ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুরাও বৈষম্যের শিকার, বঞ্চিত চিকিৎসাসেবা থেকে

মরণব্যাধি এইডস আক্রান্তদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২২ মার্চ ২০১৮

মরণব্যাধি এইডস আক্রান্তদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ!

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ চার বছরের খর্বাকায় শরীরের টুম্পা। জন্মই যেন তার আজন্ম পাপ! এই শিশুটি পরিবারের আদরসহ প্রতিবেশীদের আদর থেকেও বঞ্চিত। কারণ সে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। তার থেকে দূরে থাকলেই যেন সকলের রক্ষা! আরেক শিশু তিন্নির বয়স ৬ বছর। বাবা-মার শরীরে বাসা বাঁধা মরণব্যাধি এইডসের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি ছোট্ট এই শিশুটিও। তারা বেড়ে উঠছে সামাজিক বৈষম্যের মধ্য দিয়ে। বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার সুযোগ তাদের নেই। অপরাধ! তারা এইচআইভি-এইডস আক্রান্ত শিশু। তাদের অসুখটা নাকি ছোঁয়াচে, এই ভ্রান্ত ধারণায় প্রতিবেশীরা ভীত। তাই তো ভয়-আতঙ্কে আক্রান্ত শিশু দুটির ধারেকাছেও যায় না প্রতিবেশীরা। সংক্রমণের অমূলক আশঙ্কায় সাহায্য-সহযোগিতার জন্য পাশেও দাঁড়াচ্ছেন না কেউ। এইডস রোগ বিশে^ মরণব্যাধি হিসেবে পরিচিত। সমগ্র বিশে^ই বলতে গেলে এইডস রোগীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়ে থাকে। কেবল রোগীরাই নন সমাজে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে এ রোগে আক্রান্ত পরিবারের শিশুরাও। বাংলাদেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএন এইডস বলছে, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষ ১২ হাজার। তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বা ১০ হাজার ৮০ জন এইডসের ওষুধ (এআরভি বা এ্যান্টি রেট্রোভাইরাল) পাচ্ছেন না। যে অল্পসংখ্যক মানুষ ওষুধ পাচ্ছেন, তারা নির্ণয় যন্ত্রের অভাবে রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতির মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারছেন না। জাতীয় এইডস কমিটি ও ন্যাশনাল এইডস-এসটিডি প্রোগ্রাম সূত্রে জানা যায়, দেশে ২০১২ সালে শূন্য-১৫ বছরের মধ্যে নতুন করে ২১ শিশু এবং ১৬-২৫ বছরের মধ্যে ৬৮ জন এইডস আক্রান্ত হয়েছে এবং বহু নেগেটিভ শিশু রয়েছে। ইউএন এইডসের গত জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৩৪ শতাংশ বা ৪ হাজার ৮০ জন। শনাক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা ১০ হাজার ৮০০ ছিল। অন্যদিকে শিশু উন্নয়ন সংক্রান্ত ‘আশার আলো সোসাইটি’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় ৭৪ জন আক্রান্ত ও ১৬০০ নেগেটিভ, ‘মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ’ ১৯ জন আক্রান্ত ও ৪৫০ জন নেগেটিভ এবং ‘ক্যাপ’ ২৪ জন আক্রান্ত ও ৩৫০ জন নেগেটিভ শিশুকে সেবা প্রদান করছে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তদের সদস্য কার্ড রয়েছে বলে সংস্থাগুলোর প্রধানরা জানিয়েছেন। সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী দেশে ১১৭ পজিটিভ ও ২ হাজার ৪০০ নেগেটিভ শিশুর অবস্থা খুবই করুণ ও অসহনীয়। মায়েরাও জানে না কিভাবে তাদের শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবারের জোগান বজায় রাখবেন। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ’ সংস্থায় চিকিৎসা নিতে আসা তৌহিদা জনকণ্ঠকে বলেন, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। কিন্তু আক্রান্ত শিশুটিকে আড়াল করতে পারেননি। পুষ্টিহীনতায় ভোগা তার শিশুটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় ‘ভয়াবহ’ কোন রোগ শিশুটির শরীরে বাসা বেঁধেছে। অন্যদিকে আক্রান্ত নাতির জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পঞ্চাষোর্ধ করিমন বেগমকে। এইডসে আক্রান্ত হয়ে ছেলে মারা গেছে। বৌমার খোঁজ নেই। দু’কূলে কেউ নেই। প্রতিবেশীরাও ভীতসন্ত্রস্ত্র। কারণ তার ১১ বছরের নাতি সাইফুলের শরীরেও জন্ম থেকেই বাসা বেঁধেছে এইচআইভির জীবাণু। গাজীপুরের রিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, ‘বাধ্য হয়ে তার আক্রান্ত শিশুকে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে নিয়ে যেতে হয়, কারণ ওই স্কুলের শিক্ষকরা তার সন্তানদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করত, গালিগালাজ করত, অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখত। আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ শিশুই সামাজিক সহায়তা বা সহানুভূতি পায় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব শিশুর বেশিরভাগই এতিম। কারও কারও বাবা-মা দু’জনেই এইডসে মারা গেছেন। কারও বাবা এইডসে মারা গেছেন আর মা এইচআইভি পজিটিভ। এদের কারোরই অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় এরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না। এমনকি লেখাপড়া, স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না। বাবা-মায়ের ভুলের কারণে কিংবা অন্যদের সামান্য অসচেতনতার কারণে কোমলমতি অনেক শিশুই বহন করে চলেছে ভয়াবহ এইচআইভি জীবাণু। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, অজ্ঞতা, সঠিক ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মীয়-স্বজনদের অবহেলা এবং অযতেœর কারণে এদের অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছে মরণব্যাধি এইডসের দিকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মায়ের কাছ থেকে শিশুরা সাধারণত তিনটি উপায়ে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে এবং বুকের দুধের মাধ্যমে সন্তানের শরীরে এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মতে, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা তাদের মায়েদের কাছ থেকে এইডসে আক্রান্ত হয়। সেহেতু সন্তান নেয়ার আগে মায়েদের এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রক্ষণশীল সমাজে মায়েরা আক্রান্ত হয় তাদের স্বামীদের কাছ থেকে। বেসরকারীভাবে এইডসে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা দেয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠান আশার আলো সোসাইটি সূত্রে জানা যায়, এদেশের বাজারে এইডস-আক্রান্ত শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের উপযোগী ওষুধ এখনও পাওয়া যায় না। সোসাইটির ২০০৭ সালের ৪৮৫ সদস্যের মধ্যে একটি শিশু নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে মারা গেছে ওষুধ না পাওয়ায়। এইচআইভি রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসার পুরোটাই হচ্ছে জেনেভাভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফান্ডের আর্থিক সহায়তায়। নিজের ও তিন বছর বয়সী শিশু সন্তানের ওষুধ সঙ্কটের কথা জানালেন সাদেকা খাতুন। তার স্বামী একই সঙ্গে যক্ষ্মা ও এইডস রোগী। একটি এনজিও সহায়তায় স্বামী-স্ত্রী ওষুধ পাচ্ছেন। কিন্তু তার সন্তানের ওষুধ আনতে হচ্ছে ভারত থেকে। সাদেকা জানান, ভারতের একটি এনজিও বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত ওষুধ পৌঁছে দেয়, তিনি গিয়ে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের একটি এনজিওর সহায়তায় এ বন্দোবস্ত হয়েছে। আশার আলো সোসাইটির উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তা আসমা পারভীন (পিএইচডি রিসার্চ ফেলো) বলেন, এইডসে আক্রান্ত্র এতিম অসুস্থ শিশুদের জন্য একটি শিশুসদন বা আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা ভীষণ জরুরী। কারণ বাবা-মা হারা এতিম শিশুরা এইচআইভি জীবাণু বহন করার কারণে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে খুবই অনাদর-অবহেলায় আছে। অস্পৃশ্য, নিগৃহীত হয়ে আছে সমাজের কাছেও। আসমা পারভীন আরও জানান, ইউএনএফপিএ ও আশার আলো সোসাইটি এইডসমুক্ত বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দেশে সরকারী ১৬টি ও বেসরকারী ৭৫ এইচআইভি পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে সরকারী অনুদানে এআরটি সেবা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন: সিডি-৪ সেল, ভাইরাল লোড, ওষুধের কার্যকারিতা নিরীক্ষা ইত্যাদির সুযোগ খুবই কম। তিনি জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে এইডসমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা অনেক বাড়াতে হবে। দেশে অনেক নারী অনাকাক্সিক্ষতভাবে এইডসে জড়িয়ে পড়ছেন। মা থেকে শিশুর যেন এইচআইভি না হয় সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় আর্থিক, সামাজিক ও আইনী সেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি তারা যেন কোন প্রকার অপবাদ ও বৈষম্যের শিকার না হন, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। বাংলাদেশে এইডস রোগী ॥ বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এইডসে দেশে মোট ৭৯৯ জনের মৃত্যু হয়। বর্তমানে বছরে প্রায় দেড়শ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এইডসে। ২০১৬ সালে দেশে ৫৭৮ এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়, যাদের ৩২ শতাংশ কোন না কোন সময় দেশের বাইরে ছিলেন।
×