ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাইজুলের রেকর্ড-লজ্জা!

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

তাইজুলের রেকর্ড-লজ্জা!

মোঃ মামুন রশীদ ॥ সাগরিকায় টেস্টে চতুর্থদিন থেকেই দেখা যাবে স্পিনের দাপট। ওই পরিস্থিতি যাতে এড়িয়ে যাওয়া যায় সে কারণেই টস জিতে আগে ব্যাটিং করেছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাগতিকদেরই ওই ঘূর্ণি জালে আটকা পড়তে হয়েছে। চতুর্থদিন চা বিরতির একটু পরেই ব্যাটিংয়ে নেমে সফরকারী শ্রীলঙ্কার স্পিনারদের মায়াবী ইন্দ্রজালে দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে পর্যন্ত বাংলাদেশী স্পিনারদের ওপর ব্যাট নয় যেন চাপাতি চালিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা প্রায় দুদিন ধরে। সেটার সমাপ্তিও ঘটেছে মধ্যাহ্ন বিরতির পর। একাদশে বাংলাদেশের তিন বিশেষজ্ঞ স্পিনার সানজামুল ইসলাম, মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলাম। এর মধ্যে মিরাজ ও তাইজুল যখন জ্বলে উঠে ঘূর্ণির ভেল্কি দেখালেন ততক্ষণে লঙ্কানদের সংগ্রহ চলে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিংহভাগ বলই ছুঁড়েছেন তাইজুল আর সর্বাধিক রানও খরচা করেছেন । বিনিময়ে তিনি যেন সান্ত¡না পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ৪ উইকেট। এর মধ্যে দুটিই টেলএন্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট। ২১৯ রান খরচা করে এক লজ্জার রেকর্ডের মালিক হয়েছেন এ বাঁহাতি স্পিনার। টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ওভার বোলিং করে সবচেয়ে খরুচে বোলারের লজ্জা সঙ্গী হয়েছে তার। দেশের পক্ষে সেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তাইজুল, এক ইনিংসে ৮ উইকেট শিকার করে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তাইজুল ৩৯ রান দিয়ে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন মিরপুর টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে। সেই রেকর্ড গড়ার পরও এক সময় আর টেস্ট দলে নিয়মিত হতে পারেননি ২৫ বছর বয়সী এ স্পিনার। ওই ইনিংসটির পর তাইজুল ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন আর মাত্র একবার। ক্যারিয়ারের প্রথম ৬ টেস্টে তিনবার ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তি গড়া তাইজুল গত ১০ টেস্টে আর কোন ইনিংসে ৩টির বেশি উইকেট নিতে পারেননি। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তিনি দলেই জায়গা পাননি। আর দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক দুই টেস্টের সিরিজে তিনি সাকুল্যে শিকার করেন ৪ ইনিংস বোলিং করে ৬ উইকেট মাত্র। শুরুতে যেমন ধারালো বোলিং নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এখন যেন সেই তাইজুলের স্পিন হয়ে গেছে ভোঁতা, অকেজো। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চলমান প্রথম টেস্টে নামার আগে ১৬ টেস্টে ৫৪ উইকেট ছিল তার নামের পাশে। বরাবরই সাগরিকায় স্পিনাররা দাপট দেখান, তবে সেটা কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত ২/৩ দিন সাধারণত ব্যাটসম্যানদের দৌরাত্ম্য থাকে। আগে ব্যাটিং করে লঙ্কান স্পিনারদের সেটাই যেন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। এরপর বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে লঙ্কান স্পিনাররা ৬ উইকেট শিকার করেন। শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস শুরুর পরই ডানহাতি অফস্পিনার মিরাজ আঘাত হেনেছিলেন। কিন্তু সেই সাফল্যের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। দ্বিতীয় উইকেট তুলে নিতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৮০ ওভার ২ বল। সেটিও একাদশে থাকা একমাত্র পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের শিকার। অথচ এর মধ্যে মিরাজ ছাড়াও সানজামুল, তাইজুল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক হোসেন ও মুমিনুল হকরা তাদের স্পিন আক্রমণ নিয়ে সফল হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। স্পিন সাফল্য পেতে পেতে পুরো ১০২ ওভার অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাইজুল তার প্রথম সাফল্য পেয়েছেন কুশল মেন্ডিসকে সাজঘরে ফিরিয়ে। তারপর থেকে বাকি উইকেটগুলো তাইজুল-মিরাজ-সানজামুলই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কিন্তু তৃতীয় সাফল্যের জন্য অপেক্ষা আরও ৫১ ওভার ১ বল এবং খরচা ১৩৫ রান। সিংহভাগ ওভারই বল হাতে ছিলেন তাইজুল। সফল হননি টানা বোলিং করলেও। চতুর্থদিন একেবারে লঙ্কান ইনিংসের শেষ মুহূর্তে তিনি ৩ উইকেট দখল করেন এবং এই ইনিংসে দেশের সফলতম বোলার হন। এ পর্যন্ত বললে তাইজুলকে নিয়ে সন্তুষ্টি আসার কথা। কিন্তু এর পেছনে তাকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে সে জন্য দেশের পক্ষে রেকর্ডই গড়ে ফেলেছেন তিনি। সেই রেকর্ড মোটেও আনন্দের কিংবা স্মরণীয় করে রাখার মতো নয়। এক ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ওভার বোলিং করেছেন তাইজুল। শ্রীলঙ্কার ইনিংসে তিনি সবমিলিয়ে ৬৭.৩ ওভার বোলিং করেন। এর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১০ সালে ৬৬ ওভার বোলিং করে রেকর্ডটা দখলে রেখেছিলেন সাকিব আল হাসান। ৬০ ওভারের বেশি বোলিং করার রেকর্ড আর বাংলাদেশের পক্ষে নেই। এটিকে তবু বোলার হিসেবে ধৈর্যশীল ও পরিশ্রমী তাইজুল এমনটাই প্রমাণ করে বলে লজ্জার ব্যাপার হয়তো নয়। কিন্তু ২১৯ রান দিয়ে দেশের পক্ষে অনন্য এক রেকর্ডই গড়েছেন তিনি। এক ইনিংসে এর আগে কোন বাংলাদেশী বোলার ২০০ রানের বেশি দেননি। টেস্ট যুগ শুরুর পর এক সময় এই রেকর্ডটা ছিল বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের। পরবর্তীতে তার সঙ্গে ভাগ বসিয়েছিলেন সোহাগ গাজী। ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে ৪৫ ওভারের বোলিংয়ে ১৮১ রান খরচ করেছিলেন রফিক। সমান রান খরচ করলেও তারচেয়ে ৩ ওভার বেশি বোলিং করেছিলেন সোহাগ গাজী। তবে রান খরচের ‘ডাবল সেঞ্চুরি’তে তাইজুলই প্রথম। সবমিলিয়ে তার বোলিং ফিগারটা এমন ৬৭.৩-১৩-২১৯-৪। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি খরুচে বোলার অস্ট্রেলিয়ার চক ফ্লেটউড-স্মিথ। ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার এ স্পিনার ৮৭ ওভারে ২৯৮ রান খরচ করে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। তবে ৪ উইকেট পাওয়া বোলারদের তালিকায় খরচের দিক থেকে প্রথম অবস্থানে তাইজুল। তার নিচে থাকা ব্রেট লি ৩৯.৩ ওভারে ২০১ রানে নেন ৪ উইকেট, আর ড্যানিয়েল ভেট্টরি ৫৭ ওভারে ২০০ রান খরচায় নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। চতুর্থদিন চা বিরতির কিছু আগে থেকে সাগরিকায় স্পিন কার্যকর হতে শুরু করে। অসময়ে ভেল্কি দেখাতে শুরু করেন মিরাজ-তাইজুল। এদিন মিরাজ ছিলেন বেশ খরুচে। আরও দুটি উইকেট দখলে নিলেও সবমিলিয়ে ৪৯ ওভারে ৩ উইকেট পেতে খরচ করেছেন ১৭৪ রান। অভিষেক হওয়া বাঁহাতি স্পিনার সানজামুল সবচেয়ে বেশি রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকার লজ্জার বিশ্বরেকর্ড অবশ্য করতে পারেননি। তিনি ৪৫ ওভারে ২ মেডেন দিয়ে ১৫৩ রানে নেন ১ উইকেট। শেষ মুহূর্তে স্পিনারদের ভেল্কি শুরু হয়েছে আর তখন যা করার প্রয়োজন ছিল তা করে ফেলেছে শ্রীলঙ্কা। এরপর বাংলাদেশের বিপক্ষে লঙ্কান স্পিনারদের ভেল্কি শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু থেকেই। রঙ্গনা হেরাথ, লক্ষণ সান্দাকান ও দিলরুয়ান পেরেরা ১টি করে উইকেট নিয়েছেন। সবমিলিয়ে চতুর্থদিন স্পিনারদের ঝুলিতে অসময়ে ভেল্কি শুরু হয়ে জমা পড়েছে ৯ উইকেট।
×