ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৩ মার্চ ২০১৮

নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ট্রাম্পের নীতি অন্যদের পরমাণু অস্ত্র করায়ত্ত করার চেষ্টা থেকে বিরত রাখা দূরে থাক বরং তাদের সেই চেষ্টা ত্বরান্বিত করে তুলবে। চীন ও রাশিয়া উভয়েই তাদের পরমাণু অস্ত্রের উন্নতি ঘটাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং ইসরাইলও নতুন পরমাণু অস্ত্র গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থাৎ, এক নতুন পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে যা কেবল বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। অন্যান্য দেশও তাতে শরিক হয়ে গেছে। তার ফলে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি আজ স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চাইতে বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন পরমাণু অস্ত্রের দিকে ঝুঁকবে সেটি হলো ট্যাকটিকাল অস্ত্র। স্ট্র্যাটেজিক পরমাণু অস্ত্র থেকে সেটি আলাদা। স্ট্র্যাটেজিক অস্ত্রের উদ্দেশ্য হলো নগরীর পর নগরী বা কঠিন ধরনের সাময়িক টার্গেট ধ্বংস করা। আর ট্যাকটিকাল পরমাণু অস্ত্র অগ্রসরমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তথা রণাঙ্গনে ব্যবহার করা যাবে। আমেরিকা যে নতুন ট্যাকটিকাল অস্ত্র তৈরি করছে তা সমুদ্র থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য। এটি ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে লাগানো থাকবে এবং ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হবে সাবমেরিন থেকে। এক্ষেত্রে পরমাণু বোমাটি হবে ছোট আকারের। ট্রাম্পের টিম বলেছে যে, চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ের বিস্তার ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র স্ট্র্যাটেজিক অস্ত্র দিয়ে নগরীর পর নগরী গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে সীমিত পরিসরে পারমাণবিক যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে। ট্রাম্পের যে নতুন পরিকল্পনা আছে তাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের পরিচালিত পারমাণবিক স্ট্র্যাটেজিক হামলার মতো পরিস্থিতিতে এখন পরমাণু বোমা ব্যবহারের নির্দেশ দিতে পারেন। ২০১৮ সালে পেন্টাগন বাজেটে ট্রাম্প এখন এক নতুন ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবনে অর্থায়ন করেছেন যেটা শেষ পর্যন্ত তৈরি বা মোতায়েন করা হলে তা হবে রাশিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৩০ বছরের পুরনো একটি চুক্তি মাঝারি পাল্লার পরমাণু শক্তি চুক্তির (আইএনএফ) লঙ্ঘন। অবশ্য ট্রাম্প বলতে পারেন যে, রাশিয়া তো আগেই এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। পেন্টাগন সূত্রে বলা হয় রাশিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে এক উন্নত ধরনের ক্র্জু মিসাইল পরীক্ষা করেছে এবং সেগুলো দুটি আলাদা আলাদা সামরিক ইউনিটে মোতায়েন করে ইউরোপীয় রাজধানীগুলোকে ঝুঁকির মুখে রেখেছে। ন্যাটো এই ক্ষেপণাস্ত্রের নাম দিয়েছে এসএসসি-৮ স্ক্রুড্রাইভার। রাশিয়ার এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এমনভাবে ছোড়া যেতে পারে যে প্রতিপক্ষ কি আসছে তা নির্ণয় করার মতো আগাম সময় তেমন একটা পাবে না। রাডার স্ক্রিনে ব্লিপ দেখলেই নেতাদের দ্রুত বুঝে নিতে হবে কি আসছে এবং কিভাবে তার জবাব দেয়া উচিত। ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার এই নতুন উন্নত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে উদ্বিগ্ন ঠিকই। তবে তাই বলে এর জবাবে ট্রাম্প প্রশাসন যে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকে ঝুঁকছে তাতে তারা খুশি নয়। তারা মনে করে এতে করে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সাবেক মার্কিন সিনেটর স্যাম নান ও রিচার্ড হুগার আশঙ্কা করেন যে, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যুগ একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। তারা বলেন আমরা এমন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যেখানে পরামণু ক্ষেত্রে অনেক বড় ধরনের ঝুঁকি থাকছে। বস্তুতপক্ষে রাশিয়া ও আমেরিকা পরমাণু শক্তির পেছনে ব্যয় বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমানে আমেরিকার পুরনো তিন ধরনের পরমাণু অস্ত্রের বাহক বোমারু বিমান, সাবমেরিন ও স্থলভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র আগামী তিন দশকে আধুনিকায়ন করার যে পরিকল্পনা আছে তাতে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করার প্রয়োজন পড়বে। পরমাণু বোমা, যেসব ল্যাব ও কারখানায় তৈরি হয় সেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে অর্থ বিনিয়োগ করছে। রাশিয়াও তার পরমাণু শক্তি ঢেলে সাজাচ্ছে। এর মধ্যে আইসিবিএম, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন ও আধুনিক বোমারু বিমানও আছে। রাশিয়া অতিকায় আরএস-২৮ সারমাট আইসিবিএমও বানাচ্ছে যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারবে। রাশিয়া-আমেরিকার এই প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি বিশ্বের বাকি দেশগুলো যে দেখছে না তা নয়। বিশ্বের পরমাণু অস্ত্রের প্রায় ৯৩ শতাংশ এখন এই দুটি দেশের হাতে। বাকি ৭ শতাংশ রয়েছে ৯টি দেশের কাছে। তবে স্নায়ুযুদ্ধের সময় পরমাণু অস্ত্র সংখ্যা যা ছিল এখন তা অনেক কমে এসেছে। ১৯৮৬ সালে বিশ্বে এমন অস্ত্রের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ- ৭০৩০০টি। এখন তা দাঁড়িয়েছে ১৪৫৫০। তবে অস্ত্র হ্রাসের গতি দারুণভাবে কমে এসেছে। সারাবিশ্বে পরমাণু অস্ত্র সংগ্রহের অনুমিত মূল্য বা গুরুত্ব বেড়ে গেছে। অন্যদিকে পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া হ্রাস পেয়েছে। আজ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সকল পক্ষই নিজেদের অস্ত্র সজ্জিত করছে। ফলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অনিবার্যভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাম্প যদি ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করেন, সেক্ষেত্রে ইরান পরমাণু অস্ত্র করায়ত্ত করার জন্য প্রচন্ড গতিতে ছুটবে বলে পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করেন। তখন ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবও তার নিজস্ব আণবিক বোমা তৈরি করতে কিংবা তার নিকট মিত্র পাকিস্তানের কাছ থেকে একটি বা দুটি সংগ্রহ করতে পারে। নিজের জানি দুশমন ভারতকে মোকাবেলা করার জন্য পাকিস্তানও তার পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার দ্রুত বাড়িয়ে চলেছে। দেশটি টেকনিক্যাল পরমাণু অস্ত্রের মওজুদ বাড়িয়ে তুলছে। চীনের এখন জিন ক্লাস নামে পরিচিত পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন আছে, যা দেশটির সামরিক বাহিনীকে সমুদ্র থেকে আইসিবিএম ছোড়ার সক্ষমতা এনে দিয়েছে। ওদিকে উত্তর কোরিয়াও বসে নেই। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটি ১৬ দফা পরীক্ষায় রেকর্ড ২৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। অন্তত ৬টি পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রে লাগানোর উপযোগী করে পরমাণু বোমাকে ছোট আকারে তৈরির কাজে দেশটি অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত ২৯ নবেম্বর সর্বশেষ উৎক্ষেপণে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র ২৮০০ মাইল ওপরে বহিঃমহাশূন্যে পৌঁছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন যত ওপরে আছে তার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি ওপরে গেছে। এই উড্ডয়ন পথটা সমতলে হলে ওঠা নিউইয়র্ক সিটি, ওয়াশিংটন বা আমেরিকার যে কোন শহরে আঘাত হানতে পারত। কার হাতে কত পরমাণু অস্ত্র আমেরিকার পরমাণু বোমার সংখ্যা ৬৮০০। এই বোমার তিন ডেলিভারি ব্যবস্থা বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাবমেরিন উন্নয়নে এবং অস্ত্রের নবায়নে দেশটি আগামী ৩০ বছরে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করবে। রাশিয়ার পরমাণু বোমা আছে ৭০০০। এর পরমাণু অস্ত্র সম্ভার ঢেলে সাজানোর কর্মসূচীর মধ্যে আছে নতুন সাবমেরিন ও বোমারু বিমান এবং সড়কে ভ্রাম্যমাণ ভারি আইসিবিএম। চীনের বোমার সংখ্যা ২৭০। এ বছর চীন সড়কে ভ্রাম্যমাণ নতুন আইসিবিএম মোতায়েন করবে। এছাড়া দেশটি পরমাণু বোমা সজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র বহনক্ষম সাবমেরিন ও বিমানের উৎকর্ষতা ঘটাচ্ছে। ব্রিটেনের পরমাণু বোমা ২১৫টি। দেশটি পরমাণু বোমা সংযোজিত ট্রাইডেন্ট২ ৫টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সাবমেরিনের বহর তৈরি করছে যা ২০৩০ এর দশকের মধ্যে চালু হবে। পাকিস্তানের হাতে পরমাণু বোমা ১৪০। আগামী দশকে দেশটি তার পরমাণু অস্ত্রভা-ার বাড়িয়ে তুলবে। সরকার ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভারতের আছে ১৩০টি বোমা। দেশটি এখন বিমানবাহিত সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। এর প্রথম পারমাণবিক সাবমেরিন ২০১৬ সালে চালু হয়েছে। ফ্রান্সের পরমাণু বোমা ৩০০। দেশটি এম-৫১ ক্ষেপণাস্ত্র বহনের জন্য ট্রাইমোফ্যান্ট শ্রেণীর সাবমেরিন উন্নতি ঘটিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ও নির্ভুলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরাইলের পরমাণু বোমা সংখ্যা ৮০। তবে দেশটি তার পরমাণু কর্মসূচীর কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। খরর আছে যে, ইসরাইল তার ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন বহরে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সংযোজন করছে। তবে খবরটি অস্বীকার করেছে সেদেশের সরকার। উত্তর কোরিয়ার হাতে এ মুহূর্তে পরমাণু বোমা আছে ১৫টি। দেশটা স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়েছে এবং গত জুলাই মাসে প্রথম আইসিবিএম উৎক্ষেপণ করেছে। তবে এর সমুদ্র থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের সক্ষমতা এখনও প্রমাণিত হয়নি। সূত্র : টাইম
×