহত্যা বিবেচনা না করে দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করার সব ব্যবস্থা করে। ৪৬ ও ৪৭ এর গণহত্যার ক্ষতে ক্ষত-বিক্ষত একটি জাতি হলেও বাঙালী বুঝতে পারেনি তারা ব্রিটিশের একটি গণহত্যার শিকার। বরং ভাই ভাইকে হত্যা করেছে, ভাই বোনকে রেপ করেছে, এই ক্রোধ ও ক্ষোভ নিয়ে তারা নিজেদের আরও নিচের দিকে নিয়ে যায়। যা হোক, বঙ্গবন্ধু যখনই বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য জাতিকে এক করতে নামেন, তখনই নির্ধারিত হয়ে যায় তাঁর জাতিকে একটি গণহত্যার শিকার হতে হবে। তার প্রমাণ তো ৬ দফা দেয়ার পরেই আইয়ুব খানের উক্তি। তিনি বললেন, ছফ দফার উত্তর তিনি অস্ত্রের ভাষায় দেবেন। আইয়ুব সময় পাননি, ইয়াহিয়া বাস্তবায়িত করেন আইয়ুবের সেই উক্তি। ইয়াহিয়া বা ভুট্টো ব্রিটিশদের মতো অতটা ধূর্ত ও শিক্ষিত ছিল না বলে তারা শতভাগ গণহত্যার কাজটি বাঙালীকে দিয়ে বা পূর্ব বাংলার মানুষ দিয়ে করাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া নেতৃত্ব। বুদ্ধিজীবীরা না বুঝলেও, গবেষকরা না বুঝলেও মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, ১৯৪৬ ও ৪৭ সালে কী ঘটেছিল? তাই তিনি ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণে সবাইকে বুঝে- শুনে কাজ করতে বলেন। তিনি বলেন, নিজেদের ভেতর শক্র ঢুকবে। ভাইয়ে ভাইয়ে কোন্দল লাগানোর চেষ্টা হবে। আর এ কারণেই ২৫ মার্চের আগে কোন দাঙ্গা বাধিয়ে, তা সেটা বাঙালী ও বিহারী বা হিন্দু ও মুসলিম এমন যে কোন দাঙ্গার মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন দিকে নিতে পারেনি ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা। যে কারণে ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দিয়ে তাদের গণহত্যা চালাতে হয়। কারণ, বঙ্গবন্ধু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বাঙালীর সপক্ষে দাঁড়াতে। তবে ২৫ মার্চের পরে এক সপ্তাহ না যেতেই ইয়াহিয়া ও ভুট্টোরা বাঙালী কোলাবরেটর পেয়ে যায়। মুসলিম লীগ ও বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বাঙালী নিধনে নামে। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের ইতিহাসে অনেকেই বলেন, পাকিস্তানীদের হত্যাকা-ের ধরন ছিল প্রথমে আওয়ামী লীগ কর্মী, তারপরে হিন্দু ও তার পরে আওয়ামী লীগ সমর্থক নিম্নবিত্ত। মনে হয় বিষয়টি এভাবে দেখলে ১৯৭১-এ আমরা যে একটি খাঁটি বাঙালী জাতিগোষ্ঠী হয়ে উঠেছিলাম, ওই জাতিকে অপমান করা হয়। আসলে ওই গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক বাঙালী চেতনার জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করে কেবলমাত্র পশ্চাদপদ চিন্তার মানুষদের এই ভূখ-ে রাখা। যেমনটি এখনও ঘটছে। পশ্চাদপদ চিন্তার মানুষের হাতে নিহত হচ্ছে আধুনিক চিন্তার মানুষ। অর্থাৎ ওই পাকিস্তানী ধারা। যেহেতু ১৯৭৫ এ প্রতিবিপ্লবীরা এদেশের ক্ষমতা দখলই শুধু করেনি, রাজনীতিতেও বৈধ হিসেবে শক্তি অর্জন করেছে। এখন বলতে চাই, একাত্তরে কত মানুষ নিহত হয়েছিলেন ওই গণহত্যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন হিসাব থেকে স্বাধীনতার পর পরই বলা হয়েছিল ৩০ লাখ। অর্থাৎ তখনও অবধি ওই হিসাব ছিল। তবে বঙ্গবন্ধু যে জরিপ শুরু করেছিলেন তা শেষ করতে পারলে এই সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যেত। কারণ, শুধু বৃহত্তর ঢাকা জেলার প্রথম জরিপে দেখা গিয়েছিল ৮ লাখের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়। শরণার্থী শিবিরে শিশু ও বৃদ্ধ মারা গিয়েছিল ১৫ লাখের ওপরে। এর থেকে বোঝা যায় সারাদেশে মোট কত লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। আর যে কোন গণহত্যা বা যুদ্ধের আরেক ক্ষত নারীর শ্লীলতাহানি। এ মুহূর্তে যারা গবেষণা করছেন তাদের হিসেবে দেখা যাচ্ছে ৬ লাখের ওপরে মা-বোনের শ্লীলতাহানি করা হয়। তাছাড়া বিষয়টি আমাদের সমাজে এমনই স্পর্শকাতর যে, লাজ-লজ্জার আবরণের ভেতর থেকে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন। তাছাড়া, সে কাজটি আমরা করিওনি। সবশেষে একটি কথাই বলব, দেশ স্বাধীন করেও কিন্তু পাকিস্তানী কোলাবরেটরদের চলমান গণহত্যা আজও আমরা বন্ধ করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু থেকে শিশু রাসেলও গণহত্যার শিকার। সর্বশেষ, জাফর ইকবাল গণহত্যা চেষ্টার শিকার। অন্যদিকে আমরা এখন আর শতভাগ বাঙালী নেই। তাই প্রকৃত অর্থে গণহত্যা দিবস স্মরণ ও চলমান গণহত্যা ঠেকাতে হলে এ মুহূর্তে সবার আগে আমাদের শতভাগ বাঙালী হতে হবে। [২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাব আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত]
×