ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পের স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ০৭:২২, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

শিল্পের স্বাধীনতা

৭ নবেম্বর ১৯১৭, সময় বিকেল, স্থান পেট্রোগ্রাড। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের নির্দেশে অঙ্গীকারাবদ্ধ বলশেভিক বিপ্লবী সেনারা অস্ত্রহাতে ধাবিত হচ্ছে উন্টার প্যালেসের দিকে। তাদের বৈপ্লবিক লক্ষ্য কেরেন্সকির নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎক্ষাত করা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের কারাবন্দী করে রাখা। সের্গেই আইজেনস্টাইনের সেই মহান চলচ্চিত্র ‘অক্টোবর’-এর কথা অনুভব করলেই বোঝা যায় ওই দিনের প্রাসঙ্গিক দৃশ্য। যে কোন বিপ্লব ধ্বংস ও রক্ত ছাড়া অর্জিত হয় না। হয়তোবা তাই লেনিন তার বিপ্লবীদের বলেছিলেন : ‘একটি শিল্পও যেন বিনষ্ট না হয় কারণ এই সম্পদ জনগণের।’ লেনিনের এই উক্তি থেকে বোঝা যায় মার্কসীয় ধারায় শিল্পকে জীবনের কত গভীর থেকে অনুভব করা হতো। অথচ বিপ্লবের ৩১ বছর পর ১৯৪৮ সালের ডিসম্বরে পোল্যান্ডের শাসক কমিউনিস্ট পার্টির দফতের এক ধমকের জবাবে বিখ্যাত পেইন্টার ¯্রিিমন্স্কিকে বলতে হয়েছিল : ‘আমি আপনাদের বিরুদ্ধে নই, আমি শিল্প সম্পর্কে আপনাদের থেকে আলাদা ধারণা পেষণ করি।’ এখন প্রশ্ন হলো ¯্রিিমন্স্কিকে কেন এই কথা কমিউনিস্ট পার্টির দফতের এসে বলতে হয়েছিল কিংবা কী অপরাধে তাকে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছিল। প্রসঙ্গ হলো : একদিন ¯্রিিমন্স্কি ছবি আঁকছিলেন হঠাৎ দেখলেন তার ঘরের ভেতরে লাল রঙের আভায় আলোকিত হয়ে গেছে। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে জানলা দিয়ে দেখলেন তার বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে লাল রঙের বিরাট বিরাট কাপড়ের ব্যানার ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। তিনি আলোর জন্য ক্রাচ দিয়ে একটি ব্যানার খুলে দিতেই আবারিত আলো ঢুকে পড়ে তার ঘরে। এই এতটুকু অপরাধে পঙ্গু মানুষটিকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দেওয়া হয়। যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একটি হাত ও পা হারিয়ে ছিলেন। আসলে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্যের সঙ্গে শিল্পের বিকল্প বা মুক্ত ভাবনার বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র, মায়কোভস্কির কবিতা, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির কথাসাহিত্য অর্থাৎ মার্কসীয় ধারার ভেতর ও বাহির থেকে অন্য কিভাবে শিল্পকে প্রগতির পক্ষে দেখা যায়, তিনি সে বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন। অপরাধ সেখানে। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লব সাধিত হবার পর তাবৎ দুনিয়ার শিল্প-সাহিত্যও পরিবর্তন হতে শুরু করে- যার প্রভাব বাংলা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে পড়ে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ¯্রিিমন্স্কি পোল্যান্ডের আভাঁ-গার্দ চিত্রকর। তিনি শিল্পের ভিন্নধারার কাজের জন্য আজও বিশ শতকের শিল্প ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যে পোল্যান্ডে মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করেন। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘দ্য থিয়োরি অব ভিশন’। এছাড়া তিনি পোল্যান্ডের লোদ্জ আর্ট স্কুলের ভীষণ জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ¯্রিিমন্স্কিকে সরকারের রোষানলে পরতে হয়েছিল। সেই সময় সমাজতান্ত্রিক সেনারা ¯্রিিমন্স্কির ন্যাশনাল আইডি কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই তিনি রং ও খাবার কিনতে পারতেন না, এমনকি সিগরেটও নয়। এমনকি শিল্পের সংগঠনগুলো থেকে তার সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছিল। একমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন আপনাকে ট্রামের ধাক্কায় মেরে ফেলা উচিত। না, ¯্রিিমন্স্কিকে ট্রাম ধাক্কা খেয়ে মরতে হয়নি- তিনি না খেতে পেয়ে অবশেষে যক্ষ্মায় মারা গেছেন এই মহান শিল্পী। তার না খেতে পারা এমনই একটি দৃশ্য আমরা দেখতে পাই আন্দ্রে ওয়াইদার ‘আফটারইমেজ’ ছবিতে। যে ছবির দৃশ্যে আছে তিনি খাবারের খালিপাত্র জিভ দিয়ে চাটছেন। শিল্পের ট্র্যাজিডি খুবই নির্মম। আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও বিনয় মজুমদারের কথা ভাবলেই চোখের সম্মুখে ট্র্যাজেডি ভেসে উঠবে। শিল্পের স্বাধীনতা তার ট্র্যাজেডির সঙ্গে যুক্ত, তা বিশ্বের যে কোন দেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রেই সত্য। ¯্রিিমন্স্কির মৃত্যু হয়তোবা সমাজতন্ত্রের জন্য একটি বিছিন্ন ঘটনা কিন্তু একটি ট্র্যাজেডির শিল্প ইতিহাস। শিল্পের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। এখন তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কারণ রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম ও অর্থ পরিপূরক হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। আগে যেটা ছিল সাধারণ নিষ্পেষণ বা আইনী লড়াই এখন তা সরাসরি হত্যা। তাই সম্প্রতি ভারতে ‘পদ্মাবতী’ চলচ্চিত্র নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বলতে শুনি : ‘আমাদের জাতের স্বাভিমানে চুনকালি লেপা হয়েছে, আমাদের দেবী মা পদ্মাবতীকে মন্দিরের পাদপীঠ থেকে নামিয়ে করে তোলা হয়েছে বাহরওয়ালি নাচনি, তাই পরিচালকের মু-ু চাই’। বিষয়টি হল ইতিহাসের সঙ্গে শিল্পের দায়। শিল্প কোন ইতিহাস নয়, ইতিহাস তার ভিত্তি হতে পারে। আমরা তখনই সমস্যা বাধিয়ে বসি যখন শিল্পকে ইতিহাস দ্বারা বিচার করি। শিল্পের যখন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় তখনই শিল্পের মৃত্যু হয়। শিল্প স্বাধীন। তার স্বাধীনতা বহুমুখী, বহুবোধের- সেটা ভেতর ও বাহির থেকে। বলশেভিক বিপ্লবের সঙ্গে শুধু শ্রমজীবী মানুষের সমাজতন্ত্রের বিজয় হয়নি, সেই সঙ্গে বিজয় হয়েছিল মানুষের চিন্তার বোধের বিজ্ঞানের ও শিল্পের কিন্তু সমাজতন্ত্র ধীরে ধীরে তার যৌবন হারাতে বসলে তার উদ্দীপনা কমতে থাকে। বলশেভিক জন্ম দিয়েছিল ম্যাক্সিমর গোর্কির ‘মা’, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ (যদিও তা বিপ্লবের পূর্বের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত), জন রিডের ‘দুনিয়া কাপানো দশ দিক’, আইজেনস্টাইন ও পুদভকিনের চলচ্চিত্র, মায়ারহোল্ডের প্রথা ভঙ্গকারী নাট্য প্রযোজনা, গোগলের কথাসাহিত্য, মায়াকভস্কির কবিতাসহ সারা পৃথিবী অসংখ্য গুণী শিল্পীকে। এই শিল্পই বলশেভিক বিপ্লকে আরো বেগবান ও মহিন্বিত করেছিল। বিপরীতে শিল্পও হয়ে উঠেছিল এককেন্দ্রিক। বিপ্লবের কবি মায়াকভস্কির একটি কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক : ’whose hearts been washed by October storms Won’t need either sunsets or roaring oceans Won’t need climate or natural charms nothing at all, But you- revolution’ এই কবিতাটি তিনি ১৯২৩ সালের ৪ আগস্ট লিখেন এবং কোন শিরোনাম দেননি। এভাবে তিনি আমৃত্যু বিপ্লব নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বিপ্লবের বাইরে তার কবিতা খুব একটা নেই। ঠিক এমনি করে শত শত গুণী শিল্পী শুধু বিপ্লব নিয়েই তাদের শিল্পকর্ম রচনা করেছেন। শিল্পের বহুমুখী বিচারে এটা একটি অন্ধত্ব। এমন অন্ধত্ব আমাদের সত্তর দশকের কবিদের কবিতায় আছে। এই মায়াকভস্কির মতো মহান কবি কেন পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছিলেন, আজও তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেমন উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি জীবনানন্দ দাশ কোন চিন্তা থেকে ট্রামের তলে ঝাপ দিয়েছিলেন আথবা ট্রাম ঝাঁপ দিয়েছিল জীবনানন্দ দাশের উপরে। কিংবা ম্যাক্সিম গোর্কিকে কেন বিপ্লব-উত্তর সভিয়েত ইউনিয়নের সাখালিন দীপে নির্জনবাসে থাকতে হয়েছিল আর কেনইবা লেলিন গিয়েছিলেন তাকে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে মুক্ত করতে। এই প্রশ্নটি আজও মানুষের অন্তরে ঘুরপাক খায়। আর প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে। হয়তোবা এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ তার ‘রাশিয়ার চিঠিতে’ রাশিয়াকে প্রায় স্বর্গদর্শেনের সমতুল্য মনে করেছেন আবার সংশয় প্রকাশ করেছেন তুমুলভাবে : ‘এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই, তা বলি নে- গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপথ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে- কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনও টেকে না- সজীব মনের তত্ত্ব সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কালের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।’ তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আশঙ্কা করছেন- মানুষের মন পুতুল হলে শিল্পের কৃত্রিমতাছাড়া আর কি-বা থাকে। প্রসঙ্গ যদি এমনি হয় তাহলে বলশেভিক শতবর্ষ উদ্যাপন অর্থহীন এবং রীতিমতো বিপজ্জনকও বটে। না, বিপজ্জনক নয় কারণ বলশেভিক বিপ্লবের যেমন ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে তেমনি সেই রাশিয়া এই রাশিয়া মোটেও এক নয়। একটি সমাজতন্ত্র আরেকটি পুঁজিবাদী, শুধু ভূখ- এক। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবের একটি হলো বলশেভিক বিপ্লব, যার সাহিত্য গুণ অসামান্য। বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষের সঙ্গে আমাদের আরেক গুণী রাজনীতিবিদের শতবর্ষ পূর্ণ হলো, তিনি ইন্দিরা গান্ধী। জওহরলাল নেহরু জেলে বসে ইন্দিরার তেরোতম জন্মদিনে এক চিঠিতে লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন : ‘উনিশশো সতেরো সালের যে মাসে তোমার জন্ম, সেই মাসে যুগান্তকারী রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।’ অর্থাৎ ভূ-ভারতে এই বিপ্লবের যেমন প্রভাব পড়েছে তেমনি তার ছায়া সাহিত্যে পড়েছে আরও প্রগাঢ়ভাবে। আমাদের সাহিত্যের দিকপালেদের মধ্যে অন্যতম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সাবিত্রী রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিমলচন্দ্র ঘোষ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, কাজী নজরুল ইসলামসহ আরও অনেক সাহিত্যিকের শিল্পকর্মে বলশেভিক বিপ্লব প্রবলভাবে উপস্থিত। শিল্প ও রাষ্ট্র কখনও পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারে না। শিল্প ব্যক্তিগত অনুভূতি আর রাষ্ট্র সমষ্টিগত। শিল্পের ধারণা থেকে রাষ্ট্র আলাদা, তবে শিল্প হলো যে কোন রাষ্ট্রের প্রাণ। সম্প্রতি ঢাকা লিট ফেস্টে এসে বিশ্ববিখ্যাত কবি অ্যাদোনিস বলেছেন : ‘পৃথিবী যদি সুন্দর একটি ফুল হয় তহলে কবিতা হলো তার সুগন্ধ।’ সুগন্ধ ছাড়া ফুলের নান্দনিকতা যেমেন অর্থহীন তেমনি রাষ্ট্র শিল্পছাড়া অর্থহীন। তবুও রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। এখানেই শিল্পের স্বাধীনতা খর্ব হয়, শিল্পীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। রাষ্ট্র তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গেলেই কখনো কখনও অমানবিক হয়ে ওঠে, এই অমানবিকতার বিপক্ষে যখন শিল্পী তার শিল্প নিয়ে দাঁড়ায় তখনই বিপত্তি ঘটে। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থা চলছে তা এক কথায় ভয়াবহ। এই ভয়াবহ ব্যবস্থায় শিল্পের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব কেন গভীরতর নয়। তার একটি কারণ আমাদের দেশের সাহিত্য দিয়ে যদি বিচার করা হয় তাহলে দেখবেন- বিরুদ্ধ মত মানেই হত্যা, রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, ছোট করে রাখা। যদি আমরা আহমদ ছফার শিল্প ও তার জীবন দিয়ে বিচার করি তহলে শিল্পের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব অনুভব করতে পারব। বাংলা আধুনিক সাহিত্যের সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিপ্লব হচ্ছে তার লিটলম্যাগ। যেখানে লেখক কবি সাহিত্যিকরা তাদের মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটাতে পারে। অথচ সেই লিটলম্যাগ বিপ্লবের আজ কি অবস্থা, কল্পনা করেন। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের বুঝিয়েছে তুমি যদি ব্র্যান্ড না হও তাহলে তোমাকে বেচতে পারবে না। তোমার শিল্প পণ্য হতে হবে। পণ্য হতে হলে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তোমাকে টিকে থাকতে হবে। আর টিকে থাকতে হলে আমাদের কাছে এস। শিল্পের সঙ্গে পণ্যের গভীর কোন সম্পর্ক নেই। তবুও আমরা পণ্য হতে ভালবাসী। আর এই কারণবশত শিল্পের সঙ্গে পুঁজিবাদের ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। এই দ্বন্দ্ব হ্রাস আমাদের পরাধীনতা পরিচয়, আমাদের মেরুদ-হীনতার পরিচয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দক্ষিণ এশিয়ায় যে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলছে- সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিদিনই কোন কোন শিল্পীকে তার শিল্পের মাধ্যমে জেলে যাওয়া উচিত। যেহেতু আমরা জেলে খাটছি না সেহেতু বুঝতে হবে, আমাদের সাহিত্যে বিপ্লবীধারা অব্যাহত নেই; আমরা মেরুদ-হীন হয়ে পড়েছি। আমরা কী আমাদের ভেতর শিল্পকে সেন্সর করছি না? ভেবে দেখুন। না কি বলশেভিক সেই বিপ্লবের সাহিত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মরে গেছে সেই নদী। বলশেভিক বিপ্লবের একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের কথা বলি : ‘ঐড়ি ঃযব ংঃববষ ধিং ঃবসঢ়বৎবফ’ লেখক নিকোলাই অস্ত্রভস্কি (১৯০৪-১৯৩৬)। আমরা এই উপন্যাসটি বাংলা অনুবাদে পেয়েছি ‘ইস্পাত’ নামে। অসামান্য অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্র মজুমদার, সম্পাদনা করেছেন অরুণ সোম, অঙ্গসজ্জায় মেদাত কাগারোড ও প্রকাশ করেছিল রদুগা প্রকাশন। পারিবারিকভাবেই উপন্যাসটি আমার দৃষ্টিগত হয়েছিল কিন্তু পাঠ করেছি ঢাকায় এসে ২০০৬ সালে। এত পরে এসে উপন্যাসটি পাঠ করে নিজেকে অপরাধী মনে হলো, মনে হলো আরও আগে কেন পাঠ করলাম না। উপন্যাসটি লেখকের নিজের জীবন কাহিনী নিয়ে নির্মিত। ট্র্যাজিডিপূর্ণ এই উপন্যাসটি শোকগাথার মাঝে বিপ্লবের আদর্শে রচিত। মানবজীবনে বেঁচে থাকার মানে কি, জীবনের আদর্শ কি, মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার মানে কি ও জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কিভাবে ব্যয় করা উচিত সেসব বিষয় পাঠ করে আমার জীবন সম্পর্কে ধারণা নতুনভাবে মোড় নিল। নিকোলাই অস্ত্রভস্কি বলেছিলেন : ‘বীরত্ব জন্মে সংগ্রামের ভিতর দিয়ে, আর কঠোর অবস্থার ভিতর দিয়ে তার পরীক্ষা হয়।’ তিনি ব্যক্তিজীবনে সেই বীরত্ব ও সংগ্রামের পরীক্ষা দিয়েছেন। রাশিয়ার সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর, এই ১৩ বছর বয়স থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজতন্ত্রের মানে, শিল্পসাহিত্যের মানে। তিনি বালক বয়সেই একটি রেলস্টেশনের রোস্তোরাঁয় কাজ করেতনে। তিনি প্রতিদিন বার থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করতেন কারখানায়। ১৫ বছর বয়সে গৃহযুদ্ধে লড়েছিলেন। এভাবে তিনি ১৯২৪ সালের শেষের দিকে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সেই সেই সঙ্গে দেখা গেল মেরুদ-ের ক্ষয় রোগ ও চোখের অন্ধত্ব। এই অবস্থায়ই তিনি জীবনের এক নতুন মানে খুঁজলেন, লিখতে শুরু করলেন নিজের জীবন নিয়ে ‘Hwo the steel was tempered’। পৃথিবীতে শুরু শিল্পসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায়ের মাঝে তিনি উপন্যাসের নায়ক পাভেল করচাগিনের চিন্তা দিয়ে বলেছেন : ‘যে গাছ তার বলিষ্ঠ শেকড় চালিয়েছে মাটির গভীরে, তার মাথা কাটা পড়লেও গাছ মারা পড়ে না।’ প্রসঙ্গত, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির এই শেকড়ের আদর্শে আমাদের বর্তমান বাংলা সাহিত্য কোথায় আছে। নাকি আমরা বাংলা শিল্পের শেকড়ের আদর্শ ভুলে আমদানি আদর্শ মত্ত। আমাদের শেকড়ের শিল্পের সঙ্গে বর্তমান শিল্পের গভীর দ্বন্দ্ব আছে। এই দ্বন্দ্ব যতটা না শিল্পের স্বাধীনতার তারও বেশি শিল্পীর মজ্জাগত। তাই আমাদের পাঠককুল অতীতচারী। কারণ তারা শিল্পের আদর্শের জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। তাহলে কী আমাদের শিল্পের নিজের স্বাধীনতার সঙ্গে শিল্পী নিজেই দ্বন্দ্ব বাধিয়ে বসে আছে। হ্যাঁ, একদম সত্য। কারণ মহৎ শিল্পের জন্য একজন শিল্পীকে মহৎ হতে হয় মানব কল্যাণের জন্য। তা না হলে কোনভাবেই একজন শিল্পীর পক্ষে মহৎ শিল্প রচনা করা সম্ভব নয়। তাই শিল্পের সঙ্গে যতটা দ্বন্দ্ব রাষ্ট্রের ততটা শিল্পীর নিজের সঙ্গে। মাটির আনেক গভীরের জল যেমন সুপেয় তেমনি জীবনের অনেক গভীরতম বোধই হলো শিল্প। এই গভীরতা শিল্পী তার নিজের ভেতরে খনন করে খুঁজে বের করেন। বাংলা ভাষায় রাশান সাহিত্য যারা আমাদের পরিচয় দিয়েছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য- ননী ভৌমিক, দ্বিজেন শর্মা, হায়াৎ মামুদ, মণি সিংহ, মনজুরুল আহসান খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, হায়দার আকবর খান রনো, এম এম আকাশসহ আরো অনেক গুণী। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক সংবিধানে ‘Freedom of expression'-কে সবসময় গুরুত্ব দেয়া হয়। তবুও কেন যে শিল্পকে রাষ্ট্র তার কাঁচি দিয়ে ছেটে দেয়। হয়তোবা রাষ্ট্র নিজেই সংবিধানের পরিপন্থী হয়ে ওঠে শিল্পের ক্ষেত্রে। তার জন্য বলি হতে হয়- তসলিমা নাসরিনকে, ফ্রান্সের শার্লি হেবডের সম্পাদকদের, ইংলান্ডের সালমান রুশদিকে, ভারতের মুকবুল ফিদা হুসেনসহ অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তারা কেউ থেমে নেই। শিল্পী তার শিল্পের স্বীধনতা উপভোগ না করতে পারলে, তবে যে তার মৃত্যু হয়। আর শিল্পীর মৃত্যু মানেই- মনুষ্যত্বের মৃত্যু, মানব সভ্যতার মৃত্যু। তবে এতটুকু বুঝি : প্রাচীনকালে যদি শিল্পের স্বাধীনতায় রাজা মহারাজাদের নিষেধ থাকত তহলে, অজান্তা ইলোরার স্থাপত্য, গুহার অপূর্ব চিত্র, খাজুরাহসহ অসংখ্য মন্দিরের শিল্পকলা ও তাবৎ পৃথিবীর প্রাচীন মহৎ শিল্পের আবির্ভাব হতে না। কবি গুরু একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি : ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণ তলে দিবস শর্বরী বসুধারে রাখে নাই খ- ক্ষুদ্র করি,’
×