ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৯ সালের মধ্যে পুরো উৎপাদন ও সরবরাহ চেন হবে সার্টিফাইড

পাম অয়েলের বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে মালয়েশিয়ার নতুন উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

পাম অয়েলের বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে মালয়েশিয়ার নতুন উদ্যোগ

কাওসার রহমান ॥ পাম অয়েলের বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে মালয়েশিয়া জোড়াল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মালয়েশিয়া প্রতি বছর প্রায় দুই কোটি টন পাম তেল অয়েল উৎপাদন করে। এই পুরো তেল উৎপাদন প্রক্রিয়াকে টেকসই তথা সাসটেইনেবল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য চালু করা হয়েছে মালয়েশিয়ান সাসটেইনেবল পাম অয়েল স্কিম (এমএসপিও)। মূলত নেতিবাচক প্রচারণা ও ভ্রান্ত ধারণার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েল শিল্প নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো এই শিল্পের ব্যাপারে এনজিওদের নেতিবাচক ধারণা ও অভিযোগ। অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, অ-টেকসই বা আনসাসটেইনেবল পন্থায় অয়েল পাম বাগান উন্নয়নের ফলে পরিবেশ দূষণ ও বন ধ্বংস হচ্ছে। মালয়েশিয়ান সরকার এসব অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পদক্ষেপের আওতায় অয়েল পাম আবাদ থেকে শুরু করে তেল উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়কে সাসটেইনেবল করা। মালয়েশিয়ান সাসটেইনেবল পাম অয়েল স্কিম (এমএসপিও) বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ২০১৯ সালের মধ্যে শতভাগ সাসটেইনেবল পাম অয়েল উৎপাদন করা হবে। সাসটেইনেবল পাম অয়েল উৎপাদনের কার্যক্রম দেখাতে মালয়েশিয়ান পাম অয়েল প্রমোশন কাউন্সিল গত নবেম্বর মাসে একদল আটটি দেশের ১১ সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেদারল্যান্ডস, রাশিয়া ও মিসরের এই সাংবাদিকদের অয়েল পাম বাগন, শিল্প ও বনায়ন দেখানো হয়। এ সময় এই আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা দুই দিনের আন্তর্জাতিক পাম অয়েল কংগ্রেস ও প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহণ করে। এই কংগ্রেস ও প্রদর্শনী কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়ায় পাম অয়েল উৎপাদনের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত এই কংগ্রেসে বিশ্বের তেল বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন। আন্তর্জাতিক পাম অয়েল কংগ্রেস থেকে জানা যায়, এনজিওদের নেতিবাচক প্রচারণার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মালয়েশিয়ার পাম তেল নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে। সাসটেইনেবল পাম তেল উৎপাদনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কিছু গাইড লাইন দেয়া হয়েছে। ওই গাইডলাইনেই আছে নানা শর্ত। সেই শর্তগুলো পরিপালন করে তবেই মানসম্পন্ন তথা সাসটেইনেবল পাম তেল উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে ২০১৯ সালের পর ইউরোপের দরজা পাম তেলের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ফ্রান্স এবং নরওয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পাম তেল ভিত্তিক যে কোন উপকরণের ওপর। এখন পাম তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি ঝুলছে পুরো ইউরোপের। তাই মালয়েশিয়ান সরকার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের উৎপাদিত পাম তেলকে সর্বোতভাবে মানসম্পন্ন তথা সাসটেইনেবল করার জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মালয়েশিয়ার পাম তেলের একটি বড় বাজার। পুরো ইউনিয়নে উৎপাদিত পাম তেলের প্রায় ১৫ শতাংশ রফতানি হয়। ভারতের পরই মালয়েশিয়ার পাম তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পুরো ইউনিয়ন বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি পাম তেল রফতানি হয়। এতে আয় হয় ১০ বিলিয়ন রিঙ্গিত। উল্লেখ্য, পাম তেলের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার হচ্ছে চীন। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাম তেলের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে মালয়েশিয়ার সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে পাম তেল উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায় টেকসই করার। এজন্য গঠন করা হয়েছে আলাদা একটি সংস্থা মালয়েশিয়ান পাম অয়েল সার্টিফাইড কাউন্সিল। এই কাউন্সিল অয়েল পাম আবাদ থেকে পাম তেল উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে মান রক্ষার ক্রাইটেরিয়া তৈরি করে তা প্রতিপালণে কাজ করছে। যেখান থেকে সাসটেইনেবল পাম তেলের সার্টিফিকেট প্রদান করা হচ্ছে। এই সার্টিফাইড সাসটেইনেবল পাম অয়েল উৎপাদনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য সহায়তাও দিচ্ছে। যেহেতু অয়েল পাম বাগান তৈরি থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ, ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রদান, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা প্রভৃতি সব বিষয় জড়িত তাই এই এখানে সাসটেইনেবল বা টেকসই শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। আর সবগুলো ধাপ ঠিকমত পাস করে পাম তেল উৎপাদন করতে পারলে তবেই তাকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে মানসম্পন্ন পাম তেলের। এজন্য ওই পাম তেলকে সাসটেইনেবল সার্টিফাইড পাম তেল বলা হবে। ক্রেতার হাতে যখন এই সার্টিফাইড পাম তেল গিয়ে পৌঁছাবে তখন এ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকবে না। এ বছর মালয়েশিয়ায় পাম তেল উৎপাদনের শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। এই একশ বছরে বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে এই তেল। হাটি হাটি পা পা করে পাম শিল্প এখন ১৩০০ কোটি ডলারের বিশাল শিল্প। শুধু মালয়েশিয়াতেই ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে অয়েল পাম আবাদ হয়েছে। এটি পাম তেলের একটি বিরাট অর্জন। এই একশ বছরে মালয়েশিয়ার পাম তেল বিশ্ব বাজারে একটি সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে আবার নতুন করে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে টিকে থাকার জন্য। এই একশ বছরে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পাম শিল্পকে পড়তে হয়নি। তাই মালয়েশিয়া এখন পুরো পাম শিল্পের নতুন রূপান্তর ঘটাতে যাচ্ছে। এজন্য দেশটি একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগুচ্ছে। লক্ষ্যটি হচ্ছে ২০১৯ সালের মধ্যে সব পাম তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সার্টিফিকেটের আওতায় আনা। যাতে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে পুরো পাম তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন হবে সার্টিফাইড। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ৪৭টি প্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। বড় কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য সমস্যা নেই। তারা হয় তো সহজেই উৎরে যাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে ক্ষুদ্র পাম চাষীদের নিয়ে। এই ক্ষুদ্র চাষীদের সার্টিফিকেটের আওতায় আনা খুব কঠিন কাজ। তাদের বুঝানো কঠিন কাজ। বুঝাতে গেলে তারা জানতে চায়, এটা করলে তাদের লাভ কী হবে? তারা কী তাদের উৎপাদিত পামের দাম বেশি পাবে? তা না হলে কেন তাদের ওপর সরকার এই ঝামেলা চাপাতে চাইছে। গত ৪০ বছর ধরে তারা পাম বিক্রি করে আসছে কই এতদিন তো কোন সমস্যা হয়নি। এসব সমস্যার জবাব দিয়ে মালয়েশিয়া সরকার তাদের ক্ষুদ্র চাষীদের ‘গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসের’ আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
×