ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) তবে আমার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশ বেতারে ইংরেজী কথিকা এবং সংবাদ পাঠ করতাম। এই সময় আমার অগ্রজ প্রতিম বন্ধু আমাকে একটি পুরনো গাড়ি ধার দিয়েছিলেন। এ গাড়ি করে আমি রোজ কাক ভোরে শাহবাগ বেতার ভবনে যেতাম। রাতের বেলা গাড়িটি গলির মোড়ে রাখতে হতো। কী আশ্চর্য গাড়িটির কোন যন্ত্রাংশ কখনও চুরি হয়নি। সদ্য স্বাধীন দেশের এই এক চেতনা যেটা আমাকে চমৎকৃত করেছিল। আমি এই সময় আমাদের থাকার উপযোগী একটা বাড়ির খোঁজ শুরু করলাম এবং কী আশ্চর্য পেয়েও গেলাম! আমাদের নতুন ঠিকানা হলো আবার সেই রাজারবাগে। আমার জীবন সংক্রান্ত প্রথম গ্রন্থ ‘সেই অরুণোদয় থেকে’ যাঁরা পড়েছেন তাঁদের স্মরণে থাকতে পারে যে, এই রাজারবাগ পাড়ার একটি বাড়ি থেকেই আমি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। এবারে ‘ছায়ানীড়’ নামে একটি ছিমছাম দ্বিতল বাড়ির দোতলায় আমাদের আবাস হলো। গোছগাছ করে বসতে বসতে এক মাস প্রায় পার হয়ে গেল। অর্থাৎ ততদিনে উনিশ শ’ বাহাত্তরের জানুয়ারির প্রায় শেষে এসে পৌঁছেছি। ওই ভবনটি, ছায়ানীড়, এখন আর নেই। ওইখানে এখন অনেক বহুতল ভবনের সন্নিবেশ ঘটেছে। মাঝে মাঝে ওই পথ দিয়ে যাই, সেই আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগ; তখন মনটা কেমন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনে ছায়ানীড় দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের শুরু ঐ ভবনে মহড়ার মাধ্যমে। প্রথম নাটক বাদল সরকার রচিত ‘বাকি ইতিহাস’ যা মদীয় নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি এই লেখায়। তবে তা আরও পরে। আমার ব্যক্তিগত জীবনেরও একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে এই ছায়ানীড়েই। উনিশ শ’ পঁচাত্তরে আমি বিয়ে করে প্রথম যুগল সংসার পাতি এই বাড়িতেই। আমার নাট্যচর্চা শুরু করার পেছনে একটি নাতিদীর্ঘ প্রাক কথন আছে। বাহাত্তরে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কোন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ আমার বড় প্রিয় সুহৃদ মামুনুর রশিদ আমার বাসায় এসে হাজির। দু’জনে মিলে ছায়ানীড়ের ছাদে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিলাম। আমাদের সব কথাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। যাবার বেলায় মামুন আলতো করে স্মরণ করিয়ে দিলো, আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম যে দেশ স্বাধীন হলে মঞ্চে নাটক করবো। মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিলো। আমরা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি ! (পর্ব-২) বিরাট এক যুদ্ধ শেষে ফিরেছি দেশে। স্বাধীন দেশের নবযাত্রার সুচনায় এখনও থিতু হয়ে বসবার কথা আমলেই নেইনি। স্বপ্নের মতো দিন কাটছে স্বাধীন বাংলায়। কি করব না করব তা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা নেই। কিছুতেই মন বসে না কোন কাজে কি অকাজে। দিন চলছে ভাইয়ার কাছ থেকে প্রয়োজন পড়লেই দু’পাঁচ টাকা ধার করে। কিন্তু অনাদিকাল পর্যন্ত এভাবে তো চলতে পারে না। অতএব, কি করব তা নিয়ে ভাবনা শুরু করতেই হলো। একবার মনে হলো দেশের কাজ করতে হবে। অতএব সরকারী চাকরী করাই ভালো। তথ্য মন্ত্রণালয়ে আধিকারিকের একটি পদ পাওয়া যাবে এমন আশ্বাসও পেয়েছিলাম সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। এখানে আবারও বলে নেয়া ভাল যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজী বিভাগে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যুদ্ধ প্রতিবেদন এবং রাজনৈতিক ধারাভাষ্য লেখা এবং পাঠ করার দায়িত্ব পালন করতাম। এ ছাড়াও যুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রদত্ত ভাষণসমূহের ইংরেজী অনুবাদ এবং পাঠ আর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণসমূহের ইংরেজী তর্জমা পাঠ করতাম। আমার বেতারের পরিচয়ই আমাকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল এবং পরবর্তীতে সরকারে যোগ দেয়ার এক পরোক্ষ সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। অতএব সরকারে যোগ দেয়ার ব্যাপারে যখন প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি এমন সময় একদিন সকালে আমার দুই সহকর্মী, আমার তৎকালীন বাসস্থান আমার ভাইয়ার বাসায় এসে বলল যে যুদ্ধের নয়মাস তারা বেতারে আমার কণ্ঠ শুনত আর ভাবত আমি কবে দেশে ফিরব? এক কথায়, ওরা আমার ফেরার প্রত্যাশাতেই ছিল। আমি ফিরে এলেই আবার কাজ শুরু হবে এশিয়াটিকে। এই কথার কোন জবাব আমার জানা ছিল না। সুতরাং সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ফিরে যাব নিজেরই ঘরে আবার। সেই থেকে এখন অবধি সেই এশিয়াটিকেই আছি। তবে তখন এর নাম ছিল ইস্ট এশিয়াটিক। ইস্ট এশিয়াটিক বলা হতো এই কারণে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে অবস্থিত আমাদের প্রধান অফিসটিকে এশিয়াটিক বলা হতো। স্বাধীনতার পর ওই সীমাবদ্ধতা আর থাকেনি, অতএব আমাদের নতুন নাম এশিয়াটিক। তবে তা আরও পরের ব্যাপার। আপাতত বাহাত্তরের ৮ ফেব্রুয়ারি, সরকারের অনুমোদন নিয়ে প্রশাসক হিসেবে ইস্ট এশিয়াটিকের চাকরি আরম্ভ করলাম। আমরা তখন ছিলাম আটজন। এর মধ্যে ছয়জনই আমার সাবেক সহকর্মী। বাকি দু’জন, ‘অফিস সহকারী’র নিয়োগ দেয়া হলো নতুন করে। এভাবেই পেশায় আমার নব পথচলা শুরু হয়ে গেলো স্বাধীন বাংলাদেশে। যদিও আমার স্বাধীনতা পরবর্তী জীবনে নাটক এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম প্রাধান্য পেয়েছে, আমি মনে করি এর পেছনে আমার মূল পেশা, বিজ্ঞাপন এবং বাজারজাতকরণের কাজ একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আমি এই জীবনে অনেক পাগলামি করেছি। যেই বৈকল্যপ্রসূত কাজকর্ম আমাকে বিভিন্ন সময়ে নানাদিকে নিয়ে গেছে। যেমন, আমি এক সময় গোলাপ ফুলে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠি। ফলে ইস্কাটনে আমার বাসার ছাদে পঞ্চাশটি টবজাত গোলাপের এক সমাহার গড়ে তুলি। এই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন গোলাপপ্রেমীদের সঙ্গে আমার নিত্যই আলাপ হতো এবং আমি তাদের কাছ থেকে গোলাপ বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেছি। গোলাপের বাগান করার সময় শিখেছিলাম যে, এই আকর্ষণীয় পুষ্পটিকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, গোলাপের স্বভাবজাত সৌরভ সমৃদ্ধ পূর্ব দেশীয় যে ফুলগুলো আছে সেগুলো। দ্বিতীয়ত, প্রতীচিত্র সুন্দর দেখতে সুঠামদেহী বড় আকারের গোলাপরাজি। এই দুই ধরনেরই সংমিশ্রণ ঘটেছিল আমার ছাদ-বাগানে। প্রতীচিত্র গোলাপের মধ্যেও প্রকারভেদ আছে। যেমন একেবারে দেশজ সুগন্ধীযুক্ত ক্ষুদ্রাকার গোলাপ আবার উত্তর ভারতীয় মধ্য এশীয় গোলাপ, যেগুলো দেখতে যেমন বড় হয় তেমন সুগন্ধীও হয় সমধিক। এর বাইরেও লতিয়ে ওঠা গোলাপ আছে বিভিন্ন বর্ণের যেগুলো অবশ্য আমার বাগানে স্বভাবতই স্থান পায়নি। মনে পড়ে এই সব গোলাপের নানা রকম নাম : ভ্যালেন্টাইন, তাজমহল, ডায়না ইত্যাদি। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত গোলাপের মধ্যে ছিল পাপা-মিলান্ড, এ্যনা, হার্কনেস, আইসবার্গ ইত্যাদি। আমরা ওই বাড়ি ছেড়ে বেইলি রোডে যখন চলে এলাম তখন ওই বাগানটি সঙ্গে করে আনতে পারিনি। কেননা নতুন বাড়িতে গোলাপ চর্চার উপযুক্ত স্থান ছিল না। এই সময় আমি আলোকচিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে গাড়ি নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে বেরিয়ে পড়া প্রায় নেশার মতো আমায় তাড়া করত। সেই সময় আমার ক্যামেরা এবং পুত্র ইরেশ ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। অনেক ছবি তোলা হয়েছে সেই সব সময়ে। গোলাপে আগ্রহ চলে গেলেও ছবি তোলার আগ্রহ আমার একটুও কমেনি। আগেই বলেছি আমার পেশা বিজ্ঞাপন এবং বাজারজাতকরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরেই কিছুদিন ছোটখাটো চাকরি করে আমি করাচী চলে যাই এবং সেখানে একটি বিদেশী বিজ্ঞাপন সংস্থায় আমি ট্রেনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরিতে যোগ দেই। যদিও তখন আমার যৌবনের শুরু এবং স্বভাবতই অস্থির চিত্তের ছিলাম তবুও, ভাবতে অবাক লাগে যে, আমি ওই একই পেশায় একাধিক্রমে কয়েক যুগ পার করে দিয়েছি। তারপর এক সময় আমি পাকিস্তানের একটি প্রধান বিজ্ঞাপন এজেন্সি এশিয়াটিক এ যোগ দেই। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পরে আমাকে পাঠানো হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এশিয়াটিকের ঢাকা শাখার নাম ছিল ইস্ট এশিয়াটিক। এখানে পূর্ণদ্যোমে কাজ শুরু করলাম ’৬০-এর দশকের শেষ ভাগে। শুরুতে যেমন হয়, পেশার ক্ষেত্রে প্রায় এক ধরনের দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভূমিকা এবং আচরণ, সেই ভাবেই শুরু হয়েছিল আমার পেশাগত জীবন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি এই পেশাটিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। তখন একটা প্রবণতা ছিল যে বিজ্ঞাপন ব্যবসায় প্রতীচ্যকে চোখ বন্ধ করে নকল করা। অর্থাৎ একটি মার্কিন বিজ্ঞাপন ভাল লাগল তো সেটিকে বঙ্গজীকরণ করে চালিয়ে দিলাম। আমি আবিষ্কার করলাম যে এইভাবে অন্ধ অনুকরণ করে আমরা বিজ্ঞাপনের মূল কাজটি থেকে অনেক দূরে সরে আসছি। বিজ্ঞাপনকে ইংরেজীতে আজকাল Communication Business বলা হয়ে থাকে। (চলবে)
×