ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

অতীশ দীপঙ্করের গ্রামে...

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

অতীশ দীপঙ্করের গ্রামে...

অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী এলাকায় আটশ’ থেকে বারশ’ বছর আগের বৌদ্ধ স্তূপের সন্ধান মিলেছে। এটাই দেশের বৃহত্তম বৌদ্ধ নিদর্শন। বলেছেন প্রতœস্থান খননকারী দলের প্রধান সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। এর আগে তার নেতৃত্বে সফল খনন হয়েছে উয়ারি বটেশ্বরে প্রাচীন দুর্গ নগরের। যা বাঙালী সংস্কৃতির আড়াই হাজার বছরের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করেছে। এতকাল চালু থাকা ‘হাজার বছরের’ বাঙালী সংস্কৃতির ধারণা আমূল উপড়ে মাটি খুঁড়ে তারা বের করেছিলেন আড়াই হাজার বছরের পুরনো বাঙালী সংস্কৃতির নিদর্শন। একেবারে তথ্য প্রমাণসহ। বাংলাদেশের ভূমি পলিমাটিতে গঠিত বলে এখানে সভ্যতার বিকাশ অল্পদিনের প্রচলিত এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করেছে প্রতœতাত্ত্বিক উয়ারি-বটেশ্বর। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতœতত্ত্ব বিভাগের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার চক্রবর্তী এ নিদর্শনকে মহাজনপদ সময় বা সমতট জনপদের সমসাময়িক বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এমনকি এখানকার প্রতœবস্তুগুলোর ব্যাখ্যায় এতদিনের ধারণা সমতট অঞ্চলের সময় পঞ্চম খ্রিস্টাব্দকেও অতিক্রম করতে পারে বলে তিনি ধারণা করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিককার রাষ্ট্র মহাজনপদগুলো বিকশিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকে চার শতকের মধ্যে। অনেক মহাজনপদ ছিল এখানে। সমতট তার একটি। প্রতœতাত্ত্বিকদের ধারণা উয়ারি-বটেশ্বর মহাজনপদের অংশ ছিল এবং এখানে গঙ্গা ঋদ্ধি জাতি বাসকরত। অনেক রিচুয়ালের নিদর্শন পাওয়া গেছে, যার বেশির ভাগকে বৌদ্ধধর্মের অনুষঙ্গ বলে ধারনা করা হয়। এবার টিম সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের খননে উঠে এসেছে দু’টি বৌদ্ধ বিহার একটি ম-প এবং একটি পঞ্চস্তূপ। খনন কাজ শুরু হয় দু’হাজার তের সালে। পাঁচ হাজার বর্গমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে এ কাজে যুক্ত ছিলেন প্রায় চল্লিশজন প্রতœতাত্ত্বিক। বৌদ্ধ শাসনামলে বাংলার রাজধানী ছিল বিক্রমপুর এলাকা। এর সপক্ষেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। সড়ক, পয়োনিস্কাশন ব্যবস্থাসহ অনেক স্থাপনারও সন্ধান মিলেছে এখানে। এর আগে দেশের সবচেয়ে বড় স্তূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল কুমিল্লার ময়নামতিতে। তবে এবারের প্রতœনিদর্শন শুধু আকারেই বড় নয় বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও আলাদা। এর নকশা পিরামিডের মতো। জানিয়েছে খননকারী দল। চীনের রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়া প্রতœতাত্ত্বিক চাই হুয়ান বোর নেতৃত্বে আঠার জন চীনা প্রতœতাত্বিকদের একটি দলও এ খনন কাজের সঙ্গে ছিলেন। মাটি খুঁড়ে ইতিহাস বের করার কাজটি যে শুধু ক্লাস রুমে পাওয়া তত্ত্বের প্রায়োগিক চর্চা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অনুগত এক স্বপ্নময় ভালবাসা ও দুর্দান্ত আবেগÑড. রহমানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর এ কথা মানতেই হয়। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়া এবং প্রতœতত্ত্বের মতো বিষয়কে সহজে উপস্থাপন করার ক্ষমতাই হয়ত পারিপার্শ্বিকতাকে তার অনুকূলে আছে। তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি আশা জাগায়Ñসাফল্যের পথে আরও অনেক দূর হাঁটবেন তিনি। তবে চলার শুরুটা সহজ ছিল না। সে কথা বলেছিলেন উয়ারি বটেশ্বরের সফল খননের পর, ‘আমাদের আবিষ্কার ও গবেষণার ফলাফল নিয়ে এক শ্রেণীর প্রতœতাত্ত্বিক, অধ্যাপক, গবেষক সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেন। তাঁরা উয়ারি-বটেশ্বরে যে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেটা অস্বীকার করেন। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করেন। কেউ বলেন, ইতিহাস পাল্টে দেয়ার ভ্রান্ত আয়োজন, কেউ আমাদের বলেন কপট প্রতœতাত্ত্বিক, কেউ কেউ মুসলিম পূর্ব যুগে চুন-সুড়কির ব্যবহার ছিল না বলে জোর দাবি করেন। এ জাতীয় অনৈতিক ও অসাধু অভিমত যে কোন প্রতœতাত্ত্বিকের প্রত্যয় ও দৃঢ়তাকে ভেঙ্গে দিতে পারত। শুরুতে প্রবল বিরোধিতার মধ্যে আমাদের গবেষণা পরিচালনা করতে হয়েছিল। কিন্তু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রামাণিক তথ্য প্রকাশ হতে থাকলে উয়ারি-বটেশ্বর ইতিহাসে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নেয়।’ উয়ারি-বটেশ্বরে প্রথাগত প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই সাল থেকে হলেও জায়গাটির প্রতœমূল্য প্রথমে উপলব্ধি করেছিলেন হানিফ পাঠান নামে এক স্কুলশিক্ষক। উনিশ শ’ তেত্রিশ সালে মাটির নিচে পাওয়া কিছু রুপার মুদ্রা ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্ব সচেতন হানিফ পাঠানকে কৌতূহলী করে। তাঁর উৎসুক মন খোঁজ পায় আরও অনেক নিদর্শনের। এরপর এ নিয়ে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পর্যায়ের নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর, চীন, মেসোপটেমিয়া ও ভারতে। খ্রিস্টের জন্মের ছয় শ’ বছর আগে দ্বিতীয় পর্যায়ের নগর সভ্যতা শুরু। উয়ারি-বটেশ্বর এ পর্যায়ের নিদর্শন। বগুড়ার মহাস্থানগড়ও। মহাস্থানগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। উয়ারি-বটেশ্বরে প্রথাগত প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শুরু উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই সাল থেকে ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে। এদেশে প্রতœতত্ত্বের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রায় শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন এ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ঘাটন প্রক্রিয়া। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথম থেকে লেগে ছিলেন উয়ারি-বটেশ্বর খনন কাজে। কি অমূল্য সম্পদ আমাদের আছে সে খোঁজ আমরা না রাখলেও অন্য দেশের কৌতূহলী পর্যটকরা রাখেন। ব্রিটিশ এক পর্যটক কনসালটেন্ট বাংলাদেশের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখে মুগ্ধ। তার কথার মূল সুর ছিল, এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আমাদের আছে কিন্তু বাইরের দুনিয়া সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। গরিব, দয়াদাক্ষিণ্য প্রার্থী দেশ হিসেবেই আজও বাংলাদেশের পরিচিতি। আমরা জানাতে পারিনি সে ব্যর্থতা আমাদের। পাশাপাশি এও সত্য, অন্যকে জানানোর আগে নিজেদের জানাটা বেশি জরুরী। আমরা কি আমাদের সন্তানদের নিজেদের দেশ চেনাতে পারছি? বোঝাতে পারছি কি আমাদের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে? গত শতকের বিশের দশকে হরপ্পা-মহেঞ্জদাড়ো আবিষ্কারের আগে সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীনতা স্বীকার করা হতো না। প্রতœতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে সে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। উয়ারি-বটেশ্বরও তেমনি আড়াই হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির সত্যতা প্রমাণ করেছে। এবারের এ আবিস্কারের গুরুত্বও অনেক। একটি দৈনিকে সে কথা বলছেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমানÑ ‘অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি বিক্রমপুর প্রতœস্থান দক্ষিণ-এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ব প্রতœতত্ত্বে জায়গা নেবে। সাম্প্রতিক এ আবিস্কার শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের প্রতœতাত্ত্বিক ইতিহাসে একটি সেরা আবিস্কার’। এ গৌরব ছড়িয়ে যাক পৃথিবীময়। প্রতœনিদর্শনগুলো ঠিকভাবে উন্মোচন ও প্রচার করতে পারলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে তো নিশ্চয়ই, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচিতিও প্রতিষ্ঠিত হবে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নিজের অবস্থান জানা যেমন জরুরী তেমনি রাষ্ট্রেরও দায় থাকে দেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে মেলে ধরে পৃথিবীতে নিজের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করার।
×