ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনায় এনজিওর অবদান

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনায় এনজিওর অবদান

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। এ উন্নয়ন অভিযাত্রায় ক্রমশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কার্যপরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। বর্তমান সরকারের যে জনকল্যাণের ক্ষেত্রে অভিলাষ- তা আজ দুর্বল শেয়ার বাজার কিংবা ব্যবস্থাপনাগত দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকিং কাঠামোর আওতায় সম্ভব হচ্ছে না। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পেটে-ভাতে রাজনীতির দর্শন’ বাস্তবায়নে এনজিওরা বিভিন্নমুখী ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিবিএসের সাম্প্রতিক উপাত্তে দেখা যায় যে, ৮৭% কর্মসংস্থান বর্তমানে সৃষ্টি হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায়। অন্যদিকে ১৩% কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে। প্রায় তিন হাজারের মতো এনজিও বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীণ ও নগর অঞ্চলে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়ন, সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কাজ করে চলেছে। গত তিন দশকে প্রায় সকল এনজিওর কর্ম উদ্যোম বৃদ্ধি পেয়েছে। এনজিওসমূহ এখন সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে চলেছে- তাদের অধিকাংশেরই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং মুনাফাবিহীন হিসেবে কাজ করার কথা। এ সমস্ত কর্মকা-ের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার পাশাপাশি রেজিস্টার্ড সামাজিক কাঠামো, হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে একচ্ছত্রভাবে কাজ করে চলেছে। দেশে যে টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ নাগাদ সরকার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ, তার ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সবগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে অর্জনে সচেষ্ট থাকলেও সবগুলো অর্জন করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে একটি সুসমন্বিত কর্মপদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণেই বর্তমানে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (চকঝঋ)-কে কাজে লাগাতে হবে। বর্তমানে প্রায় ৭৮,০০০ কোটি টাকার মতো ফান্ড ঘূর্ণায়মান আছে, যার মধ্যে পিকেএসএফ-এর প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো ফান্ড জনকল্যাণের কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনায় এনজিওরা সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, এ্যাডভোকেসি, লিগ্যাল সাহায্য, পরিবেশ এবং অনুদান প্রোগ্রামসহ নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের পার্টনার অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে উপকারভোগীদের ওপর গবেষণায় দেখ গেছে, এসডিজি- ১-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দারিদ্র্য যাতে সর্বত্র যে কোনরূপে দূরীভূত হয় এবং এসডিজি- ৫-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জন এবং নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন- এ দুটি অর্জনের ক্ষেত্রে বিএনএফের ২৩টি পার্টনার অর্গানাইজেশনের ৫২৬ জন উপকারভোগীর ওপর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দারিদ্র্যবিমোচনে এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জনে এনজিওর দ্বারা উপকারভোগীদের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে (আলী প্রমুখ ২০১৭, ১)। পৃথিবীর ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, ধর্মীয় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য আর মানুষের মৌলিক উপাদানসমূহের বিন্যাস ঘটেছে। তেমনি চার্চের সংস্পর্শে সিসিডিবি মানবকল্যাণে ব্রতী হয়েছে। আমি নিজেও কুমিল্লায় খ্রীস্টান মিশনারি স্কুলে পড়েছি। আর তার মাধ্যমে জ্ঞানের বিকাশ এবং সমতাভিত্তিক শিক্ষার পাঠদান আমেরিকান সিস্টাররা শুরু করেছিলেন। স্বর্গীয় সুশান্ত অধিকারী মানুষের আর্থিক উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন। তার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কোর-বাংলাদেশের রিজিওনাল ডিরেক্টর হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ থেকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খ্রীস্টান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ঈঈউই)-এর নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। মানব হিতৈষী সুশান্ত অধিকারী অবিচল ছিলেন মানুষের আত্মিক মর্যাদা উন্নয়নের তরে। সুশান্ত অধিকারী মন্তব্য করেছিলেন- ‘মানুষ মানুষকে ভয় পাচ্ছে, বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ মানুষ কিন্তু প্রেমের জন্য, দয়ার জন্য। দয়ালু মানুষ এ পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী। যিনি দয়ালু, তার কিছুই হারাবার ভয় নেই। তিনি কখনই পরাজিত হন না।’ তার এই বক্তব্য বর্তমান যুগে এদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত। অমিত লোভের কারণে সংখ্যালঘিষ্ঠ একটি গ্রুপ মানি সেন্ট্রিক সোসাইটিতে দয়ামায়াহীনভাবে কর্মকা- বাস্তবায়ন করে চলেছে। তাদের কারণে সিংহভাগ মানুষ দয়ালু প্রকৃতির হলেও মায়াহীন স্বল্প মানবের জন্য এ সমাজে ভারসাম্যহীন, সামাজিক ন্যায়বিচারহীন মানুষের সৃষ্টি করছে। এরা কখনও ধর্মব্যবসায়ীর নামে, মোহাচ্ছন্ন ও অসাধু পন্থা গ্রহণ করে থাকে। সারাক্ষণ খাই-খাই করতে থাকা এই গ্রুপটি বিভিন্ন কায়দায় মানুষকে ঠকিয়ে চলেছে। তারা চেষ্টা করে ক্ষমতাতন্ত্রের কাছাকাছি থাকার। এই অসৎ প্রকৃতির মানুষের পাশাপাশি কিছু দয়ালু প্রকৃতির মানুষও রয়েছে। যারা দয়ালু প্রকৃতির, তারা নানা ধরনের আপদ-বিপদের মধ্য দিয়ে গেলেও সর্বশেষে তারা কিন্তু বাস্তবে জিতে যায়। আসলে উন্নয়ন কর্মকা-ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানব কল্যাণ। এই মানব কল্যাণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন, যাতে করে উন্নয়নের কলা-কৌশল বাস্তবায়ন করে সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়। সুশান্ত অধিকারী ‘অধুনা’ পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘অতিমাত্রায় ক্রেডিট-নির্ভরতার কারণে এনজিওর ভাল কাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তার এই বক্তব্য অতিমাত্রায় যথাযথ। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানী বাহিনী আর তার দোসর রাজাকারদের কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সক্রিয়ভাবে এনজিওর মাধ্যমে অংশ নেন। তিনি দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। অত্যন্ত নরম মনের অধিকারী অথচ কর্মের ঔজ্জ্বল্যে বলিষ্ঠ সুশান্ত অধিকারী প্রথম সারির এনজিও কর্মকর্তা হিসেবে সে-সময়ের কর্মকা- প্রত্যক্ষ করে উপরোক্ত বক্তব্য রেখেছিলেন। তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক ধরনের সত্য বলার দুরন্ত সাহস। আজ সময়ের বিবর্তনে এনজিওর কর্মকা- অনেক বেশি মানবিক এবং তাদের উন্নয়ন মডেলেও নানা পরিবর্তন এসেছে। এখন এনজিওগুলো ধীরে-ধীরে তাদের অতিরিক্ত ক্রেডিট নির্ভরতার ঠরপরড়ঁং ঈরৎপষব থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস নিয়েছে। তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, মাইক্রো ক্রেডিটের মতো লাভজনক বিনিয়োগ আর হয় না। গ্রামীণ ব্যাংক যখন তাদের কর্মকা- শুরু করে, তখন উচ্চ সুদের হারের কারণে শোষণের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল। কিন্তু দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনার কারণে উচ্চ সুদের হার একটি ভিন্নমাত্রা যুক্ত করে, যা ড. ইউনূসকে সমালোচিত করে। আবার তাদের কাছ থেকে অর্জিত অর্থ একই কায়দায় বিদেশে প্রেরণ করেছেন। নৈতিকতাবিহীনভাবে ড. ইউনূস বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনে ডোনেশন দিয়েছিলেন। সুশান্ত অধিকারী মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘টাকা দিয়ে কখনও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের জন্য অর্থ হয়ত একটি বড় ফ্যাক্টর, কিন্তু এটির ড্রিস্টিবিউশন যাতে ঠিকমতো হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’ তার এ বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আয়প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে, যা মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, ন্যায়পরায়ণতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আর্থিক মুক্তির জন্য মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে আয়প্রবাহ সঞ্চার করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বদলে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে সরকার বর্তমানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। সুশান্ত অধিকারী যথার্থই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নানা বিবর্তনকে দেখেছেন। তিনি সত্তর সালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস-পরবর্তী উন্নয়ন কর্মকা-ে অংশ নিয়েছেন; এদেশে থেকেই পাকিস্তানী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের লুকিয়ে আত্মীয়পরিজনসহ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করেছেন। চলবে... লেখক : অর্থনীতিবিদ [email protected]
×