ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুুক্তিযুদ্ধের শেকড়সন্ধানী তরুণ গবেষক

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মুুক্তিযুদ্ধের শেকড়সন্ধানী তরুণ গবেষক

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর জন্ম হয়নি। স্বভাবতই চোখে দেখেননি যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলো। তারপরও প্রতিনিয়ত ভয়াল সেই দিনগুলো প্রত্যক্ষ করে চলেছেন তিনি, শুধু নিজেই অবলোকন করছেন না আমাদেরও নিয়ে যাচ্ছেন একাত্তরে। দেখাচ্ছেন সেই ভয়ার্থ দিনগুলোর বিভৎসতা। শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধেও চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। যে বয়সে সাফল্যের পেছনে, অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তির পেছনে মানুষ দৌড়ায় সে বয়সে তিনি রাজাকারদের মুখোশ উন্মোচনে ঘুরে ফিরছেন গ্রাম থেকে গ্রামে, মানবতাবিরোধীদের বিচার দাবিতেও রয়েছেন সোচ্চার। তার দেশপ্রেম আজ সারাদেশে তাঁকে এক নামে পরিচিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে। ফলে অপূর্ব শর্মার নামের সঙ্গে এখন আবশ্যিকভাবেই যুক্ত হয় গবেষক অভিধাটি। প্রচারের আলোয় আসতে তেমন আগ্রহী নন, মুক্তিযুদ্ধের এই শেকড়সন্ধানী গবেষক পছন্দ করেন নিভৃতে থাকতে। জন্ম ১৯৭৯ সালে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হরিণাকান্দি গ্রামে। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নিলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ২০০৬ সাল থেকে। ২০০৮ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগভেরী পত্রিকায় ‘তুই রাজাকার’ নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সিরিজ লেখে আলোচনায় আসেন তিনি। দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন জগতজ্যোতির যুদ্ধগাথা। যাকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গের জন্য সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সেই বঞ্চনার কাহিনী ও তার নেতৃত্বাধীন দাসপার্টির যুদ্ধগাথা নিয়ে লিখেন ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি’ গ্রন্থ। ২০০৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশ করে দেশের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য প্রকাশ। অন্যদিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চালানো অনুসন্ধানকে ২০১০ সালে তিনি গ্রন্থরূপ দেন। ওই সালের বইমেলায় প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে বের হয় তাঁর বহুল আলোচিত ‘সিলেটের যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থটি। এরপর থেকে ধারাবাহিভাবেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখালেখি ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অপূর্ব শর্মা। এ পর্যন্ত লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মোট ৮টি বই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখা তাঁর অন্যান্য গবেষণাগ্রন্থ হচ্ছে, বীরাঙ্গনা-কথা (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০১৩), মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায় : ফিরে আসেনি ওরা (গদ্যপদ্য, ২০১৩), মুক্তিসংগ্রামে নারী (শুদ্ধস্বর ২০১৪), মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর (নাগরী, ২০১৬), চা-বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১ (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০১৬) ও মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলা (তা¤্রলিপি ২০১৭)। এরমধ্যে তাঁর লেখা অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি ও চা বাগানে গণহত্যা : ১৯৭১ গ্রন্থ দুটি অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্র গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী। গ্রন্থ দুটি আগামী বইমেলায় প্রকাশের কথা রয়েছে। তাঁর প্রতিটি গ্রন্থই অনন্য। আমাদের শুধু শিহরতি করে না তাঁর গ্রন্থগুলো, আন্দোলিতও করে। সবচেয়ে যে বিষয়টি আকৃষ্ট করে সেটি অপূর্ব শর্মার উপস্থান শৈলী। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গবেষণায় যুক্ত করেছেন এক ভিন্ন মাত্রা। বীরাঙ্গনা কথাকে এর অনন্য উদাহরণ বলা যায়। বারোজন নারীর অন্যতর জীবন যুদ্ধের আখ্যান তিনি এ গ্রন্থে তুলে ধরেছের পরম মমতা এবং আন্তরিকতায়। ৪৫ বছর ধরে চলা তাদের জীবন সংগ্রামও তিনি বিবৃত করেছেন গ্রন্থে। আর মুক্তিযুদ্ধের এক অসমাপ্ত অধ্যায় : ফিরে আসেনি ওরা গ্রন্থে যুদ্ধে গিয়ে ফিরে না আসা কিংবা যুদ্ধের ভয়াবহতায় হারিয়ে যাওয়াদের স্বজনদের প্রতীক্ষার বিষয়টিই তিনি উপস্থাপন করেছেন মানবিক দৃষ্টিতে। মুক্তিসংগ্রামে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে লিখেছেন মুক্তিসংগ্রামে নারী। এ অঞ্চলের নারীদের অস্ত্রহাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে তাদের সাহসিকতা ও আত্মোৎসর্গের কাহিনী উঠে এসেছে তাঁর নিখুঁত বর্ণনায়। সিলেট জেলার যুদ্ধ কথা ও যুদ্ধের সার্বিক বিষয় নিয়ে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলা আর মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের ঘটনায় নির্মাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর। তবে চা-বাগানে গণহত্যা বইটি তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে যুক্ত করেছে ভিন্নমাত্রা। একাত্তরে রক্তে রঞ্জিত চা বাগানের শ্রমিক ও বাগানে বসবাসকারীদের স্বাধীনতার বেদীমূলে প্রাণ বিসর্জনের করুণ কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। আমাদের মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যা এতদিন ছিল একাবেরই লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাঁর এ গ্রন্থ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেছেন, ‘লেখক-সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা অনন্য এক কর্মযজ্ঞ সাধন করেছেন, তাঁর অনুসন্ধানী মন এবং মানবিক সাংবাদিকতার গৌরবোজ্জ্বল আন্তরিকতায়। হত্যাযজ্ঞে শহীদদের খুঁজে ফিরেছেন বাগানে বাগানে এবং শহীদ পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন সেই মর্মন্তুদ ঘটনাবলী। লিপিবদ্ধ করেছেন বাস্তবের সেই কাহিনী, নির্মমতার নৃশংসতার হিংস্রতা। এ অনন্য অজানা কাহিনী জানার জন্য তাঁকে দুর্গম দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে, ভ্রমণ করতে হয়েছে বহুপথ, অঞ্চল, যেখানে চা-বাগান আছে। তাঁর অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই সংযোজন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ এবং পূর্ণাঙ্গ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ অপূর্ব শর্মা তার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণায় বিশেষ করে প্রান্তজনের অংশগ্রহণকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বার বার। সেটা তিনি করেছেন, কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে। যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিস্মৃত হতে চলা ঘটনার সঙ্গে পরিচিত করতে সাহায্য করে। তার এই নিবেদিত কর্ম প্রচেষ্টার ফলও পেয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা ও সাংবাদিকতার জন্য হয়েছেন পুরস্কৃত। ‘সিলেটের যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ গ্রন্থের জন্য ২০১০ সালের এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেন তিনি। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতায় শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে ২০১৩ সালে লাভ করেন বজলুর রহমান স্মৃতিপদক। এ ছাড়াও তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে ৮ ডিসেম্বর একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা : প্রান্তজনের কথা’ শিরোনামে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যা তার গবেষণাকে নিয়ে গেছে এক অন্যতর উচ্চতায়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ও সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে অপূর্ব শর্মার অভিব্যক্তি- ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। একাত্তরে যারা যুদ্ধ করেছেন তারা সময়ের প্রয়োজেনই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। সময়ই আমাকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণায় নিবিষ্ট করেছে। তিনি বলেন, অস্ত্র হাতে যেহেতু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি, তাই যুদ্ধ ইতিহাস লিখে যুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করতে যে ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে, সেটি কলঙ্কমুক্তির জন্য। সেই কলঙ্কমুক্তির ক্ষেত্রে যদি বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করতে পারি তাহলে সার্থক হবে জীবন।’
×