ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোনায়েম খান

দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা

সময় মানুষের জীবনে এক অমূল্য সম্পদ। যেমন বাউল সম্রাট লালন ফকির বলেছেন, সময় গেলে সাধন হবে না। অসময়ে কৃষি করা মিছামিছি খেটে মরা, গাছ যদিও হয় বীজের গুণে তাতে ফল হবে না। সে সময়েও লালন ফকির বাঙালীর সময়জ্ঞান সম্পর্কে উদাসীনতা লক্ষ্য করেই হয়ত এ ধরনের কবিতা বা লোকসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। বিশ্বের সকল উন্নত জাতি সময় সম্পর্কে খুব সচেতন এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু বাঙালীর গৌরবময় ইতিহাস থাকলেও সময়জ্ঞানের স্বলতা সর্বত্রই পরিলক্ষিত। বাঙালী জাতি তাদের জাতীয় জীবনে একটি বারই সময়জ্ঞানের সঠিক পরিচয় দিয়েছিলেন সেটা হলো ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ করা এবং মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অনুক্ষণেই বাঙালী জাতি সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ না করে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ভোগবাদী হয়ে উঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর দেশ ও জাতি গঠনের যখন প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন ঠিক সেই সময় তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো। তারপর যারা সরকার নিলেন তারা জাতিকে সঠিকভাবে সময়জ্ঞান দিতে পারল না। আসলে পরিবারের সদস্যের চরিত্র দেখে অভিভাবকের চরিত্র অনুমান করা যায়। জীব জগতের জীবনকাল সময়ের ফ্রেমে বাঁধা। মানুষ তার বাইরে না। সময় এবং নদীর ¯্রােত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। শৈশব, কৈশর, যৌবন, পৌড়ত্ব, বার্ধক্যের মধ্যে মানুষের জীবনচক্র আবর্তিত হয়। মানুষের জীবনে প্রতিটা স্তরে সময়ের সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায় মানুষ তার আসল পরিচয়টাও তুলে ধরতে পারে না যে, সে একজন মানুষ। আর কর্মজীবন, সংসারজীবন, সমাজজীবন সব ক্ষেত্রেই সে নানা বিড়ম্বনায় পড়বে। সময়কে হত্যা করা বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম ব্যাধি। এই ব্যাধি বাঙালী জাতিকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জাপানে অফিসে বা প্রতিষ্ঠানে পাহারাদার রাখা হয় অফিস বা প্রতিষ্ঠানে কর্মকালীন সময় শেষ হলে অফিসার বা কর্মীদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য। তাই জাপান এত উন্নত। এক জাপানী বাংলাদেশে পর্যটনে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল বাঙালীরা এভাবে সময় হত্যা করে যা জাপানীরা ভাবতেই পারে না। তবে বাঙালী এক শ্রেণীর সম্প্রদায় সময়ের সদ্ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা হলেনÑ আমাদের মেধাবী ডাক্তাররা, তাঁরা রোগী প্রতি গড়ে তিন সেকেন্ড সময় দিয়ে থাকেন। তাতে রোগী বাঁচুক কিংবা মরুক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনে সময়জ্ঞান নিয়ে একটা জটিলতায় পড়তে হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যে কলেজে শিক্ষা লাভ করেছিলেন শিক্ষাজীবন শেষে ওই কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভ করেন। চাকরিতে যোগদানের পরে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তাঁর ছাত্রজীবনের শিক্ষকরা নিয়মিত কলেজে দেরি করে আসেন। বিষয়টি অধ্যক্ষ মহোদয়ের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াল কিন্তু তাঁর সেসব প্রবীণ স্যারদের কিছু বলতেও পারছেন না আবার সইতেও পারছেন না এমতাবস্থায় তিনি এক অভিনব উপায় অবলম্বন করলেন তা হলো তিনি প্রতিদিন কলেজ টাইমে কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করলেন যে সকল স্যার দেরি করে আসেন একবার তাঁদের মুখের দিকে তাকান আবার ঘড়ির দিকে তাকান। এতে করে কলেজের স্যাররা লজ্জিত হলেন এবং পরবর্তীকালে কলেজের সকল স্টাফ যথাসময়ে নিয়মিত কলেজে আসতে শুরু করলেন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যে পদ্ধিতে তাঁর কলেজের স্টাফদের সময়জ্ঞান দিয়েছিলেন এখন কি তা সম্ভব? আমি বেশকিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এনজিও কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সময়জ্ঞান সম্পর্কে কথা বললাম মোটামুটি সবাই প্রায় একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করলেন যে, বাঙালীর সময়জ্ঞানের প্রচন্ড- অভাব রয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষের মধ্যে বেশি বেশি বৈষম্যের সৃষ্টি করছে এবং মানুষকে আরও সময়জ্ঞানহীন করে গড়ে তুলছে। সময়জ্ঞানের ভিতটা গড়তে হবে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্র। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে সময়জ্ঞানী হয়ে নতুন প্রজন্মকে সময়জ্ঞানে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে মানুষ মৌমাছি ও পিঁপিলিকার সময়জ্ঞান দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আটঘরিয়া, পাবনা থেকে
×