ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নৃত্যশিক্ষকের প্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

নৃত্যশিক্ষকের প্রয়াণ

পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের দেশে নৃত্যকলাকে প্রতিষ্ঠা করা একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় নৃত্যসংগঠকরা। বিশেষ করে রাহিজা খানম ঝুনুর অবদান স্মরণযোগ্য। এই গুণী নৃত্যশিক্ষক, যিনি ‘নৃত্যগুরুমাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, তিনি ঢাকায় রবিবার পরিণত বয়সে মারা যান। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। দেশের নৃত্যাঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে দেশের নৃত্যচর্চার ইতিবৃত্ত। তার অনুপ্রেরণাতে নৃত্যশিল্পের সঙ্গে বাংলার মেয়েরা যুক্ত হওয়া শুরু করেছিল, একথা বলছেন প্রবীণ নারী-নৃত্যশিল্পীরাই। বিভিন্ন প্রজন্মের নৃত্যশিল্পীদের তিনি প্রভাবান্বিত করে গেছেন, এটা ঠিক। রাহিজা খানম ঝুনু ১৯৪৩ সালের ২১ জুন মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। বলাবাহুল্য, পরিবারটি ছিল সংস্কৃতিমনা। প্রয়াত নৃত্যশিল্পীর কনিষ্ঠ সহোদরা ছিলেন দেশের কিংবদন্তিতুল্য সঙ্গীতশিল্পী নীনা হামিদ। ১৯৫৬ সালে ঝুনু নৃত্যে তালিম নিতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাফার প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৬০ সালে বাফা থেকে পাস করে তিনি বাফার নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৮ সালে অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদেশে নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাফা পালন করেছে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তিনি নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী অল্প কথায় যা বলেছেন সেটি প্রয়াত এই শিল্পীকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করাতে ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালী সংস্কৃতিচর্চা ভীষণ কঠিন ছিল, নৃত্যচর্চা তো দুরূহ ব্যাপার ছিল। তারপর মেয়েদের সংস্কৃতি চর্চায় সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় হাজারো বাধা এসেছিল। রাহিজা খানম ঝুনু সেসব প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতা জয় করে নৃত্যচর্চা শুরু করেন। নৃত্যে একটি নতুন ধারা তৈরি করে তিনি সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষার্থী তৈরি করে গেছেন। তার শিক্ষার্থীরাই তার ধারাকে অব্যাহত রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।’রাহিজা খানম ঝুনু তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি পান একুশে পদক। তার পাওয়া উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি সংবর্ধনা, বেনুকা ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা কর্তৃক শ্রদ্ধাঞ্জলি, বুলবুল চৌধুরী স্মৃতি পদক। বলা দরকার, ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর দেশে প্রথম বারের মতো টেলিভিশন সম্প্রচার চালু হয়। টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই তিনি নিয়মিত নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তখন টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশে নৃত্যশিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা শিক্ষাদানের জন্য গুণীজনের সংখ্যাও দুঃখজনকভাবে কমে আসছে। একটি দেশের সংস্কৃতি তথা সার্বিক পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের পাশাপাশি নৃত্যও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে নৃত্যচর্চার পরিবেশ তৈরি ও তার প্রসারে এবং যথাযথ নৃত্যকলা প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই।
×