ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দিদার হাসান

স্মরণ ॥ নির্ভীক বিচারপতি কেএম সোবহান

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

স্মরণ ॥ নির্ভীক বিচারপতি কেএম সোবহান

আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের বিপন্ন দশায় যিনি সর্বদা বিবেকী বিদ্রোহের ভূমিকা পালন করতেন সেই নির্ভীক বিচারপতি কেএম সোবহানের আজ দশম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) ৮৪ বছর বয়সে তিনি পরপারে যাত্রা করেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা স্মরণ করতে গিয়ে সর্বাগ্রে মনে এলো সম্প্রতি পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার স্বপদে ‘ফেরা না ফেরা’, তিনি ‘সুস্থ না অসুস্থ’ স্বেচ্ছায় ‘ছুটি নিয়েছেন’ নাকি ছুটি নিতে ‘বাধ্য হয়েছেন’, সর্বোপরি তিনি ‘পদত্যাগ’ করবেন’ কি ‘করবেন না’ ইত্যাকার বিষয় নিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী নেতা, বুদ্ধিজীবী-আইনজীবীরা (যার মধ্যে আবার যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে মামলা লড়াইয়ের আইনজীবীও আছেন) যেভাবে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর এবং মাঠ গরমের প্রাণান্তকর অপচেষ্টা করেছেন, তাতে অনেকের মনে হতে পারে বিচার বিভাগ নিয়ে জাতীয়তাবাদীরা কত ‘চিন্তিত’ ও এর ‘সুভাকাক্সক্ষী’! কিন্তু আদতে যে তারা তা নয় তার বড় প্রমাণ প্রয়াত বিচারপতি কেএম সোবহানের প্রতি তাদের ‘ঘোষক নেতা’ সেনা শাসকের অন্যায়-অবিচারের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত। ১৯৮০ সালে বিচারপতি কেএম সোবহান যখন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন ন্যায়নিষ্ঠভাবে তখন দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তাকে বিচারিক দায়িত্ব থেকে অনৈতিকভাবে সরিয়ে পূর্ব জার্মানির বার্লিন এবং চেকোসেøাভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে রাষ্ট্রদূত করে নির্বাসনে পাঠান, যা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। নিজের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জমুক্ত করতে তার এই জঘন্য সিদ্ধান্তে সেদিন হতবাক হয়েছিল সব বিবেকবান মানুষ। কিন্তু সেদিন জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন নির্বিকার, নীরব। প্রসঙ্গান্তরে আরও বলা আবশ্যক যে, দ্বিতীয় সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ তাকে ১৯৮২ সালের জুন মাসে তার পূর্বতন কর্মস্থলে অর্থাৎ আপীল বিভাগে যোগ দেয়ার আদেশ দেন; কিন্তু ১ জুন তিনি কর্মস্থলে যোগ দিতে গিয়ে যোগ দিতে পারেননি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা অপব্যবহার করে এরশাদ ১৬ জুন ১৯৮২ সালে আপীল বিভাগের বিচারিক পদ থেকে তাকে অপসারণ করেন। উল্লেখ্য, বিচারপতি কেএম সোবহান তখন প্রধান বিচারপতি এএফএ মুনিমের পরই ছিলেন জ্যেষ্ঠতার সারিতে। সাতদিনের মাথায় মুনিম সাহেবের অবসরের পরই তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা থাকলেও এরশাদ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তাকে অব্যাহতি দেন। যারা এই নজিরবিহীন ঘটনা জানেন না কিংবা যারা জেনেও না জানার ভান করেন তারা যে জ্ঞানপাপী এবং মিথ্যার স্বর্গে বাস করেন তাতে সন্দেহ থাকে কি? আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিচার বিভাগে যারা অন্যায় হস্তক্ষেপ করে বিচার বিভাগের ওপর কালিমা লেপন করেছেন তাদের মুখে যখন শুনি তারাই নাকি ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের রক্ষাকর্তা’, তখন বলতে ইচ্ছে করে আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও! ভূতের মুখে রাম নাম আর কি! বিচার বিভাগকে কলুষিত করেছে যাদের ‘ঘোষক’ নেতা এবং ‘আপোসহীন’ নেত্রী তারা হচ্ছেন আইনের শাসনের ‘রক্ষক’! হাসব না কাদব! আর এ কি কথা শুনি আজ মন্থরাদের মুখে! বিচারপতি কেএম সোবহান ধর্মান্ধ উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত সব অপকর্মের একজন প্রতিবাদী যোদ্ধা ছিলেন। তার আজীবনের লড়াই ছিল জঙ্গীবাদ এবং মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবাদী অপরাদের বিচারের দাবিতে এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কটের জন্য তিনি জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের দ্বারা দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের যে বর্বরোচিত নির্যাতন-ধর্ষণ করা হয় তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং তাদের সে করুণ নির্যাতনের কাহিনী শুনতে তিনি সমমনাদের সঙ্গে করে যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্যাতিতদের কাছে ছুটে গেছেন এবং তাদের প্রতি সান্ত¡না ও সহানুভূতি এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, এর প্রতিকার ও প্রতিবিধান আশা করেছেন তা তার গভীর মানবতাবোধেরই বহির্প্রকাশ। পরবর্তীতে ঢাকায় যে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার একজন উদ্যোক্তা এবং সহযোগী হিসেবে সেসব নির্যাতনের মর্মন্তুদ কাহিনী তুলে ধরেছেন সে অনুষ্ঠানের একজন অন্যতম সভাপতির ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে। তিনি ১৯৮৬-২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটস হিসেবে নামকরণ করা হয়। বিচারপতি সোবহান ১৯৯০ সালে রোমে স্থায়ী পিপলস ট্রাইব্যুনালের অন্যতম সদস্য ছিলেন ভূপাল গ্যাস কেসের এবং ১৯৯২ সালে ওই ট্রাইব্যুনালেরই একজন সদস্য হিসেবে ওই কেসের রায় প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি ভিয়েতনামের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে এজেন্ট অরেঞ্জ এবং অন্যান্য গ্যাস প্রয়োগের বিচার করেন ওই একই ট্রাইব্যুনালের অন্যতম একজন সদস্য হিসেবে। সেই ঐতিহাসিক বিচারের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনেন। তাছাড়া তিনি ভুটান রিফিউজি সমস্যার তদন্তে আন্তর্জাতিক পিপলস এনকোয়ারি কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৫-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিচারপতি সোবহান কম্বোডিয়ায় ইউএন হিউম্যান রাইটস কমিশনের অধীনে আইন ও বিচার বিষয়ক কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৭ সালে ভিয়েতনাম আইন ও বিচার বিভাগের স্বল্পকালীন পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি নেপাল ও কম্বোডিয়ার সংবিধান প্রণয়নে আন্তর্জাতিক কমিটির একজন সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিচারপতি কেএম সোবহান নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পাকিস্তানের ৩টি নির্বাচনে, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ও আইনসভার নির্বাচনে এবং ৩ বার নেপালের জাতীয় নির্বাচনে। তিনি খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেছেন (১৯৫৬-১৯৭১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা সিটি ল কলেজে। সিটি ’ল কলেজের তিনি একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেএম সোবহানকে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী ও শিশু পুনর্বাসন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করলে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে এবং ’৭৮ থেকে ’৮০ সাল পর্যন্ত সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে সেনা শাসকরা চক্রান্ত করে অন্যায়ভাবে তাকে প্রথমে রাষ্ট্রদূত এবং পরে অপসারণ করেন নিজেদের অবৈধ শাসন চ্যালেঞ্জমুক্ত করতে। অবৈধ সামরিক শাসকদের জন্য বিচারপতি কেএম সোবহান ছিলেন আতঙ্ক। কখন না জানি কোন্ রুল জারি করে বসেন! তাই বিচার বিভাগ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। একথা সত্য, বিচারপতি সোবহান বিচারিক দায়িত্বে থাকলে দুই সেনা শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিতেন, চ্যালেঞ্জ করতেন তাদের অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলকে। বিচারপতি কেএম সোবহান বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন এবং আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনের একজন অগ্রগামী নেতা। ৩১ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। এই নির্ভীক, মানবতাবাদী বিচারপতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×