ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আনু মাহ্মুদ

নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান

ভোলার শাহবাজপুরে নতুন একটি গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। নতুন এ গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মজুদ ৭০০ বিলিয়ন (৭০ হাজার কোটি) ঘনফুট বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামের শাহবাজপুর ইস্ট-১ গ্যাসকূপে এ গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এটি আগের গ্যাসক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত কিনা সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আগের ক্ষেত্রটির সঙ্গে যুক্ত হলে এ গ্যাসক্ষেত্রে বড় আকারের মজুদ থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম বলেছেন, শাহবাজপুরে নতুন গ্যাসক্ষেত্রটির অবস্থান বর্তমানে চালু গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পূর্বে। সাধারণভাবে গ্যাসক্ষেত্রের ব্যাস ধরা হয় এক কিলোমিটার। এ জন্য এটিকে প্রাথমিকভাবে আলাদা গ্যাসক্ষেত্র বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এটি আগের গ্যাসক্ষেত্রটির সঙ্গে যুক্ত কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রটির মজুদ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক এত বড় ক্ষেত্র আর পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে কয়েক দিন ধরেই সেখানে গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছিল। তবে যাচাই করে এ গ্যাসক্ষেত্রের অবস্থান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। প্রাথমিকভাবে এতে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মুজদ রয়েছে বলে ধারণা করছি। আরও যাচাইয়ের পর উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। ২০০৯ সালের ১১ মে ভোলার শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে বাপেক্স। গ্যাসক্ষেত্রটির চারটি কূপের মধ্যে তিনটি থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। তবে এখান থেকে দৈনিক প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন সম্ভব। এ গ্যাসক্ষেত্রে ৩৫ বিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০০৯ সালের দিকে ওই এলাকায় গ্যাসভিত্তিক সাড়ে ৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রেন্টাল বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র চালু হয়। এ ছাড়া ২০১৩ সালে ভোলা সদর উপজেলা পৌরসভার কিছু এলাকায় আবাসিক গ্যাসের সংযোগ দেয়া হয়। ২০১৬ সালে একই উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নে গ্যাসভিত্তিক ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র চালু হয়। জেলার শিল্পায়ন সহজতর হবে দেশে এ পর্যন্ত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোতে মজুদ ছিল ২৭ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে। বিদ্যুত উৎপাদনে, শিল্পে ও পরিবহন খাতেও প্রচুর গ্যাস ব্যবহৃত হয়। বর্তমান হারে ব্যবহৃত হতে থাকলে অবশিষ্ট মজুদ দিয়ে আর বছর ১৫ চলতে পারে। ব্যবহার বেড়ে গেলে মজুদ আরো আগেই শেষ হয়ে যাবে। চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকায় এখন দিনে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকে। তাই গ্যাস রেশনিং করছে সরকার। নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান ও আমদানিতেও নজর দিয়েছে সরকার। এমনই পরিস্থিতিতে ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের তিন কিলোমিটার দূরে টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামের শাহবাজপুর ইস্ট ১ গ্যাসক্ষেত্রে এই নতুন মজুদের সন্ধান মিলেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশনম কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এই মজুদ খুঁজে পেয়েছে। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয় ১৯৯৫ সালে। এবার শাহবাজপুর ইস্ট-১-এর গ্যাসকূপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস মিলল। বাপেক্সের ধারণা, দুই গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের চারটি কূপ থেকে দিনে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব। আপাতত দৈনিক ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ গ্যাসের ওপর নির্ভর করে ২০০৯ সালে সাড়ে ৩৪ মেগাওয়াটের একটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়। ২০১৩ সাল থেকে ভোলা পৌরসভার কিছু এলাকার বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়। গ্যাসের সরবরাহের ঘাটতির মধ্যে এ খবর খুবই আশাব্যাঞ্জক। গত আগস্টে সেখানে কূপ খননের কাজ উদ্বোধন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন মজুদের সন্ধান মিলল। ভোলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ গ্যাস ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। সেখানে ২২৫ ও ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরো দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। নতুন মজুদের সন্ধান পাওয়ায় কেন্দ্র দুটিতে জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা মিলল। দ্বীপ জেলাটিতে দেশি-বিদেশি কম্পানির বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বাড়ল। এখন গ্যাসভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যাবে। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্যাসের নতুন মজুদ ভোলাসহ সারা দেশের জন্যই সুখবর বয়ে এনেছে। সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করুন দেশে চাহিদার তুলনায় কম গ্যাস উৎপাদন হয়। তবে চাহিদা মেটানোর জন্য সরবরারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এজন্য বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালাচ্ছে বাপেক্স। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান মিলল। সাম্প্রতিক এত বড় গ্যাসক্ষেত্র আর পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক ধারণায় যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে তা পাওয়া গেলে চাহিদা অনেকটাই সামাল দেয়া সম্ভব হবে। বর্তমানে শাহবাজপুরের একটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। নতুনটিসহ ওই এলাকার গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রায় এক ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। কিন্তু গ্যাসক্ষেত্র মিললেই সঙ্কটের সমাধান হয় না। গ্যাস অনুসন্ধান করা কঠিন কাজ। আর এর চেয়ে কঠিন কাজ সঠিকভাবে উত্তোলন ও বিতরণ। অতীতে দেখেছি অব্যবস্থাপনার কারণে উত্তোলনকালেই প্রচুর গ্যাস নষ্ট হয়ে যেতে। এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। আমাদের গ্যাসের মজুদ সীমিত কিন্তু চাহিদা অনেক। তাই গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা হতে দেয়া ঠিক না। গ্যাস উত্তোলন যে প্রতিষ্ঠানই করুক না কেন, তারা যেন বিতরণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করতে পারে সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। জানা গেছে নতুন খনি থেকে পাওয়া গ্যাস শুধু বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হবে। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে চলতে পারে না। আবার অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। এখন যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তাহলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের, পক্ষান্তরে দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। গ্যাস উৎপাদন বাড়লে বর্তমানে বিনিয়োগে চলা অচলাবস্থা অনেকটাই কেটে যেতে পারে। অন্যদিকে গ্যাস উৎপাদন থেকে শুরু করে বিতরণসহ সব পর্যায়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে। আমাদের গ্যাস সীমিত। বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকারকে সার্বিক পরিকল্পনা করতে হবে। গ্যাস নষ্ট হয়, এমন কোন কাজ করতে দেয়া যাবে না। গ্যাস জাতীয় সম্পদ। এর সর্বোত্তম আহরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নতুন নতুন গ্যাস আবিষ্কৃত হবে এবং সেখান থেকে লাভজনকভাবে গ্যাস উত্তোলন হবে- এমন সম্ভাবনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা যথেষ্ট বড় কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশি বা বিদেশি কোন প্রতিষ্ঠানই সাফল্যের খবর দেয়নি। জ্বালানি চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ এলএনজি হিসেবে গ্যাস আমদানি করছে এবং এ জন্য টার্মিনাল নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে। ভারত থেকে সীমিত পরিমাণে বিদ্যুত আমদানি করা হচ্ছে। বিদ্যুত উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতাও বিবেচনাধীন। সঙ্গত কারণেই চাই বিদ্যুত ও গ্যাস খাতে নতুন নতুন উদ্যোগ। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারী-বেসরকারী, সব ধরনের উদ্যোগকেই আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যেতে হবে।
×