ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহের নাট্যযাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ময়মনসিংহের নাট্যযাত্রা

যুবতী কন্যা সোনাই আর যুবক মাধবের মধ্যে পরিচয়-প্রেম-মিলন এবং তাদের মাঝে দাবানল রূপী দেয়া-নেয়ার লালসায় জর্জরিত সোনাইয়ের আত্মাহূতি এবং আমৃত্যু মাধবের বিরহ যন্ত্রণার লোকগাথা ময়মনসিংহ গীতিকার এক সমৃদ্ধ অংশ। এই সমৃদ্ধ অংশকে কেন্দ্র করে চার-চারটি যাত্রাপালা রচনা করেন যাত্রা সম্রাট ব্রজেন্দ্র কুমার দে। এর মধ্যে সোনাই দীঘি যাত্রাপালার উদ্বোধনী মঞ্চায়নের ঘোষণাপত্র তথা লিফলেট বিতরণ করা হয় অবিভক্ত ভারত বর্ষের আসাম-কলকাতা-বিহারজুড়ে হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে। ময়মনসিংহ গীতিকা আশ্রয়ী পদাবলী যাত্রা সোনাই মাধব মঞ্চে এনেছেন রচনা নির্দেশনা এবং অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বর্তমানের শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং লোকনাট্য দলের প্রাণপুরুষ লিয়াকত আলী লাকী। সোনাই মাধব এখন দেশ জয় করে অগ্রসরমান বিদেশ বিভুঁইয়ের আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে। ময়মনসিংহের যাত্রা-নাটক-সাহিত্য যেমন ঐতিহ্যগতভাবে সমৃদ্ধ তেমনি ইতিহাসেও তার অবদান কার্য কারণেই স্মরণীয়। যেমন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমায় মঞ্চস্থ ব্রজেন্দ্র কুমার দে রচিত, রত্মেশ্বর চক্রবর্তী নির্দেশিত, মিলন কান্তি দে সম্পাদিত, বাবুল অপেরা প্রযোজিত দেশপ্রেমমূলক যাত্রাপালা ‘চাঁদ সূলতানা’য় উচ্চারিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের আকাক্সক্ষা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র দুদিন পরেই অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ময়মনসিংহের টাউন হলে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ আকরাম আলীর রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘সংগ্রাম চলবেই’। মোতাহের হোসেন বাচ্চুুর নিরলস পরিশ্রমের সমন্বয়ে ¯েœহাশীষ, নীহারেন্দু, গীতাসহ এক ঝাক অভিনেতা-অভিনেত্রী এ নাটকে অভিনয় করেন। যুদ্ধের দৃশ্যে সদ্য ফেরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের রাইফেলের গুলি ফুটিয়ে লাইভ আবহ তৈরি করেন। দাবিদার আর কেউ না থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নাটক মঞ্চায়নের দাবিদার ময়মনসিংহ স্বগৌরবে হতে পারে। ময়মনসিংহের গৌরব যেখানে ঐতিহ্যগত সেখানে ময়মনসিংহে বর্তমানে আধুনিক নাট্যযাত্রার গতিপথ ঠিক কি রকম তার আত্মানুসন্ধানের শিরোনাম ময়মনসিংহের নাট্যযাত্রা। ময়মনসিংহের নাটক প্রদর্শনের স্থান মূলত শিল্পকলা একাডেমি, টাউন হল, মুসলিম ইনস্টিটিউট এবং বছরব্যাপী উৎসব আয়োজনের স্থানকে ঘিরে। প্রদর্শনের অবয়ব প্রসেনিয়াম এবং এ্যারিনার ফিউশানের আদলে। অংশগ্রহণের পরিধি ময়মনসিংহ, হালুয়াঘাট, ত্রিশাল, গৌরীপুর, নেত্রকোনা, বারহাট্টা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ভারত-নেপাল-ভুটানের নাট্যোৎসব অবধি। নাট্যদলগুলোর নিজস্ব গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সহায়ক শক্তি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, ময়মনসিংহ থিয়েটার এ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ পৌরসভাসহ সব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গের সীমাহীন সংযুক্তি। যুক্তি-তর্ক-বিতর্কের অবকাশ থাকা সত্ত্বেও মোটামুটিভাবে কয়েকটি নাট্যদল তাদের প্রযোজনা এবং মাসে একটি দুটি মঞ্চায়ন সত্ত্বেও নিয়মতভাবে যারা তাদের কাজ নিয়ে দর্শকদের সামনে, তাদের মধ্যে অন্যতম বহুরূপী নাট্যসংস্থা, বিদ্রোহী নাট্যগোষ্ঠী, ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংস্থা, ময়মনংিহ লোক কৃষ্টি সংস্থা, অনসাম্বল থিয়েটার, ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, কম্পাস, সারেং থিয়েটার, মুখোশ নাট্যসংস্থাসহ আরও বেশ কয়েকটি দল। বর্ণমালার চোখে জল, শাস্তি, ১৯৭১, বৈরাম খাঁ অতঃপর, বাত্তর, মাস্তান সুন্দরী জ্যোৎ¯œা, কোর্ট মার্শাল, কোকিলারা, ক্ষেপা পাগলার প্যাচাল, এখনও ক্রীতদাস, বিবিসাব, রক্তাত্ব বর্ণমালা, এখন দুঃসময়, বন্ধু তোমায় পেয়েছি সহ অন্যান্য অনেকগুলো নাটক দলগুলোর নিয়মিত প্রযোজনা। বহুরূপী নাট্যসংস্থার প্রাণপুরুষ শাহাদাত হোসেন খান হীলুর নির্দেশনায় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নাটক ‘মাস্তান সুন্দরী জ্যোৎ¯œা’ তে ময়মনসিংহের মঞ্চায়নে সাদা আলো রঙিন আলোর জগতে প্রবেশ করল, অনসাম্বল থিয়েটারের প্রাণভোমরা মোঃ আবুল মনসুরের নির্দেশনায় এস এম সোলায়মানের কোর্ট মার্শাল শততম মঞ্চায়নের সাক্ষী হলো, মুখোশ নাট্যসংস্থার তেজঃদীপ্ত মুখাবয়বের মোঃ আবদুল হক শিকদার ময়মনসিংহ পৌরসভার মাননীয় মেয়র মোঃ ইকরামুল হক টিটু এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলকে সহযাত্রী করে পরপর তিনবার সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নির্মল যাত্রা উৎসব উদযাপনের সফল কৃতিত্বে অধিকারী হলেন, বিদ্রোহী নাট্যগোষ্ঠীর শাহ মোঃ আলী আজহার (আজহার হাবলু) তাঁর বিদ্রোহী সত্তায় মাননীয় মেয়র মহোদয়ের কাছ থেকে মহড়া কক্ষ বরাদ্দের অধিকার আদায়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেন। ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংস্থার কর্ণধার শরীফ মাহফুজুল হক আপেল বরাবরের মতো কায়াকেই কটাক্ষা করলেন, যোগ্য মানুষের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হলো না বলে। হলো না বলে যে হবে না এমন কথা ময়মনসিংহের নাট্য ও যাত্রা ব্যক্তিত্বরা কেউই ভাবছেন না। এক প্রজন্ম অপর প্রজন্মের জন্যে নিজেদের নিঃশেষ করে যায় সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণের স্বার্থে যেমনিভাবে তাঁদের নাটক-যাত্রা চর্চা মানুষের মনে বক্তব্য ও বিনোদন পৌঁছে দেবার স্বার্থে। অনেক পাওয়া না পাওয়ায় তারা ব্যথিত নয় বরং কিছু না কিছু যে দিতে পেরেছেন সেখানেই সান্ত¦না। তবে পাওয়ার প্রশ্ন যদি সত্যিই আসে তবে ময়মনসিংহের নাট্যমোদীদের একটাই চাওয়া, বিশ্বনাট্য দিবস যদি থাকতে পারে তবে তো জাতীয় নাট্য দিবসও থাকতে পারে। আর সেটা যদি পারে তবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ প্রথম মঞ্চায়নের যে গৌরবের অধিকারী, সেই গৌরবের দিবসটিই হোক জাতীয় নাট্য দিবস। ময়মনসিংহ স্বীকৃত হোক জাতীয়ভাবে স্বগৌরবে, নাট্যকর্মী ও নাট্যানুরাগীদের হৃদয় থেকে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে।
×