ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৩৯ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮

ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৩৯ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট আয় হয়েছে ২৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় শতাংশ বেশি এবং পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৭৯ শতাংশ। অর্থাৎ এর আগে কোন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের এত বেশি আয় হয়নি। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে মোট আয় হয় ৩৯ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। আগের বিক্রি থেকে এই সময়ে ৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা সুদসহ মোট পরিশোধ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ নিট আয় দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই খাত থেকে সরকার নিট আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তবে ২৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৮৬ কোটি বেশি। ওই সময় এই আয় ছিল ২৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই খাত থেকে আয় হয় ১৩ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে আয় বাড়ে ৭৬ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সাধারণত আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধের পর যে পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকে, সেটাই হচ্ছে নিট বিনিয়োগ। বিনিয়োগের ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নে ব্যয় করে। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতিমাসে মুনাফা দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০,১৫০ কোটি টাকা। তবে প্রবণতা বলছে অর্থবছরের ছয় মাসেই ছাড়াবে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা। গত অর্থবছরের বাজেটে ১৯,৬১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৫,০০০ কোটি টাকা। চাহিদার কারণে শেষ পর্যন্ত বিক্রি দাঁড়ায় ৭৫,০০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। চলতি বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। তার মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের লক্ষ্য ধরা হয় ২৮ হাজার ২০৩ টাকা। আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বিশ্লেষণ ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক আমানতে সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। আর বিভিন্ন মেয়াদী সঞ্চয় প্রকল্পের সুদহার প্রায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ। এই হিসাবে সঞ্চয়পত্রে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া সরকারী এফডিআর এ সুদ হার কমে গেছে। এসব কারণে মানুষ ব্যাংকে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। সে জন্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। তুলনামূলক বেশি মুনাফা পাওয়াই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের এই উল্লম্ফনের প্রধান কারণ মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। তা ছাড়া নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাওয়াটাও একটি বড় কারণ বলে তারা মনে করছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, মূলত ব্যাংকের আমানতের সুদহার কমে যাওয়ার কারণেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ায় সামাজিক কিছু সুবিধা থাকলেও সরকারের সুদ পরিশোধজনিত ব্যয় চাপ বাড়ে বলেও উল্লেখ করেন অর্থনীতির এই গবেষক। তা ছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ কমে যাওয়ায় বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কমে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি থাকায় স্বল্প আয়ের লোকজন ও অবসরে যাওয়া বৃদ্ধরা এক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছে। সেই দিক থেকে সুদ ব্যয় বাড়লেও এটা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের সীমা সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দেশী-বিদেশী উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটায় সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আগে বেশি ঋণ আসত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এখন বেশি ঋণ আসছে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে। ব্যাংকবহির্ভূত উৎসের মধ্যে রয়েছে এই সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য কিছু বন্ড। ২০১২-১৩ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ৭৭৩ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ আসায় পরবর্তী অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু পরের অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের উল্লম্ফন দেখা দেয়। সূত্র মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে লক্ষ্য ছিল ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট আয় হয় ১১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এর তিনগুণেরও বেশি ২৮ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা আয় হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে ১৫ হাজার কোটি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বছর শেষে আয় হয় ৩৪ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বছর শেষে ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা নিট আয় হয়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে। ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে কমিয়ে আনা হয় ২ শতাংশ। এরপরও বর্তমানে ব্যাংক আমানতে সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদহার ১১ থেকে ১২ শতাংশের কাছাকাছি। বর্তমানে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে সুদ পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদী মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। এছাড়া তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়।
×