ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রূপপুরের মূল নির্মাণ কাজের লাইসেন্স প্রদান

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৮ নভেম্বর ২০১৭

রূপপুরের মূল নির্মাণ কাজের লাইসেন্স প্রদান

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬ কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের একটি দৈনিক ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প : স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শিরোনামে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। মাত্র চারজন আলোচকের ওই বৈঠকে জনৈক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাইটিং লাইসেন্স প্রদান (২১ জুন, ২০১৬ নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের সাইটিং লাইসেন্স প্রদান করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, সংক্ষেপে বায়রা) নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ‘আমাদের রেগুলেটরি বডি সাইটিং লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। এটা কি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে? নাকি সরকার বলেছে তোমরা সাইটিং লাইসেন্স দাও, দিয়ে দিয়েছে।’ আসলে কী তাইÑসেই দিকটি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস চালাব এই লেখায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প এবং দেশের অন্যান্য নিউক্লীয় ও বিকিরণ স্থাপনাসমূহ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে।’ ওই আইন অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠানটি ফাংশানালী স্বাধীন। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে বিকিরণ নিয়ন্ত্রণসহ নিউক্লিয়ার সেফটি ও সিকিউরিটির কাজ করে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে গড়া এই রেগুলেটরি অথরিটি। প্রতিবেশী ভারতেও এরকম প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেটি এ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড অব ইন্ডিয়া। রুশ ফেডারেশনের হলো, রোসটেকনজর। বস্তুত ভারত ও রুশ ফেডারেশন নয়, বরং পৃথিবীর বিদ্যুত উৎপাদনকারী ও বিকিরণ সুবিধাভোগী সব দেশেই এ-ধরনের স্বাধীন রেগুলেটরি অথরিটি রয়েছে। নিদেনপক্ষে, ডিভিশন রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এটি গুরুত্বপূর্ণ এক অবকাঠামো বৈকি। উপরন্তু এর সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএর বাধ্যবাধকতা। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে স্বাধীন রেগুলেটরি অথরিটির কার্যক্রম গভীরভাবে সম্পর্কিত। কারণ কোন দেশের বিদ্যুত উৎপাদনে নন-নিউক্লিয়ার থেকে নিউক্লিয়ারে পদার্পণে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে এ-ধরনের রেগুলেটরি অথরিটি। এই কাজ করতে গিয়ে রেগুলেটরি অথরিটিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা তথা প্রযুক্তি-সেবা গ্রহণ, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে মতবিনিময় করতে হয়। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমেও এর ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই। সত্য বলতে কি, এই বিষয়টি নিবিড়ভাবে না দেখলে ওই বিশেষজ্ঞের কথাই সত্য মনে হবে। কারণ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষÑদুটো প্রতিষ্ঠানই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের সাইটিং, মূল নির্মাণ ও নকশা, কমিশনিং এবং ডিকমিশনিং-এর লাইসেন্স প্রদান ও প্রাপ্তি একটি সাধারণ বিষয় মনে হতে পারে। মনে হতে পারে এতে আবার মনিটরিং ও এ্যাসেসমেন্টের কি আছে! আমাদের দেশের মতো নবাগত দেশের সাধারণ জনগণ এমনকি উচ্চশিক্ষিত জনও এ রকম মানসিকতা লালন করতে পারে। এর সঙ্গে কোন বিশেষজ্ঞ যদি রেগুলেটরি অথরিটির কার্যক্রম সম্পর্কে দায়িত্বহীন মন্তব্য করে, তাহলে তো মানুষ বিভ্রান্ত হবেই। এই বিভ্রান্তি দূরীকরণে ও ভুল তথ্য প্রচারণার জবাবে নিউক্লিয়ার সচেতনতায় ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কাজ করা সময়ের দাবি। আসলে নিউক্লিয়ার উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে জনগণকে প্রস্তুত করতে হবে। যাহোক, ৪ নবেম্বর, ২০১৭ হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-এর বলরুমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ‘কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ডিজাইন’ লাইসেন্স প্রদান করে। বস্তুত এর মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের মূল নির্মাণপর্বের কাজ (ফার্স্ট কংক্রিট পৌরিং ডে বা এফসিডি)’র ক্লিয়ারেন্স পেল বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। আর বাংলাদেশ ৩২তম দেশ হিসেবে যুক্ত হলো, বিশ্ব পরমাণু ক্লাব বা নিউক্লিয়ার নেশনে। মাদার অব হিউম্যানিটি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিদ্যুত খাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, এটা যারা চান না, তাদের এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ‘কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ডিজাইন’ লাইসেন্স প্রদান অনুষ্ঠানকে সাজানো মনে হতেই পারে এবং এও সত্য এর খুঁত ধরে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটিও তারা হাতছাড়া করবে না। অন্তত অভিজ্ঞতার আলোকে তা-ই বলা যায়। কিন্তু এই লাইসেন্স প্রদানের আগে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কি-কি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে, তার যৎসামান্য উল্লেখ করছি : আমাদের রেগুলেটরি অথরিটি রূপপুরের সেফটি নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার নিবিড় সহযোগিতামূলক টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়েছে, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করেছে। এ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড অব ইন্ডিয়ার সহযোগিতা নিয়েছে। রুশ ফেডারেশনের রেগুলেটরি অথরিটি রোসটেকনজরেরও সহযোগিতা নিয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, রুশ প্রযুক্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের বিভিন্ন ধাপে লাইসেন্স প্রদানে রোসটেকনজরের সেবা নেয়া কতটা যৌক্তিক? আসলে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের প্রযুক্তি যেহেত রাশিয়ার, তাই এর প্রযুক্তিগত অনুপুঙ্খ তারাই ভাল জানবেÑ এটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু রাশিয়া এবং রাশিয়ার বাইরে কয়েকটি দেশে এই রোসটেকনজরই ভিভিইআর-১২০০ মডেলের রিএ্যাক্টর স্থাপনে কাজ করেছে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য অনেক বিশেষজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ মতামতও নিয়েছে বাংলাদেশের রেগুলেটরি অথরিটি। সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা তো আছেই। সুতরাং সরকার বললেই রেগুলেটরি অথরিটি সাইটিং ও ‘কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ডিজাইন’ লাইসেন্স প্রদান করবে এটা স্রেফ মিথ্যাচার। আর এই ভুল তথ্য যারা সংবাদের নামে প্রচার করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তারা উন্নয়নবিরোধীÑবাংলাদেশবিরোধী কোন গোষ্ঠীর পেইড ্এ্যাজেন্ট। তাদের মিথ্যাচারের জবাবে ইতিবাচক ক্যাম্পেন সময়ের দাবি। কিন্তু রহস্যময় কারণে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট সংশ্লিষ্টরা এদিকে নজর দিচ্ছেন না। লেখক : বিজ্ঞানলেখক ও গবেষক
×