ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তানভীর আর রহমান

বই ॥ নিমগ্ন পাঠে নিখোঁজের কবিতা

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

 বই ॥ নিমগ্ন পাঠে নিখোঁজের কবিতা

ছোট ভাইটা হচ্ছে ইয়ো ইয়ো টাইপ। বই পড়া হচ্ছে তার কাছে সর্বোচ্চ লেভেলের আলসেমির কাজ এবং সেজন্য তার হাতে আমাকে হেনস্তা হতে হয় প্রতিনিয়ত। আমার বই পেলেই সে সেইটা হাতে নেবে, দু’মিনিটে প্রথম দু’পাতা পড়বে, এবং তারপর সেই পঠিত দু’পাতা থেকে শুরু হবে আমাকে ভেঙানো। যথারীতি বইটা আমার হাতে দেখেই তিনি শিকার হাতে পাওয়া লেপার্ডের মতো উল্লাসে ফেটে পরলেন! আরেব্বাই... আরেক পিস নিয়াসছেন... দেখি এইটা কি জিনিস...। আমি বইটা তার হাতে দিয়ে ভয়ে ভয়ে দুই মিনিট পার হওয়ার জন্য এবং হেস্তেনেস্তে হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সময় কাটতে লাগল। অপেক্ষার সময় বোধহয় ঘোরলাগা হয়। আমিও হয়ত ঘরে চলে গিয়েছিলাম, কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম কে যেন পড়ছে : ‘কেউ জিতে গেলে, কেউ হেরে যায়, কেউ-বা নিরুদ্দেশ, ‘জিততেই হবে’ জীবনের মানে ঘৃণা, ক্রোধ, বিদ্বেষ। কতটুকু জয়ে কতটুকুহার, জীবন জেনেছে ঢের, কোন মাস্তুলে কিস্তি ভেসেছে, বুভুক্ষু নাবিকের!’ আমি চমকে তাকালাম। ছোটভাইটা কাচুমাচু হয়ে বলল : ‘বইটা কিছুক্ষণ পরে দেই ভাই?’ লেখক তার কবিতাগুলোকে বলেছেন প্রায়কবিতা। কিন্তু এই বিষয়টায় আমার ঘোর আপত্তি আছে। আচ্ছা আমরা তো জানি রিখটার স্কেল দিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা পরিমাপ করেন ভূমিকম্পের মাত্রা কতটুকু, তাদের স্কেলের পরিসীমা ১ থেকে ১০, সংখ্যা যত বেশি ভূমিকম্পের মাত্রা তত জোরালো; কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য এমন গজকাঠি কি আছে যা দিয়ে কবিতা মাপা যায়? একটা প্রায়কবিতার বইয়ে কতখানি কবিতা বিদ্যমান কোন বাটখারা দিয়ে এর ওজন করব? ভূকম্পন একটি ‘পরিমাণগত’ বিষয়, একে তাই মাপা যায়, পক্ষান্তরে কবিতা একটি গুণগত বিষয়, একে কি সংখ্যা দিয়ে মাপা সম্ভব? কিন্তু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস বলেছিলেন : ‘বাবৎুঃযরহম পধহ নব রহঃবৎঢ়ৎবঃবফ রহ ঃবৎসং ড়ভ হঁসনবৎং’ অর্থাৎ ‘সবকিছুকেই সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়।’ কাব্যগবেষকগণও তাই অনেকগুলো চলক বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রায়কবিতার বইয়ে- কী পরিমাণ কাব্যগুণ বিদ্যমান তা হিসাব কষার চেষ্টা করেন। ছন্দ, দোলা এবং স্পন্দন নিয়েই রচিত হয় এক একটি কবিতা। এই ছন্দ বা স্পন্দনের প্রকারভেদ, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত। তবে, মাত্রা বিচারের রীতিভেদে ছন্দ পালটে যেতে পারে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখী চালে এই মালা তৈরির প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ এবং বদ্ধস্বর এবং মুক্তস্বর মিলিয়েই তৈরি হয় এসব ছন্দ। কবিতার মূল হচ্ছে তার বিষয়। তারপরেই আসছে শব্দ এবং পরবর্তীতে ফর্মা বা ফর্ম, যাকে আমরা ছন্দ বলি। একটি পরিপূর্ণ কবিতার প্রতিটি লাইন সাজানো হয়, পর্ব, অতিপর্ব এবং উপ-পর্ব দিয়ে এরপর এই লাইনগুলোই প্রথমত উপমা তারপর অনুপ্রাস এবং পরবর্তীতে চিত্রকল্প স্তরে সাজানো হয় তবে এছাড়াও অবিন্যস্তভাবেও এখন শুধুমাত্র শব্দ শরীর দিয়েই একটা কবিতা লেখা হতে পারে। অনেক কবিতাই আছে প্রথমেই চিত্রকল্প এবং সবার শেষের ভাবটা উপমায় ধরা দিয়েছে। আর এসব ভাবলে বলতেই হয়- দুঃখিত প্রিয় সাদাত হোসাইন, আপনি যে প্রায়কবিতা ট্যাগ ব্যবহার করেছেন, তার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। তবে একটা কবিতা নিজের হওয়ার জন্য এতকিছুর প্রয়োজন হয় না, এতকিছু খুঁজতে যাই বলেই হয়ত আপনগুলো দূরে পরে রয় : ‘যার কাছে যাই, ভুল করে যাই, ঠিক পড়ে রয় দূরে, ভাঙ্গা মাস্তুলে, ছেঁড়া পাল তুলে, অচেনা সমুদ্দুরে।’ সাদাত হোসাইনের লেখার সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো, তার কঠিন কথাগুলোও কেন যেন কখনোই দুর্বোধ্য বা দুরূহ মনে হয় না। আর সহজ কথাগুলো যেন আমাদের প্রতিটা স্পন্দনের কথা বলে যায়। ছোট্ট দু’লাইনে যেমন তিনি অনন্ত আবেগ ধরে বলেছেন : ‘আমায় দিয়ো একটুখানি ছুঁয়ে, আমায় দিয়ো একটুখানি মন, এই জনমের জন্মমৃত্যু জানে, তুমি মানেই আমার সমর্পণ।’ এবং তেমনি আরও বড় ক্যানভাসে তিনি এঁকেছেন ক্ষণেক্ষণে বেজে উঠা ছোপ ছোপ অনুভূতি : ‘কতটা কাছে থাকা, কাছে থাকা নয়, কতটা উধাও হলে, পাছে থাকা নয়। কতটা ঘৃণা পুষে একাকী দুপুর হুহু করা কান্নায় ভালবাসা হয়। কতটা বুকের জলে শ্রাবণের মেঘ চুপিচুপি চোখেদের জলে কথা কয়। কতটা বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া নয়, কতটা দূরে যাওয়া, সরে যাওয়া নয়। কতটা ছুঁয়ে দিলে বুকের ভেতর তিরতির কেঁপে ওঠে তৃষিত হৃদয়।’ এই নিখোঁজ আকাশের প্রাণ ছিল ন্যানো কবিতাগুলো। কিংবা বলা যায় এক ঝকমকে যুদ্ধাকাশে কিছু দুর্দান্ত গতির জেটপ্লেন অথবা নক্ষত্র ফোটা আকাশে কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র। হ্যাঁ, কবিতা আমার কাছেও প্রবল দহনে টুপ করে ঝরে পড়া শীতল প্রশান্তির বৃষ্টি ফোঁটার মতন, সহজ জীবনের মতোন, জলের মতোন—যাকে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যায়, মন বাড়ালেই কাছে পাওয়া যায়, ডুবে যাওয়া যায়। আর সেজন্যই এত ভাল লেগেছে : ‘মন খারাপের রাতেই আমি তোমার জন্য লিখি, তোমার জন্য নিয়ম করে একলা থাকা শিখি।’ লেখক তার কবিতাগুলোর কোন নাম দেননি। হয়ত তিনি বলতে পারেন নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির কোন শিরোনাম হয় নাকি! তবুও বলব, কবিতাগুলোয় শিরোনাম থাকলে ভাল হতো। বলতে পারতাম এই কবিতাটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। শিরোনাম নেই তাই বলা হলো না। আর শিরোনাম যেহেতু নেই সূচীপত্র চাওয়াটা তো আরও অমূলক...। ভাল্লাগেনি। পুরো বইটিকে তিনটি ভাগে বিভক্তিকরণ ভাল লেগেছে। নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি, তোমাকে, আয়না; তিনটি ভাগেই ছিল ভিন্ন তিন অনুভূতি। সবচেয়ে ভাল লেগেছে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি, ছোট ছোট অনুভূতিগুলো খুব আপন লেগেছে। আর প্রচ্ছদ? ক্লস ভন ফ্রিলিং-এর আলোকচিত্র অবলম্বনে খন্দকার সোহেলের প্রচ্ছদটা আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে। যেন প্রচ্ছদটাই বলছিল : ‘আমি একদিন নিখোঁজ হবো, উধাও হবো রাত প্রহরে, সরকবাতির আবছা আলোয়, খুঁজবে না কেউ এই শহরে। ভাববে না কেউ, কাঁপবে না কেউ, কাঁদবে না কেউ একলা একা, এই শহরের দেয়ালগুলোয়, প্রেমহীনতার গল্প লেখা।’
×