ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইস্রাফিল শাহীনের পাঁজরে চন্দ্রবান

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৮ মার্চ ২০১৮

ইস্রাফিল শাহীনের পাঁজরে চন্দ্রবান

মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও সমসাময়িক বাস্তবতাই সাধারণত শিল্পের মূল উপজীব্য বিষয়। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই কঠিন ও নির্মম বাস্তবতার নেপথ্যে রয়েছে নানা ঘটনা। বৈশ্বিক রাজনীতি, কূটনৈতিক খেলা ও সে সঙ্গে মানবিক বিষয়। নির্মম পৈশাচিকতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার তান্ত্রিক ফাঁদ যেভাবে মানুষকে অস্তিত্বহীন করে তোলে, যেখানে জীবন মৃত্যু পরস্পরের খুব কাছে চলে আসে সেই বাস্তবতাই মঞ্চে দৃশ্যমান। ড. ই¯্রাফিল শাহীন একজন বিচক্ষণ নাট্য নির্দেশক। পরীক্ষামূলক নাটক নির্দেশনায় তিনি বরাবরই একটু বেশি রোমাঞ্চবোধ করেন। ‘পাঁজরে চন্দ্রবান’ একটি তেমনি পরীক্ষাধর্মী নাটক। এর আগে ইউরোপীয় ধ্রুপদীরীতি ভেঙ্গে শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যেখানে প্রসেনিয়াম মঞ্চ ভেঙ্গে পুরোপুরি ভিন্ন আদলে সেট ডিজাইন হয়েছিল। সেই সঙ্গে নানা রকম অপ্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নাটকে বহুমাত্রিকতা এনে দিয়েছিল। এ ছাড়া তিনি আধুনিক ইউরোপের নাটক নিয়ে কাজ করেছেন। বিভিন্ন নাটকে স্তানিস্লাভাস্কির বাস্তববাদী অভিনয় দ্বারা চরিত্র নির্মাণ করেছেন। সুর, সঙ্গীত ও বর্ণনাধর্মী সংলাপ সহযোগে এই নাটকটি বাস্তবতা ও কল্পনার দুই জগতকে এক রেখায় নিয়ে আসে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশার যে বৈপরীত্য সেটাকে অনুধাবন করার প্রয়াসই ছিল এই নাটকের মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটা বাস্তবচিত্র নাটকের মধ্য দিয়ে জাতির কাছে দৃশ্যমান করার অভিপ্রায়। বিতাড়িত, উৎখাত ও আশ্রয়হীন মানুষগুলো যখন এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মা-ের মধ্যে একটু জমি পেল তখন সেই ভিটেতে মাথা গুঁজবার ঠাঁই তৈরিতে যে এক নির্মল উচ্ছ্বাস নিজেদের ভেতর দানা বাঁধতে ছিল প্রথম দৃশ্যে তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। পরক্ষণেই সেই স্বপ্নের মৃত্যু। লুটপাট, ধর্ষণ আর হত্যা পরিবারটিকে আবার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া। সত্যিই এই লোমহর্ষক বাস্তবতা মানুষের কাছে দৃশ্যমান হওয়া উচিত। শুধু রোহিঙ্গাই নয়, সারা বিশ্বে আজ এর প্রতিচ্ছবি। হয়ত কৌশলটা ভিন্ন রকম। শোষক- শোষিতের এই টানাপোড়েন শতাব্দী ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সকল ভূখ-। দ্বিতীয় দৃশ্যে এক বৃদ্ধ যিনি তার জীবদ্দশায় প্রতিনিয়ত খুন, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, লুটতরাজ দেখতে দেখতে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় আচ্ছন্ন, তিনি আজ নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় সমুদ্রের সৌন্দর্যের মধ্যে। এই যে রোমাঞ্চকর আবার লোমহর্ষক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে বৃদ্ধ ব্যক্তির, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই দায়ভার কে নেবে? জ্যোৎ¯œা রাতে সমুদ্রের বিশালত্বের মধ্যে নিজেকে নিবেদন করার এই আকুতি কতটা শক্তিশালী প্রতিবাদ তা অনুধাবন না করতে পারলে পৃথিবীর ধ্বংস অনীবার্য। পরবর্তী দৃশ্য সাজানো হয় মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সত্তা যেভাবে মানুষকে পরিচালিত করে। জীবন মৃত্যু আশা-হতাশা, রাগ, ক্ষোভে, অভিমান, সন্দেহ, অনুতাপ ও ভালবাসার সংশ্লেষে একই চরিত্র তিনটি ভিন্ন সত্তায় নিজেদের মুখোমুখি হয়। এক তরুণীর উপস্থিতিতে তাদের অস্তিত্ব সঙ্কট তীব্র মাত্রা ধারণ করে এবং তারা উপলব্ধি করে তাদের নিজেদের ভিন্ন সত্তা ও অস্তিত্বের বাস্তবতা। ছয় মাস আগে নিখোঁজ হওয়া পুত্রের শোকে কাতর বৃদ্ধ দম্পতি। সব প্রতিকূলতাকে জয় করে টিকে থাকলেও এই শোকের ভার বইতে ব্যর্থ পিতামাতা। ঘটে স্মৃতিবিভ্রম। আশায় বুক বাধে এই বুঝি তাদের সন্তান গোলাম আলী এলো। হঠাৎ দেখে সন্দেশ হাতে এক যুবক এসে বলে সেই তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান। নানা যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে বৃদ্ধ দম্পতি মেনে নেয়া মাত্রই স্বপ্নভাঙে। আবার স্বপ্ন দানা বাঁধে। ২য় যুবক একইভাবে আবির্ভূত হয়। সেই স্বপ্নও ভাঙে। সন্তান ফেরে না। স্বপ্নের এই আলো-আঁধারী খেলায় বৃদ্ধ মাতার মৃত্যু হয়। মৃত স্ত্রীকে নিয়ে বৃদ্ধ আবারও পুত্র পুত্র বলে বিলাপ করতে থাকে। বার বার মৃত্যু ঘটে জীবন্ত পিতার। অন্যদিকে ৯০ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ এক বৃদ্ধ চলেছে সমুদ্র দর্শনে। এ যেন সমুদ্র দর্শন নয়, সমুদ্রের কাছে নিজেকে নিবেদন। প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার বলিদান। তরুণী বৃদ্ধের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ অবধি বৃদ্ধের অশ্রুত-পূর্ব জীবন দর্শনে মোহিত হয়ে তার সঙ্গী হতে চায়। দু’জনেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যাত্রা করে নীশিকালো ইহজগতকে পদদলিত করে সমুদ্র সৌন্দর্যের খোঁজে। এভাবেই করুণ রসের উদ্রেক করে পাঁজরে চন্দ্রবানের পর্দা নামে। চমৎকার সঙ্গীত ও আলোক প্রয়োগে নাটকটি দর্শককে বিষয়বস্তুর মধ্যে ঘূর্ণায়মাণ রাখতে বাধ্য করে। সঙ্গীত পরিকল্পনা ও প্রয়োগে ছিলেন সাইদুর রহমান লিপন এবং কাজী তামান্না হক। মঞ্জ সজ্জায় আশিক রহমান লিয়ন। নাটকটি রচনা করেন শাহমান মৈশান। অভিনয়ে ছিলেন উম্মে হানী, তন্ময় পাল, সাখাওয়াত ইসলাম, মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, শংকর কুমার বিশ্বাস, রনি দাস, সানোয়ারুল হক ও ইসরাত জাহান মৌটুসী। নাটকটি গত ৫ মার্চ নাটম-লে ও ৬ মার্চ থেকে ৯ মার্চ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামী ১৩ মার্চ ২০১৮ এর মঞ্চায়ন হবে ভারতের পাটনায় এবং ১৫ মার্চ দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)তে। খ্যাতিমান নির্দেশক ড. ইস্রাফিল শাহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তিনি গত ২৮ নবেম্বর ২০১৭ থিয়েটার প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী পদক লাভ করেন। নাটকটির সার্বিক সমন্বয়কারী হিসেবে ছিলেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান আহমেদুল কবির।
×