ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাংবাদিক জগলুল মারা যাওয়ার তিন বছরেও ঘাতকের বিচার হয়নি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

সাংবাদিক জগলুল মারা যাওয়ার তিন বছরেও ঘাতকের বিচার হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২০১৪ সালের ২৯ নবেম্বর রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সাংবাদিক জগলুল আহমেদ। একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিতে যাওয়ার পথে রাজধানীর কাওরানবাজারে দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় তিনি গুরুতর আহত হন। এরপর হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার মৃত্যুর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ঘাতক সেই চালকের বিচার হয়নি। এ ঘটনায় কলাবাগান থানায় মামলা দায়ের করা হলেও ঘটনার পর পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি খতিয়ে দেখতে সরকার গঠিত ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ফাইলচাপা পড়ে আছে মন্ত্রণালয়ে। ২৯ নবেম্বর বুধবার প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ জগলুল আহমেদ চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় উপস্থিত ব্যক্তিরা প্রসাশনিক কর্মকা-ের গাফিলতির প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভোরের কাগজের সম্পাদক ও সাংবাদিক জগলুল আহমেদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শ্যামল দত্ত। এছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গণমাধ্যমকর্মীরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক জগলুল আহমেদ ছিলেন অসাধারণ হৃদয়ের মানুষ। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বন্ধুবৎসল জগলুলের সঙ্গে দীর্ঘ ৬১ বছর কাটিয়েছি। আজ সে নেই! ভাবতেও অবাক লাগে। দেরিতে হলেও আমরা তার নামে ‘সাংবাদিক জগলুল আহমেদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। এই ট্রাস্টের ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ দিয়ে প্রতিবছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তরুণ সাংবাদিকদের উৎসাহ দিতে আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপর লেখা বাছাইকৃত প্রতিবেদনের উপর তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে পদক প্রদান করব। এছাড়া তার লেখা সকল প্রতিবেদন সংগ্রহের মাধ্যমে একটি বই প্রকাশনার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।’ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে বাল্যকালের বন্ধুর স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও সাংবাদিক জগলুল আহমেদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সভাপতি এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। খাদ্যমন্ত্রী শোকাহত হয়ে বলেন, ‘১৯৫৬ সালে আমরা দু’জনেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তাম। খেলার সঙ্গী ছিল সে আমার। প্রতি রমজানের ঈদের দিন সন্ধ্যায় আমরা বাল্যবন্ধুরা একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। সে চলে যাওয়ার পর আর সেই আড্ডা হয়নি। ওর চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হয়। জগলুল মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রীও চলে গেছেন। তার সন্তানেরাও দেশের বাইরে। ওর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার গলা ভার হয়ে আসছে। খুবই মর্মান্তিকভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। এখনও তার মৃত্যুর বিচার হয়নি, যা সত্যিই প্রশাসনের গাফিলতি।’ স্মরণ সভার প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ সময় স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘জগলুলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের সময়। এরপর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশ, মিছিল ও মিটিংয়ে তাকে পাশে পেয়েছি। তার লেখা সংবাদে প্রথম আমার নাম পত্রিকার পাতায় ওঠে। আমার দিয়ে আমার কোটেশন লিখেছিল জগলুল। আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি বন্ধুসুলভভাবে। সে খুবই বিনয়ী ছিল, সকলের সঙ্গেই খুব ভালভাবে মিশে যেতে পারত। নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সাংবাদিকতার এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছেন, যেখানে সবাই তাকে স্মরণ করেন। তিনি কূটনীতিক ছিলেন না, কিন্তু কূটনৈতিকতার যে আচার-আচরণ বা চর্চা ছিল, সেগুলো তার জানা ছিল। অনুষ্ঠানের সভাপতি ভোরের কাগজের সম্পাদক ও সাংবাদিক জগলুল আহমেদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শ্যামল দত্ত বলেন, আজ থেকে তিন বছর আগে এদিন রাতে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিতে যাওয়ার পথে রাজধানীর কাওরানবাজারে দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় তিনি গুরুতর আহত হন। টানা পনেরো মিনিট রাস্তায় পড়ে থাকার পরও তাকে কেউ তুলেনি। আমাদের শহরের মানুষ এতই ব্যস্ত! এমনকি পুলিশদেরকে মানুষের বন্ধু বলা হলেও আকস্মিকভাবে সেই বন্ধু সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গ্রাম থেকে আসা গাইবান্ধার একটি ছেলে ঢাকায় প্রথম এসেছিলো। সে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল ইস্টার্ন প্লাজা দেখতে। সেই প্রথম জগলুল আহমেদকে দেখে এগিয়ে এসে হাসপাতালে নিতে আগ্রহ পোষণ করেন। এ ঘটনার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে ঘটনাটি ঘটলেও সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি। সেখাকার সব সিসিটিভি ক্যামেরা না-কি নষ্ট। পুলিশ এড়িয়ে গেছে দায়। প্রবীণ সাংবাদিকের অকাল প্রয়াণের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী স্মৃতি ট্রাস্ট নানাবিধ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে বলে জানান তিনি। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামও ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক জগলুল আহমেদের বন্ধু। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করে স্মরণসভায় বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। যে মানুষটি মানুষের বিপদে আজীবন অগ্রদূত ছিলেন, সেই মানুষটির বিপদে কেউ এগিয়ে আসেননি। রাস্তায় পড়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন তিনি। আফসোস! পথচারী তো দূরের কথা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশও তাকে হাসপাতালে নেননি। সে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ছিল। আমরা সব সময় রমনা পার্কে বসে আড্ডা দিতাম। বিশ্ববিদ্যালয় শেষে কাকতালীয়ভাবে আমরা দু’জনেই সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেয়। এরপর থেকে আবার প্রফেশনাল একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রতিটি রিপোর্টের পর প্রশংসা করত, আমিও করতাম। শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরের সংবাদ সংস্থাগুলোতেও একনিষ্ঠ চিত্তে দেশের হয়ে কাজ করেছে জগলুল। ওর মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না।’ স্মরণ সভায় জগলুল আহমেদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত থেকে জগলুল আহমেদ সম্পর্কে আবেগঘন কিছু কথা বলেন। তার বড় ভাই রোকনউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতে সে পছন্দ করত। যখনই সময় পেত এলাকায় বেড়াতে চলে যেত। এলাকার বিভিন্ন মানুষের উপকারে এগিয়ে আসত জগলুল। আমাকে বলত, ‘ভাই আমি কাজে ব্যস্ত থাকি। এলাকার কারও কোন সমস্যা হলে তুমি তাদের খোঁজ নিও।’ এছাড়া সে পরিবারের গরীব আত্মীয়দের সাহায্য করত সব সময়। দেখতে দেখতে তাকে ছাড়াই আমরা তিন বছর কাটিয়ে দিলাম। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি, তবুও তার ঘাতক সেই চালকের এখনও শাস্তি হয়নি। উল্লেখ্য, জগলুল আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বিএসএস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশ্লেষক ছিলেন। প্রায় চার দশক সাংবাদিকতা করা জগলুল আহমেদ সর্বশেষ ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির স্থায়ী সদস্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮-৮৯ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহকারী মহাসচিব ছিলেন।
×