ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান অবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ লা ইকরাহা ফিদ্দীন

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ লা ইকরাহা ফিদ্দীন

(গত শুক্রবারের পর) সন্ত্রাসীরা কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার কথা বলে লোক জড়ো করে কুরআন তিলাওয়াতরত হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুকে হত্যা করে প্রমাণ করল তাদের মুখে কুরআনের আইনের কথাটা ছিল ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। হযরত রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : প্রত্যেক নবীরই একজন বিশেষ সহচর (রফীক) থাকে। জান্নাতে আমার সহচর হবে উসমান (তিরমিযী শরীফ)। ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু কুফার মসজিদে ফজরের সালাতে ইমামতি করা অবস্থায় আবদুর রহমান নামের এক খারেজী সদস্যের তলোয়ারের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। এই খারেজীরা নিজেদের দলকে সত্যিকার ইসলামী জামাত বলত। এই সন্ত্রাসী দল হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু, হযরত মু’আবিয়া রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু হযরত আমর ইবনুল ‘আস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর বিরুদ্ধে কাফির ফতওয়া দেয়। তাদের স্লোগান ছিল- লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ- আল্লাহর আইন ছাড়া কোন আইন মানি না। হযরত আলীকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন : তোমাকে কেবল মুমিনই ভালবাসবে আর মুনাফিক তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে (তিরমিযী শরীফ)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এই ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণে বর্ণে সত্যে পরিণত হলো। মুসলিম নামধারী মুনাফিক খারিজী সম্প্রদায় হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজ্্হাহুকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি মুতাবিক ৪০ হিজরীর ১৬ রমাদান শুক্রবার ফজরের সালাতরত অবস্থায় তরবারি দিয়ে আঘাত করল। তার কয়েকদিন পর তিনি শহীদ হলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, খারিজীরা ঐ একই তারিখে একই সময়ে মু’আবিয়া রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর হত্যার জন্য বারক নামক এক গুপ্তঘাতককে দামেস্কে পাঠায় এবং ইব্নে বাকর নামক এক গুপ্তঘাতককে পাঠায় ফুসতাতে হযরত আমর ইবনুল আসকে (রাদি.) হত্যার জন্য। দামেস্কের মসজিদে হযরত মু’আবিয়া (রাদি) গুপ্তঘাতকের তরবারির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং ফুসতাতের মসজিদে ঐ দিন হযরত আমর ইবনুল আস (রাদি.) অসুস্থ থাকায় খারিজা ইবনে আবি হাবিবা ফজরের সালাত পড়াচ্ছিলেন, ভুলক্রমে তাঁকেই আমর (রা.) মনে করে গুপ্তঘাতক তরবারির আঘাতে হত্যা করে। এই খারিজী বা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত দলটির প্রেতাত্মারা কারবালায় ইমাম হুসাইন আলায়হিস সালামসহ প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করে। তাদের ছায়া বিভিন্ন যুগে কালো হাত বিস্তার করে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে ইসলামের ইমেজকে বিনষ্ট করার চেষ্টা চালিয়েছে। মুখে ইসলামের বুলি আওড়িয়ে ইসলামবিরোধী অপশক্তির স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েছে। ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের আলামত পর্বত চূড়ায় ঘাঁটি স্থাপন করে হাসান আল সাবাহ গুপ্তঘাতক ভ্রাতৃসংঘ নামে একটা সংঘ গঠন করে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়, তাদের মুখেও ইসলামের কথা ছিল। তারা হিংসাত্মক ও জিঘাংসামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খাঁ এই উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী দলকে সমূলে উৎখাত করেন। যুগে যুগে যেসব অপশক্তি ইসলামের নামে, ইসলাম কায়েমের নামে ইসলামের ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করেছে এবং সেসব অপশক্তি আজও রয়েছে। এরা ইসলামের প্রধান শত্রু, এরা মুনাফিক, এরা ভ- ও প্রতারক। কুরআন মজীদে মুনাফিকদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ হয়েছে : মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী, কিন্তু তারা বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ ও মু’মিনদের তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদের সঙ্গেই নিজেরা প্রতারণা করে তা তারা বুঝে উঠতে পারে না (সূরা বাকারা : আয়াত ৮-৯)। তাদের (মুনাফিকদের) যখন বলা হয় পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না, তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! ওরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী (সূরা বাকারা : আয়াত ১১-১২)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ বিদায় হজের ভাষণে লা ইক্রাহা ফিদ্্দীন- ধর্মে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। কুরআন মজীদের এই আয়াতে কারীমা তিলাওয়াত করে সমবেত সকলকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন : তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। লা ইলাহা ফিদ্দীনÑ কুরআন মজীদের এই বাণীর মাধ্যমে ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্্ বা কিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ)-এর যে বিধান রয়েছে সেটা আত্মরক্ষার জন্য, সন্ত্রাস সৃষ্টি করা বা অন্যায় যুদ্ধ করার জন্য নয়। জিহাদ মূলত সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী বা ফিতনা-ফাসাদকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে বুঝায়। জিহাদের মূল অর্থ হচ্ছে : চেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়। জিহাদ শব্দমূল জুহদ-এর অর্থের সঙ্গে অস্ত্র যুদ্ধের কোনই সম্পর্ক নেই। আল্লাহ জাল্লা শান্হু ইরশাদ করেন : যারা আমার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে, আমি তাদের অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব (সূরা আনকাবূত : আয়াত ৬৯)। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.)
×