ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন কান্তি দে

জীবন জীবিকার টানাপোড়েনে যাত্রাশিল্প-২০১৭

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

জীবন জীবিকার টানাপোড়েনে যাত্রাশিল্প-২০১৭

‘যাত্রা-যাত্রা-যাত্রা!’ শীত মৌসুমে ভরাট কণ্ঠের সেই প্রচার আর শোনা যায় না। গ্রাম বাংলার যাত্রা আসরের সেই জৌলুসও এখন আর নেই। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে যাত্রাপালার ঐতিহ্য। অতি সাম্প্রতিককালের এটাই বাস্তবচিত্র এবং এর কোন পরিবর্তন কিংবা উন্নয়ন এ বছরেও দেখা গেল না। যাত্রা একটি পেশাদারী শিল্প। কিন্তু অন্য বছরের মতো অনুমতি সমস্যার কারণে এবারও বিভিন্ন জেলা উপজেলায় যাত্রা প্রদর্শনী বার বার ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ১০৫টির মতো যাত্রাদলকে নিবন্ধিত করেছে। পেশাগত অনিশ্চয়তার কারণে মাত্র ২২ দল সংগঠিত হয়। এগুলোও নিয়মিতভাবে পালা মঞ্চায়ন করতে পারেনি। কখনও কখনও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হলেও সামগ্রিক যাত্রাশিল্পের অচলাবস্থা কাটেনি। বলতে গেলে যাত্রাশিল্পীদের জীবন জীবিকার টানাপোড়নের মধ্যে বছরটি কেটেছে। অবশ্য একেবারে শেষের দিকে হতাশার মাঝে কিছুটা স্বস্তির কথা শোনা যায়। যাত্রাদলগুলোকে অনুদান দেয়ার সরকারীভাবে আশ্বাস দেয়া হয়। এসব জীবন জটিলতা ও আশ্বাসের মধ্য দিয়েই বিদায় নিচ্ছে ২০১৭। উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা : পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে দল মালিকরা এবার নতুন যাত্রাপালা তেমন নামাতে পারেননি। এ তালিকায় মাত্র ৪ পালা রয়েছে- ড. আমিনুর রহমান সুলতানের ‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা’, দেশ অপেরার ‘দাতা হাতেম তা’য়ী’, হারুন-অর-রশীদের ‘বিদ্রোহী নায়ক’ এবং মহসিন হোসাইনের ‘মিরজাফরের আর্তনাদ’। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট স্কুল প্রাঙ্গণে ২৩ ডিসেম্বর ‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা’র দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়। সংগঠিত ২২টি দল পুরনো জনপ্রিয় পালাগুলোই নতুন করে সাজিয়েছে। যেমন আনন্দ অপেরার ‘দেবী সুলতানা’, পারুল অপেরার ‘চরিত্রহীন’, চ্যালেঞ্জার যাত্রা ইউনিটের ‘দস্যু রানী ফুলন দেবী’, সিজার্স যাত্রা ইউনিটের ‘মমতাময়ী মা’, তিতাস নাট্য সংস্থার ‘আনারকলি’, ফরিদা নাট্য সংস্থার ‘রূপবান’, নিউ রংধনু অপেরার ‘মা হলো বন্দি’। এ বছর রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন উৎসবে যাত্রাপালা অন্তর্ভুক্ত হয়। জানুয়ারি মাসে পৌষ মেলায় বাংলা একাডেমিতে দেশ অপেরার ‘আলোমতি প্রেম কুমার’ এবং ডিসেম্বরে তিতাস নাট্য সংস্থার ‘রূপবান’ যাত্রা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও লোকজ মেলায় ‘আলোমতি প্রেম কুমার’, একুশে গ্রন্থমেলা নাট্যোৎসবে শিল্পকলা একাডেমির ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে জয়যাত্রার ‘প্রীতিলতা’, চট্টগ্রামে তীর্যক উৎসবে দেশ অপেরার ‘আমি অমলেন্দু বিশ্বাস’, ২৪ মার্চ ও ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলির মোস্তফা হাকীম ডিগ্রী কলেজে দেশ অপেরার ‘বাংলার মহানায়ক’, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’ এবং নবেম্বরে লোকনাট্য গোষ্ঠীর পরিবেশনায় রাজারবাগ শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালীমন্দির প্রাঙ্গণে ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’ মঞ্চস্থ হয়। উল্লেখযোগ্য ঘটনা : যশোর টাউন হল মাঠে ২ এপ্রিল যাত্রা উৎসব, ঈদে হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’তে শতাধিক যাত্রাশিল্পীর অংশগ্রহণ, জাতীয় নাট্যশালায় ২২ জুলাই প্রবীণ ‘বিবেক’ গৌরাঙ্গ আদিত্যের চিকিৎসা সহায়তায় তরুণ নাট্যকর্মীদের ৯ দিনব্যাপী নাটক প্রদর্শনী, ১৩ আগস্ট বরিশালে, ২১ আগস্ট যশোরে এবং ৩ অক্টোবর ময়মনসিংহে যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতির দাবিতে মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসনে স্মারকলিপি প্রদান, ২৫ অক্টোবর দেশ অপেরার ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও চার গুণী ব্যক্তিকে ‘অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতিপদক’ প্রদান, ৬ নবেম্বর বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদে দ্বি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান, ১৪ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন কমিটির সভায় যাত্রাদলকে অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত, ২০ ডিসেম্বর যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমিতে ‘যাত্রাপালায় বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম’ শীর্ষক সেমিনার এবং ২৩ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ ময়মনসিংহ জেলা শাখার ‘নির্মল যাত্রা উৎসব’ উদ্বোধন। এ বছরের প্রাপ্তি অস্ট্রেলিয়ার মনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী ছাত্র আলমগীর হোসেন এবং কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্জিয়া আক্তারের যাত্রা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ। এছাড়া ২০১৭ সালে আমরা হারিয়েছি প্রবীণ যাত্রাশিল্পী সিরাজগঞ্জের বিনয় চক্রবর্তী, সাতক্ষীরার মুকুন্দ ঘোষ এবং বাগেরহাটের কৃষ্ণা চক্রবর্তীকে।
×