ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ॥ ১১ মার্চ ১৯৪৮ এবং বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৪:২০, ১৩ মার্চ ২০১৮

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ॥ ১১ মার্চ ১৯৪৮ এবং বঙ্গবন্ধু

(শেষাংশ) এ কে ফজলুল হক ও নঈমুদ্দীনের পৃথক বিবৃতি হাইকোর্ট থেকে ফেরার পথে সেক্রেটারিয়েট এলাকায় বেশ কিছু ছাত্রকে স্লোগান দিতে দেখেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। তিনি সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে বক্তব্য দেয়া শুরু করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং এ কে ফজলুল হক সামান্য আহত হন। ফজলুল হকের আহত হওয়ার ঘটনা এবং বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেফতার হওয়ায় সর্বত্রই উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। যারা অফিসে এসেছিল, দোকান খুলেছিল-তারাও সবকিছু বন্ধ করে বাড়ি ঘরে ফিরে যায়। ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের দিন ঢাকা শহরে যা ঘটেছিল, সে সম্পর্কে এ কে ফজলুল হক সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। ১১ মার্চের ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি সে দিনের ঘটনার বর্ণনা, আন্দোলনের যৌক্তিকতা, সরকারের দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে ছাত্রসমাজকে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন- ‘পাকিস্তানের শতকরা ৬৬ জন অধিবাসীর মাতৃভাষাকে পাকিস্তান ডোমিনিয়নের সরকারী ভাষা করার দাবি করিয়া যে আন্দোলন শুরু হইয়াছে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা তাহা দমন করার চেষ্টা করিয়া ফ্যাসিস্ট নীতিই অনুসরণ করিতেছেন। তাঁহারা নিরীহ ছাত্রদের ওপর গুলি ও লাঠি চালাইয়াছেন এবং অনেককে গ্রেফতার করিয়াছেন। ছাত্ররা ইহাতে আতঙ্কিত না হইয়া বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তাহারা যে দাবি করিয়াছে সরকার তাহাদের দাবি পূরণ করিবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণের জন্য আমরা যে আন্দোলন শুরু করিয়াছি তাহাতে যোগদানের জন্য পাকিস্তানের সকল ছাত্রকে আহ্বান করিতেছি। গতকাল্যকার ঘটনায় ২০০ জন আহত হইয়াছে। তাহাদের মধ্যে ১৮ জন গুরুতর আহত হইয়া হাসপাতালে প্রেরিত হয়। ৯০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাহাদের মধ্যে হইতে পরে অনেককে ছাড়িয়া দেয়া হইয়াছে। ৬৯ জনকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হইয়াছে। গতকল্যকার ঘটনার সময় যাহারা গ্রেফতার হইয়াছে তাহাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, মি. অলি আহাদ এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা ইনসান-এর সম্পাদক মি. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী অন্যতম। অন্যান্য ব্যক্তির সহিত তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম এবং স্থানীয় বাংলা সাহিত্যিক ‘জিন্দীগী’র সহযোগী সম্পাদক মি. কাজী সামসুল ইসলামও আহত হইয়াছেন।’ [সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ ১৯৪৮ সংখ্যা ও বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন, লেখক- মোঃ আইয়ুব আলী, প্রকাশক-খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা, পৃ. ৬৬-৬৭] সরকারী প্রেসনোট ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সম্পর্কে পূর্ববঙ্গ সরকার একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। এই ইশতেহারে মিথ্যাচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার একটি সূক্ষ্ম প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়। ১৩ মার্চ ১৯৪৮ দৈনিক আজাদে ইশতেহারটি প্রকাশিত হয়। ইশতেহারে বলা হয়- ‘বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রে সরকারী ভাষা করা হবে না বলে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে ১১ মার্চ যে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল কতিপয় বিভেদকারী ও একদল ছাত্র তা কার্যকর করার চেষ্টা করে। শহরের সমগ্র মুসলিম এলাকা এবং অমুসলিম এলাকার অধিকাংশ লোক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। শুধুমাত্র কয়েকটি হিন্দু দোকান বন্ধ করা হয়। কিন্তু আইন আদালতে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম চলতে থাকে। তবে রমনা অঞ্চলে ধর্মঘটীরা কিছু অফিস কর্মচারীকে নিরস্ত করতে সমর্থ হয়। সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট ও অন্য অফিসের সামনে পিকেটিং করার জন্য দলে দলে ছাত্ররা সমবেত হতে থাকে। তাদের অনেককেই শান্তভাবে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু অন্যরা অফিসগামী ব্যক্তি ও পুলিশের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে আক্রমণ করতে থাকে। ফলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। পুলিশ দু’বার ফাঁকা আওয়াজ করে। শোভাযাত্রায় পুলিশের হস্তক্ষেপের ফলে ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে আছে, তার মধ্যে কারও আঘাত গুরুতর নয়। কয়েকটি স্থানে খানাতল্লাশির ফলে প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে গোলযোগ সৃষ্টি করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের তথ্য সরকারের হস্তগত হয়েছে।’ ১৪ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে পূর্ববঙ্গ সরকারের এই ইশতেহারের সমালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়Ñ ‘..সরকারী ইশতেহারে বলা হইয়াছে যে, কেবল অমুসলমানদের একাংশ বিক্ষোভসূচক ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল। আমাদের ধারণা এই যে, এই বিবরণ সম্পূর্ণ নহে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নজড়িত আন্দোলন কোন বিশেষ সম্প্রদায়ে আবদ্ধ নহে। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন তোলার কোন কারণ বা সঙ্গতি আছে বলিয়া আমরা মনে করি না।’ ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচী কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জেলায় এ কর্মসূচী পালিত হয়। বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, চাঁদপুর, ভৈরব, যশোর, নোয়াখালী, রংপুর, চট্টগ্রাম, মেহেরপুর, পাবনা, খুলনা, দৌলতপুর, মুন্সীগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় ধর্মঘট, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র এবং শিক্ষিত সমাজের বাইরেও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরদার হতে থাকে। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ ফুঁসে ওঠে। ১২ মার্চ জগন্নাথ কলেজে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বি. দাশগুপ্ত হামলাকারীদের বাধা দিতে গেলে তিনিও আক্রান্ত হন। ১৩ মার্চ ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং সমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৪ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউসে বিকেল তিনটায় মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সভা শুরু হয়। রাত ন’টা পর্যন্ত ছাত্ররা এখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় ১৫ মার্চ পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশনের দিন সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমেদ এ সভায় আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রেল ধর্মঘট সফল করার জন্য সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের টঙ্গী ও কুর্মিটোলায় পাঠানো হয়। একদিকে ১৫ মার্চ পূর্ববঙ্গে আইনসভার অধিবেশন, অপরদিকে ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আগমন- এমনি সময়ে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং ফুঁসে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জরুরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের অন্যতম নেতা কমরুদ্দীন আহমদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন যে, ১৪ মার্চ রাতে ডাক্তার মালিক, তোফাজ্জল আলী খাজা নাজিমুদ্দিনের এক চিঠি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু জাতির পিতা কায়েদে আজম ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় প্রথম সংবর্ধনা জানানো উচিত, সেহেতু প্রধানমন্ত্রী কর্মপরিষদের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ সম্বন্ধে আলোচনা করতে চান। কমরুদ্দীন আহমদ প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেন যে, যেহেতু তিনি এবং আবুল কাসেম ছাড়া রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বাকি সদস্যরা প্রায় সকলেই জেলে, এমতাবস্তায় তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোন মতামত দেয়া সম্ভব নয়। ১৫ মার্চ সকাল সাড়ে সাতটায় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বার্তা নিয়ে মোহাম্মদ আলী ও মরহুম খাজা নসরুল্লা পুনরায় কমরুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাত করে জানান যে, মুখ্যমন্ত্রী কর্মপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত এবং তাদের দাবি-দাওয়া মানতে রাজি আছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সকাল সাড়ে আটটায় কর্মপরিষদের জরুরী কর্মীবৈঠক ডাকা হয় ফজলুল হক হলে এবং বেলা এগারোটায় খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, নঈমউদ্দিন, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যসচিব পাঞ্জাবি আমলা আজিজ আহমেদের সভায় উপস্থিত থাকার প্রস্তাব করলে ছাত্রনেতৃবৃন্দ তুমুল বিরোধিতা করেন এবং তাকে বাদ দিয়েই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তুমুল তর্কবিতর্ক ও বাকবিতন্ডার পর কর্মপরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ প্রণীত ৭ দফা দাবি সম্বলিত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন ৭ দফা প্রস্তাব মেনে নিয়ে নতুন আরেকটি প্রস্তাব যুক্ত করেন। চুক্তি সম্পাদনের স্বার্থে কর্মপরিষদের নেতারা তা মেনে নেন। চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে সভা মুলতবি দিয়ে কমরুদ্দীন আহমেদ, আবুল কাসেম প্রমুখ ভাষা আন্দোলনে কারাবন্দী নেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, অলি আহাদ, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখকে চুক্তির শর্তাবলী দেখিয়ে তাঁদের সমর্থন নিয়ে আসেন। অতঃপর বর্ধমান হাউসে ফিরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সম্পাদিত হয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ওইদিন ১৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা নঈমুদ্দীনের প্রস্তাবে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সভায় শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন একমাত্র বক্তা। সাধারণ সভায় ৮ দফা চুক্তিনামার ৩টি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করে তা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট প্রেরণ করা হয়। সভাশেষে শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে একটি জঙ্গীমিছিল এ্যাসেম্বলির দিকে যায়। মিছিলকারীরা সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং উত্তেজনাকর স্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা ও সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সভা সম্পর্কে আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক বলেন-‘যাই হোক সংশোধিত প্রস্তাব ছাত্রসভায় অনুমোদিত হওয়ার পর অলি আহাদের মাধ্যমে নাজিমুদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ওই সভায় বক্তৃতা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই কিছু সংখ্যক ছাত্রের একটি মিছিল নিয়ে সরকারবিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পুলিশ সেখানে যথারীতি তাদের বাধা দেয়। তাদের স্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে আরও বহু ছাত্র সেখানে সমবেত হয় এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পুলিশের লাঠি চালনা সত্ত্বেও ছাত্রদের বিক্ষোভ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এবং মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্যগণ পরিষদ ভবন থেকে বের হতে পারে না। অবশেষে পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এবং ফাঁকা গুলির চাপে ছাত্রদের অবরোধ ছেড়ে চলে যেতে হয়। [সূত্র ; ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, লেখক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক, পৃ. ৫৫] ছাত্রমিছিলে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে করণীয় নির্ধারণের জন্য সে রাতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৭ মার্চ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু পরদিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভা থেকে ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ছাত্রধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত গণসংবর্ধনার বক্তৃতায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললে শুধু ছাত্রসমাজই নয়, সারাদেশের মানুষ এর প্রতিবাদে মুখর হয়। এর মধ্যে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ জিন্নাহর মৃত্যু হলে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আপাতত অমীমাংসিত থেকে যায় এবং আন্দোলনেও ভাটা পড়ে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ এক মাইলফলক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টির ফলে ধর্মীয় আবেগ, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানদের একটি বড় অংশের ইংরেজী প্রীতি এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাহাড় সমান জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করে যে ছাত্র-যুবকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সময় এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় তাদের শুধু ভাষাপ্রেমী নয়, বীর হিসেবে চিহ্নিত করাই হবে যথার্থ। বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তদানের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তার সূত্রপাত এবং প্রেরণা ছিল ১১ মার্চ। আর সে কারণেই বাহান্নর পূর্ব পর্যন্ত ১১ মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হতো সর্বত্র। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেকেই ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়কে তেমন গুরুত্ব প্রদান করেননি। ইতিহাসে যার যা ভূমিকা, তা যথার্থভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই নিবন্ধ রচনা। লেখক : গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×