ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় এশিয়ান আরচারিতে অংশ নেয়া ইরানের মজিদ ঘেইদি-পাভিসা বারাচি দম্পতির গল্প

আরচারিতে পরিচয় আরচারিতেই বিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

আরচারিতে পরিচয় আরচারিতেই বিয়ে

রুমেল খান ॥ ‘আমি ভালবাসব তোমায় পাগলের মতো/যতটা ভালবেসে নির্ঝর/পাহাড় হতে’ নদীর বুকে আছড়ে পড়ে/যতটা ভালবেসে মেঘ/বারি হয়ে’ ধরায় ঝরে পড়ে/...তার’চে বেশি।’ এই ধরণীতে সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রেম-ভালবাসা ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু অনেকেই আছে নিজের ভালবাসার মানুষকে কাছে পায় না, পারে না বিয়ে করে ঘর-সংসার করতে। কিন্তু মজিদ-পাভিসার বেলায় এমনটি হয়নি। যদিও হতে পারতো। আর সেটা পাভিসার জন্যই। আগেই বলে রাখি এরা হচ্ছেন ইরানিয়ান আরচার দম্পত্তি। ঢাকায় সদ্য সমাপ্ত এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন। তাদের প্রেমকাহিনী শোনা যাক। ইরানিয়ান তীরন্দাজ মজিদ ঘেইদি। সুঠামদেহী, সুদর্শন। আশেপাশের অনেক মেয়েই তার জন্য ‘দিওয়ানা’। কিন্তু মজিদ তাদের পাত্তাই দেন না। বরং এড়িয়েই চলেন মেয়েদের। ক্যাম্পের সবাই তাকে জানে নারী বিদ্বেষী হিসেবেই। অথচ সেই মজিদই কিনা প্রেমে পড়ে গেলেন (নাকি প্রেমই তার ওপরে পড়লো?)! মেয়েটি তার পরিচিতই, তিনিও এক আরচার। পাভিসা বারাচি। পাভিসার রূপ, নির্মল হাসি, অমায়িক ব্যবহার, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব... সবকিছু যেন পাগল করে তুললো মজিদকে। তবে সমস্যা হলো বয়স নিয়ে। মজিদের চেয়ে পাভিসা দু’ বছরের বড়। নিজের মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করলেন মজিদ। বুঝে ফেললেন হয়তো এ কারণেই পাভিসা প্রত্যাখ্যান করবেন তাকে। শেষমেষ পাভিসার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়েই সান্ত¡না পেতে চাইলেন মজিদ। কিন্তু বিধাতা লিখে রেখেছিলেন ভিন্ন চিত্রনাট্য। পরবর্তী পাঁচ বছরে দু’জনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব জমে উঠলো দারুণভাবে। মজিদের কৌতুক প্রবণতা, সহযোগিতার মনোভাব, দায়িত্বশীলতা, ব্যক্তিত্বে ক্রমশ ঘায়েল হয়ে পড়ছিলেন পাভিসাও। তবে সেটা ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেননি মজিদকে। কথায় আছে ‘মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।’ ডুবে ডুবে জল পান করছিলেন তিনিও! কিন্তু বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হলো কিভাবে? বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দু’জনের সঙ্গে আলাপনে যা জানা গেল তা অনেকটা সিনেমার কাহিনীর মতোই শোনাবে। দু’জনেই বেশ বুঝতে পারছিলেন পরস্পরের প্রতি ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সম্পর্কটা আর শুধুই বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাহলে এখন পরবর্তী করণীয় কী? ‘আমিই প্রথমে সাহস করে প্রেমের প্রস্তাব দিই পাভিসাকে এবং সেটা সিনেমা স্টাইলে, হাঁটু গেঁড়ে! পাভিসা আমাকে নিরাশ করেনি। বললো সেও আমাকে ভালবাসে। কি যে খুশি হয়েছিলাম সেদিন! মনে হচ্ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছি!’ নষ্টালজিক হলেন মজিদ। তার মুখ থেকেই ভালবাসার কথা শোনার জন্য তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো তড়পাচ্ছিলেন পাভিসা। তাই মজিদের কণ্ঠে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ বাক্যটি শুনে সাড়া দিতে এক মুহূর্ত বিলম্ব করেননি। কিছুদিনের মধ্যেই পাভিসার পরিবারের কাছে বিয়ের পয়গাম পাঠালো মজিদের পরিবার। কিন্তু মজিদের (২৮) চেয়ে পাভিসার (৩০) বয়স বেশি। তাই শুরুতে বেঁকে বসলো কন্যাপক্ষ। কিন্তু ‘মিয়া বিবি রাজি তো কি করবে কাজী!’ কাজেই মহাধুমধাম করে শুভ পরিণয় হয়ে গেল ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। আরচারিতে দু’জনেরই ইভেন্ট কম্পাউন্ড। তবে আগে পাভিসার ইভেন্ট ছিল রিকার্ভ। সারাক্ষণ প্রিয়তম স্বামীর কাছাকাছি থাকার জন্য নিজের প্রিয় ইভেন্ট রিকার্ভকে ‘কোরবানি’ দিলেন পাভিসা। তিনিও ইভেন্ট বদলে ফেলে বেছে নিলেন কম্পাউন্ড ইভেন্ট। দু’জনেই একসঙ্গে অনুশীলন করেন তেহরানের একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে। মাত্র দু’মাস আগে বিয়ে হয়েছে। সারাক্ষণই কী ভালবাসা আর অনুরাগে ডুবে থাকা? মাঝে মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয় না? এক গাল হেসে মজিদের ভাষ্য, ‘মাঝে মাঝে ঝগড়া ও মান-অভিমান হয়। সেক্ষেত্রে আমিই আগে সরি বলে মিটমাট করে ফেলি। আমার সঙ্গে ও কথা বললে আমি দুঃখেই মারা যাব। তাই রিস্ক নিই না। আগেই হার মেনে নিই।’ এবার দেখা যাক, দু’জনের আরচারি ক্যারিয়ারপর্ব। জীবন সঙ্গিনীর চেয়ে বয়সে জুনিয়র হলেও তীর-ধনুকের এই খেলায় মজিদই সিনিয়র। আরচারি খেলা শুরু করেন ২০০৫ সালে। দু’বছর পর শুরু করেন পাভিসা। দেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দু‘জনেই জিতেছেন সমান ৩০টি পদক। তবে আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্তিতে এগিয়ে মজিদই। তার ১৫ পদকের বিপরীতে পাভিসার অর্জন ৭ পদক। মজিদের সেরা সাফল্য ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে পুরুষ কম্পাউন্ড দলগত ইভেন্টে তাম্রপদক লাভ। আর পাভিসার এবার ঢাকায় জিতলেন কম্পাউন্ড দ্বৈতে তাম্রপদক (সঙ্গী ফেরেস্তে গিয়েসা)। খেলার সুবাদে বিদেশ ভ্রমণ বেশি করেছেন মজিদ (২৫ দেশে, পাভিসা ২০ দেশে)। মজিদের আদর্শ আরচার তার বাবা ইয়াহিয়া ঘেইদি। তিনিও কম্পাউন্ড আরচার ছিলেন। তার কারণেই আরচারিতে আগমন মজিদের (পাভিসাও এসেছেন ক্রীড়া পরিবার থেকে। তার বড় বোন সামিরা ছিলেন সাঁতারু)। আর পাভিসার আদর্শ আরচার মেক্সিকোর লিন্ডা ওচোভা। দু’জনেই নিজ নিজ ইভেন্টে ইরানের এক নম্বর আরচার। তবে আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে মজিদ যেখানে ৫৫তম, সেখানে পাভিসার অবস্থান বেশ ভাল, ত্রয়োদশ। মজিদের শখ যেখানে স্পোর্টস কার ড্রাইভ করা (একটার মালিক। মজা করে বলেন, ‘বাংলাদেশের যে ট্রাফিক অবস্থা, তাতে করে এখানে এই গাড়ি চালানোর চেষ্টা করা বৃথা!), সেখানে পাভিসার শখ আরচারি এবং শুধুই আরচারি! দু’জনেই চান ধাপে ধাপে এগোতে। আপাতত লক্ষ্য ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান গেমসে স্বর্ণজয়। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দু’জনের বক্তব্যই অভিন্ন, ‘এদেশের মানুষগুলো খুবই হেল্পফুল এবং আন্তরিক। আবহাওয়ায় বায়ুদূষণ সমস্যা আছে। তবে ট্রাফিকের অবস্থা ভয়ঙ্কর। এখানকার খাবার ভালই। তবে কিছু খাবার পেটে সহ্য হয় না। এ জন্য পেট খারাপও হয়েছে। ঢাকায় প্রত্যাশিত রেজাল্ট করতে পারেননি মজিদ, ‘প্রত্যাশা ছিল স্বর্ণপদকের। কিন্তু পাকস্থলী সমস্যার কারণে সেমিতে উঠতে পারিনি। মাত্র ১ পয়েন্টের ব্যবধানে কোরিয়ান প্রতিপক্ষের কাছে হেরে যাই।’ প্রেম-বিয়ে-সংসার... সবই হয়েছে। আগামীতে সন্তান হলে তাকেও কি আরচার বানানোর ইচ্ছা আছে? দু’জনেই একসঙ্গেই জবাব দিলেন, ‘সন্তান তো অটোমেটিক্যালিই আরচার হবে!’
×