ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষ ফুরায়ে আসে জয়ে পরাজয়ে -জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

বর্ষ ফুরায়ে আসে জয়ে পরাজয়ে  -জাফর ওয়াজেদ

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের সপ্তমবর্ষ এখন বিদায় লগ্নে। যাই যাই ভাব তার। শেষের বেলায় এসে দ্রুততায় ছুটছে। যেন চলে যাওয়ার মধ্যেই তার ইহলীলা সাঙ্গ হবে। চলে তো তাকে যেতেই হবে। কিন্তু পেছনে ফেলে রেখে যাচ্ছে ৩৬৫ দিনের নানা ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত, ত্রাস-সন্ত্রাস, জয়-পরাজয়, আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, সুখ-সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, উন্নয়নের দ্যোতনা, শোক-অশোক আর নানা বিচিত্র বিষয়াবলী। আর ছয় দিন পর বিদায় নেবে ২০১৭ সাল। দরজায় কড়াঘাত নাড়ছে ২০১৮ সাল। যা বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন সময়ের বছর। এই সময়ের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে জাতি হিসেবে অস্তিত্ব, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত থাকা না থাকা, পতাকা খামছে ধরা না ধরার শক্তিমত্তা, স্বাধীনতার ফিরে পাওয়া অর্জনের সুরক্ষা হবে কি হবে না সেসব। বাঙালী জাতির জন্য ভাবাবেগের বছর নয়, বরং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং অর্জিত সুফল ধরে রাখার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বছর। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে অঘটন ঘটানোর মধ্যে যে ভুল সিদ্ধান্ত থাকতে পারে, তা অবশ্যই যাচাই করা না গেলে বড় বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। ২০১৮ সাল বাঙালীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বছর বৈকি। এই বছরই তাকে নির্ধারণ করতে হবে সে কি পঁচাত্তর পরবর্তী পাকিস্তানী দাসত্ব মানসিকতায় দেশকে নিয়ে যাবে, নাকি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত তার প্রাণপ্রিয় স্বদেশকে বিশ্ব দরবারে আরও সগৌরবে দাঁড় করিয়ে প্রমাণ করে দেবে, বাঙালী বীরের জাতি। এই বাঙালী তো একাত্তর সালে গেয়েছিল এবং আজও গেয়ে ওঠে, ‘বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে/আমাদের রক্ত টগবগ জ্বলছে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্যে/আর নাই ভয়/হবে হবে জয়।’ সেই বাঙালী আবার পরাধীনতার পথ বেছে নেবে কিনা, এমন ভাবনা সঙ্গত কারণেই আসে। কারণ বাঙালীকে পরাধীন সময়ে ফিরিয়ে নিতে কত ষড়যন্ত্র, কত কুটিলতার জাল বোনা হচ্ছে, অর্থকড়ি বিনিয়োগ করছে পরাজিতদের সংস্থাগুলো। সেই গুপ্তহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দেশকে যারা ধ্বংস এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চেয়েছিল, গণহত্যাকারীদের ক্ষমতার অংশীদার করেছিল, তাদের প্রতিহত করার বছর বৈকি ২০১৮ সাল। অবশ্য বিদায়ী বছরের রেশ ধরেই এই নববর্ষের আগমন, বিকাশ, বিস্তার ঘটে। ২০১৭ সাল পূর্ববর্তী তিন বছরের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ছিল বলা যায়। কিন্তু আসন্ন বছর কি শান্তির বার্তা বয়ে আনবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। নির্বাচনী বছর। সুতরাং একই অঙ্গে তার অনেক রূপ ঝলকাবেই। শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ, সুষ্ঠু নির্বাচন হোক দেশে এটা সবারই কাম্য। যেমন বছর শেষে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, দল, ভোটাররা এমন পরিবেশেই চেয়েছিলেন, পেয়েছেনও তা। কেন্দ্র দখল, মারামারি, ভোট কেন্দ্রে ভোটার আসতে বাধা দান, জাল ভোট জাতীয় দৃশ্যপট মঞ্চস্থ হয়নি। অতীতেও যেন এসবই হয়ে উঠেছিল ভোটের অনুষঙ্গ। সামনে আবার যেন না হয়, সেই পথ ধরেই সবাই হাঁটবে এমন আশা করা হচ্ছে সর্বমহল থেকেই। কিন্তু সে আশায় বসতি যারাই গড়ছেন, তাদের মধ্যে শঙ্কাও থেকে যায় আশার গুড়ে যদি বালি পড়ে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষপ্রান্তে এসে প্রশ্ন জাগবেই, তাহলে কতদূর এগোলো বাংলাদেশ? স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পার হয়ে দেশটি আজ কোন পথে? পেছন পানে তাকালে স্পষ্ট হবে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নানা দৃশ্যপট। ষোলো কোটি মানুষের দেশে বর্ষশেষে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে আরও প্রশ্ন আসবেই, বিদায়ের পথের বছরটি কেমন কেটে গেল, অর্থাৎ ২০১৭ সাল। আর ছয় দিন পর কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্ত রেখার ওপারে, ২০১৭ সালের শেষ সূর্যাস্তের আলো কালের অতলে নিভে যাওয়ার আগে এসব প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসবেই। আগামী রবিবার রাত বারোটায় দেয়াল থেকে খসে যাবে দিনপঞ্জিকা। চিরতরে হারিয়ে যাবে আরেকটি বছর। বাঙালী জাতি সত্যিই পার করল আরও একটি শুভাশুভ বছর। শেষ সূর্যাস্তের আলোর সামনে দাঁড়িয়ে, কুয়াশার চাদর জড়িয়ে থাকা নিসর্গের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যাবে, তেমন মন্দ কাটেনি। ভালো-মন্দের মাঝে ভালোর চেহারাটা পরিষ্কার দেখা গেছে। এই ভালো-মন্দের দিনগুলো, তার বিশদ বিবরণ বিবৃত হয়ে আসে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় আর টিভির ফুটেজে। মানুষের মনেও তা দাগ কেটে আছে। বছরের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকালে স্বাভাবিকভাবেই মনে দোলাচল জাগবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও/তারই রথ নিত্যই উধাও।’ প্রশ্নটি সঙ্গত। কালের যাত্রা পথেই মানুষের নিত্যদিনের গতিবিধি। মানুষ পৃথিবীতে আসে অতি অল্প দিনের জন্য পঞ্চাশ, ষাট বড় জোর সত্তর আশি বছর তার মেয়াদ। বাংলাদেশে অবশ্য গড় আয়ু বেড়েছে এই সরকারের আমলে, সত্তরোর্ধ। কিন্তু মানুষ এইটুকু সময়ের মধ্যেই তার চারপাশে তুমুল তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। সামান্যটুকু করতে গিয়েও নানা ঝঞ্ঝাট বাঁধায়। লক্ষণীয় যে, মানুষের গতিবিধি, ক্রিয়াকলাপ সবই অতিমাত্রায় সশব্দ। আস্তে-ধীরে, আলগোছে কিছুই করতে পারে না। জলস্রোতের মধ্যে যেমন একটা কলকল রব, জনস্রোতের মুখেও সারাক্ষণ তেমনি একটা কলকণ্ঠ কলরব। কিন্তু এই যে নিরবধিকাল; বিশ্ব সৃষ্টির প্রথমাবধি নিরন্তর চলে আসছে, তার মুখে ‘টু’ শব্দটি নেই। স্বল্পায়ু মনুষ্য নামক জীবটির লম্ফঝম্ফ, তাজ্জব কর্মকা- দেখে অমিতায়ু মহাকাল নিশ্চয় মনে মনে হাসেন। ওই যাকে বলা হচ্ছে মহাকাল বা অন্তহীনকাল তার বলে মানুষের কোন যোগও নেই। অনন্তকালের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ বা টুকরো নিয়ে তার কারবার। সময়ের পরিমাপ করতে গিয়ে মানুষ তাকে দিন, মাস, বছর ইত্যাদি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খ-ে ভাগ করেছে। সবচেয়ে বড় খ-টির নাম শতাব্দী বা শতক। মানুষের জ্ঞাত ইতিহাস, তা-ও খুব বেশি দিনের নয়। হাজার পাঁচ-ছ’ বছরের বেশি নয়। পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এমন একটি শতাব্দী যায়নি যখন যুদ্ধবিগ্রহ, অশান্তি উপদ্রব ঘটেনি। মানুষের উদ্দাম উদ্ধত ব্যবহারের দরুনই কালস্রোত ক্ষণে ক্ষণে উত্তাল হয়ে মানব সমাজের ওপরে আছড়ে পড়েছে। মানুষের আগ্রাসী মনোভাব তাকে শান্তিতে-স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। সতর্ক, বিষম উত্তেজিত, বলতে গেলে উন্মত্ত। এরই ফলে সমাজের শান্তি বিঘ্নিত, দেশকাল বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত। এই একুশের প্রথম সতেরোটি বছর নানা বিপর্যয়, বিপদে কেটেছে। শান্তির লালিতবাণী পরিণত হয়েছে ব্যর্থ পরিহাসে। স্বল্পস্থায়ী স্বল্পপরিসর খ-িত কালের টুকরোটুকু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত বলে অন্তহীন নিরবধিকালের কথা মানুষ জানেও না, ভাবেও না। অস্থিরমতি মানুষের হাতে পড়ে কালের গতিতে কি দুর্গতি ঘটেছে, তা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, কালই যেন পড়েছে কালগ্রাসে। মনুষ্যকৃত কালের এই ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ মূর্তির কথা ভেবেছেন অনেক কবি, সাহিত্যিক। এটা সত্য এবং বাস্তব যে, মানব সমাজ আজ এক নতুন যুগের সম্মুখীন। প্রযুক্তির বিকাশ এবং তার ব্যবহার পুরনো ধ্যান-ধারণাকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধশূন্য দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন নিরঙ্কুশ মানুষ নির্দ্বিধায় যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত। এখন যা নমুনা দেখা যাচ্ছে, মনে হয় পুরো মানুষ নয় ‘হাফ ব্যাকড’ মানুষ, আধা খেঁচড়া করে ছেড়ে দিয়েছে। জন্তু-জানোয়ারের মতো একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ জাতীয় মানুষকে যদি বন্যপ্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে তা কি খুব অন্যায় ব্যাপার বলে মনে হবে কিনা, ভাবার বিষয়। সত্য বলতে কি, মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন। পরাশক্তিগুলোর আচরণ, দেশে বিদেশে তাদের অপতৎপরতা বিশ্বকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সভ্যতাকে বর্বরতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য অনেক দেশ প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কালের গতি অবিরাম। সে চলছে এগিয়ে, মানুষ পড়ছে পিছিয়ে। আশা করা গিয়েছিল, কালের অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের ক্রমোন্নতি হবে; সভ্য মানুষ সভ্যতার হবে। তা হয়নি, বরং বিপরীতটাই হয়েছে। আগের তুলনায় আজকের মানুষ আচারে ব্যবহারে রুচিতে বেশ একটু ‘ইতর’ বলে মনে হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবস্থানকে সে জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। স্বভাবটা হয়েছে স্থূল। চোখের সামনে নানা অবাঞ্ছিত অসহনীয় ব্যাপার ঘটতে দেখেও দিব্যি নির্বিকার থাকতে পারে। আজ বিশ্বময় রব উঠেছে; প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার অবশ্য রক্ষণীয়। ভাবলে নির্যাতিত নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে হাসি পাবে যে, প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা নেই মিয়ানমারে, সেখানে মান রক্ষা বা মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করবে কে? যেখানে নির্বিচারে হত্যাকা-, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ চলছে। শক্তিমান দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারে গণহত্যা, সেনাশাসনের বিষয়ে নির্বিকার। রোহিঙ্গাদের রক্ষার জন্য এবং স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যারা মানবতা, মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দিয়েছে। নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত সমস্যা তীব্র হয়ে উঠলেও এদের ‘পুশব্যাক’ করার মতো নির্মম পথ বেছে নেয়নি বাংলাদেশ। জনসংখ্যারভারে জর্জরিত বাংলাদেশ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভার বেশি দিন বহন করতে পারবে, তা নয়। বনে জঙ্গলে গিয়ে যেমন পশু শিকার করা হয়, তেমনই রাখাইনে গণহত্যা চলছে। জাতিসংঘের কোন প্রচেষ্টাই কার্যকর করা যাচ্ছে না জাতিগত নিধন বন্ধে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গীবাদী ও সন্ত্রাসবাদীরা মানুষ শিকার করে বেড়াচ্ছে। যারা তালেবান, আইএস সৃষ্টি করেছে, তারা বিশ্ব শান্তিকে তছনছ করে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর যে হালহকিকত, তা ক্রমশ জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। যদিও তাদের নির্মূলে সর্বক্ষণ তৎপরতা চলছে। দেশে দেশে রাজনীতি কিংবা রাজ-দুর্নীতিও বলা যায়, এসবের জন্য বহুলাংশে দায়ী। মানুষের উপর দুর্ব্যবহার মানুষই করছে। সোজা কথায় মানুষের মানবাধিকার মানুষই হরণ করছে। মানুষ মানুষের কি দশাই করেছে, ভাবলে দুঃখ, কষ্ট, বেদনার অবধি থাকে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ধকলে বাংলাদেশও পড়েছে। বিদায়ী বছরে প্রবল বর্ষণ আর প্রবল খরা বুঝিয়ে দিয়েছে, সামনে আরও ভয়াবহ দিন আসছে। পরিবেশ দূষণের নিয়ন্ত্রণ সমস্যা বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। সমস্যাটি প্রধানত আধুনিক যন্ত্রযুগের অবদান। দূষণ প্রতিরোধের সামর্থ্য উন্নত দেশসমূহের হয়ত আছে। অনুন্নত দেশে জঞ্জাল এমনিতেই জমে ওঠে, আবর্জনা বর্জন করতে তারা জানে না। তার উপরে আজকের যান্ত্রিক দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা তাদের সাধ্যের অতীত। নিউক্লিয়ার শক্তিবর্গ থেকে থেকে নিউক্লিয়ার পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে গোটা বিশ্বময় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ফলে পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুতে। বিজ্ঞানী বোস কণার আবিষ্কারক সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলতেন, ‘এ রকম চলতে থাকলে বিশ্বের ঋতুগুলো বদলে যাবে; বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা বাড়বে।’ তার নমুনা তো দেখা যাচ্ছে। শীত গ্রীষ্ম বৃষ্টিপাতের মাত্রায় অনেক তারতম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা সম্ভবত মানুষের চরিত্র দূষণ। পরাশক্তিদের দেশগুলোর নেতাদের চরিত্র দূষণের মাত্রা বেড়েছে। মানবচরিত্র দূষিত হয়েছে বলেই পরিবেশ আজ কলুষিত। মনুষ্যসৃষ্ট এ সমস্যার প্রকোপ খোদ বাংলাদেশেও মেলে। সুনীতি-দুর্নীতি এবং সততা-অসততার পার্থক্যও লোকে ভুলে গেছে বলে মনে হয়। সমাজের বৃহত্তর মঙ্গল বিবেচনা হতে বাদ দিয়ে এখন প্রত্যেকে প্রত্যেকের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে। মূর্খতা, অজ্ঞতা, অন্ধতা, গোষ্ঠী মনোবৃত্তি প্রভৃতি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় রাজনীতিকে বারবার একই শনিচক্রের মধ্যে ঘোরানো সম্ভব। বিগত ছেচল্লিশ বছর ধরে তাই চলছে। বারবার শুরু হতে শুরু করার সুযোগ পাচ্ছে মোনাফেক, বাটপার, ধুরন্ধর, প্রতারক, ঠক, জোচ্চোর, টাউট, আরাম আয়েশী ধনী দুশ্চরিত্র শ্রেণীর লোকেরা। এই অবস্থাকেই স্বাভাবিক অবস্থারূপে মানিয়ে নেয়ার জন্য স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী সংবিধানবিরোধী অবস্থান নিয়ে নির্বাচনকালীন অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকারের দাবি তোলে দেশকে বিপন্ন করতে চায়। এদের কারণে দেশের সমস্যার সংখ্যা ও জটিলতা যেমন বাড়ছে, তেমনি সাধারণ মানুষ ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে। ঘটছে সাংস্কৃতিক অধপতন। সাধারণ ক্লাসিক্যাল অপরাধ বৃদ্ধির নেপথ্যে ক্রিয়া করছে এই নীতিহীনতা। পাশাপাশি ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে অবিরত। এরা জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে সহায়ক। এরাও সাম্প্রতিককালে মানুষ হত্যায় নেমেছিল। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, রাজনীতির নীতিগত আদর্শ হচ্ছে, মানুষ যেখানে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেখানে তাকে আপন অধিকারে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। কার্যত পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা মিলে দেশকে ধ্বংসের পথে নিতে চায়। কথিত মানুষেরা যে কতখানি পশুর আচরণ করতে পারে, তার নতুন নতুন পথ, নিত্য উন্মুক্ত করছে। তারা পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা, জীবন্ত দগ্ধ করা, নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট সবই চালিয়েছে। নৃশংসতা, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, জঙ্গীপনা, ধ্বংসযজ্ঞের নারকীয় পথ অবলম্বন করে এক ভয়াবহ অবস্থার তৈরি করেছিল। সরকার যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কারণে এরা পিছু হটেছিল। এদের নীতিহীন রাজনীতি মূলত রাজনীতির চরিত্রহানি ঘটিয়েছে। এদের কারণে মানুষের অধিকার হয়েছে সংকুচিত, সমাজের পরিবেশ হয়েছে দূষিত। আজ তাই প্রয়োজন মনুষ্য চরিত্রের শোধন। মানুষের চরিত্র শোধিত হলে পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে, সংরক্ষিত হবে মানবাধিকার। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের গ্লানিকর অবস্থা থেকে দেশ ক্রমশ মুক্ত হচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। যে ইতিবাচক জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ মুক্তি সংগ্রাম করেছিল, সে চেতনাকে সমাজের সর্বস্তরে দূরীভূত করার পরিবর্তে বরং তার প্রাণশক্তিতে মারাত্মক আঘাত হানা হয়েছে। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। হতাশাজনিত নির্বিকারভাব ব্যাপক হয়ে উঠেছিল। ফলে জাতীয় মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। একটি মৃতকল্প বস্তুর ওপর আধিপত্য করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল একটি শ্রেণী। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। ২০১৭ সালে দেশজুড়ে রাজনৈতিক হানাহানি ঘটেনি যদিও। তবে মৌলবাদের অপতৎপরতা বেড়েছে। সমাজে ধর্মান্ধতা বিস্তার লাভে সচেষ্ট। এসবের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক করা জরুরী। বিদায়ী বছরের শুরুতে এবং শেষে দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারী দল হেরেছে। এই হেরে যাওয়ার নেপথ্য কারণ দলের অন্তর্গত বিরোধ। এই বিরোধিতা ২০১৮ সালের সিটি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিফলিত হলে, তা হবে বিপজ্জনক। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। আর ছয় দিন পর খ্রিস্টীয় নববর্ষ ২০১৮ সালের সূর্যোদয় হবে। নববর্ষের এই সূচনালগ্নে বলা যায়, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আত্মপ্রবঞ্চনা, অগণতান্ত্রিক ও পশ্চাদমুখী প্রবণতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ জরুরী। নির্বাচন বানচালের সকল ষড়যন্ত্রের হোক অবসান। ত্রাস-সন্ত্রাসের দিন যেন আর না আসে ফিরে। জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে। নির্বাচনী জয়-পরাজয়কে মেনে নেয়ার জন্য জনগণকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে দলগুলোর ওপর। আজ ২৫ ডিসেম্বর। শুভ বড় দিন। খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবে প্রার্থনায় যারা মিলিত হবেন, তারা দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করবেন অবশ্যই। সেই প্রার্থনা যেন মঙ্গল ও কল্যাণে ধাবিত করে দেশ ও জনগণকে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যেন চিরায়ত হয়, সেই কামনাও করা হবে। বছরের শেষ পাদে এসে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথকে। ‘বর্ষশেষ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যত বিঘ্ন দূর করো, যত ভয় সরিয়ে দাও, যা কিছু ক্ষয় হবার দিকে যাচ্ছে, সব লয় করে দাও হে পরিপূর্ণ আনন্দ, পরিপূর্ণ নতুনের জন্য আমাকে প্রস্তুত করো।’ কিংবা তার ‘বর্ষশেষ’ কবিতার চরণ স্মরণ করা যায় এই বেলায়, ‘আজি এই বছরের শেষ আয়োজন মৃত্যু, তুমি ঘুচাও গুণ্ঠন/ কত কি গিয়েছে ঝরে জানি জানি, কত স্নেহ প্রীতি/ নিবায়ে গিয়েছে দ্বীপ, রাখে না স্মৃতি।’ জয়-পরাজয়ের বছর ২০১৭ কে আগাম বিদায় জানাই, মহাকালের দিকে তাকিয়ে।
×