ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

এই নির্যাতনের শেষ কোথায়...

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩ নভেম্বর ২০১৭

এই নির্যাতনের শেষ কোথায়...

দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধির একটি বিরাট অংশ জুড়ে থাকে অর্ধাংশ নারী জাতির সক্রিয় অংশগ্রহণ। সেইভাবে নারীদের উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে সম্পৃক্তকরণ সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকেই তুলে ধরে। টেকসই প্রবৃদ্ধি যেমন নিরন্তর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি কিছু অশুভ সঙ্কেত ও সামাজিক অভিশাপকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলছে। নারী নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণ কিংবা একেবারে প্রাণসংহারের মতো নৃশংস দুর্ঘটনাও প্রতিনিয়তই ঘটানো হচ্ছে। পর পর ঘটে যাওয়া কয়েকটি অমানবিক বর্বরোচিত ঘটনা সেই আশঙ্কাকে জনগণের সামনে নিয়ে আসে। প্রথাসিদ্ধ সমাজ যেখানে নির্মম রক্ষণশীলতাকে কোনভাবেই উপড়ে ফেলতে পারে না সেখানে দুর্বল আর অসহায়রাই হয় চরম সহিসংতার শিকার। সে নারী-পুরুষ যেই হোক না কেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া এক পাশবিক নির্যাতনে কিশোর সাগরের অকাল মৃত্যু এখনও আমাদের শিহরিত করে। তার অপরাধ ছিল সে নাকি পানির পাম্প চুরি করেছে। তার বাবার আর্তচিৎকারে ধ্বনিত হয়েছিল সে যদি চুরিই করে থাকে তাহলে ছেলেকে কেন আইনের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেরাই বিচার করতে গেল। শুধু তাই নয় ২১ অক্টোবর বরিশালের ১২ বছরের বালক শাওনকে মোবাইল চুরির অপরাধে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এখানে অভিযুক্তরা সবাই অসহায় এবং হতদরিদ্র। দিনমজুর খেটে খাওয়া নির্বৃত্ত পিতার দুর্বল সন্তান। তাই তাদের আইনের দোরগোড়ায়ও যেতে দেয়া হলো না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল আবারও। গত ২৮ অক্টোবর শনিবার মোবাইল ফোন চুরি করার অপরাধে নরসিংদীর আজিজাকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বিভিন্ন খবরে জানা যায় আজিজার চাচা মালয়েশিয়া প্রবাসী। তার স্ত্রীকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেন। একসময় সেই মূল্যবান বস্তুটি হারিয়ে গেলে দোষ পড়ে ভাসুরের মেয়ে আজিজার ওপর। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং দরিদ্র বালিকা আজিজা পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। আজিজা দৃঢ়ভাবে এই চুরির অপবাদ অস্বীকার করে। তার পরেও তাকে চাচি হুমকি দেয় মোবাইল ফোন ফেরত দিতে না পারলে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। এক সময় সেই ঘটনাই ঘটানো হয়। ১৩ বছরের আজিজাকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে ৪ জনের একটি দল গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আপাদমস্তক দগ্ধ হওয়া আজিজার আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে মুমূর্ষপ্রায় মেয়েটিকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে হস্তান্তর করার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। তবে নিহত আজিজা মৃত্যুর আগে শেষ জবানিতে হত্যাকারীদের শনাক্ত করে যায়। তাদের মধ্যে দু’জন চাচির চাচাত ভাই। মূল ঘটনার প্রধান আসামি হিসেবে চাচিকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরাধীরা যেহেতু পরিচিত আশা করা হচ্ছে তাদের মূল হোতাসহ সবাইকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করতে সক্ষম হবে। তাদের ওপর কড়া নজরদারিও রাখা হয়েছে। অপরাধীরা অবশ্যই ধরা পড়বেÑ কিন্তু আইন তার নিজস্ব নিয়মে কতখানি এগুবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সমাজের এমন কিছু অপসংস্কার কতিপয় বিকৃত মানসিকতার অমানুষকে অন্যায়ভাবে অন্যের ওপর দখলদারিত্বে প্ররোচিত করে যার পরিণামে শুধু নির্যাতনই নয় অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে সময় লাগে না। যে কোন অপরাধের বিচারের জন্য আইনসিদ্ধ বিধি ব্যবস্থা বহাল থাকা সত্ত্বেও কেন যে কিছু মানুষ তা নিজের মতো করে অপব্যবহার করতে থাকেন তা কি শুধুই অসংযত মানসিকতা? নাকি দুর্বলের ওপর সবলের কর্তৃত্বের ও নিষ্ঠুর দলন? যাই হোক না কেন এ ধরনের আইনবহির্ভূত কার্যবিধি কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। অন্যায়ভাবে কোন প্রমাণ ছাড়া পাশবিক নির্যাতনে কারও প্রাণহরণ করার অধিকার আইন, সমাজ, ধর্ম কিংবা রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। এ শুধু আরেকজনের স্বাধীন জীবনের ওপর জবরদখলীমূলক সাঁড়াশি আক্রমণই নয়, নীতি নৈতিকতাবহির্ভূত সাংবিধানিক বিধিনিষেধেরও চরম বরখেলাপ। এমনভাবে মানবিকতার অপমান, মনুষ্যত্বের অসম্মান কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ শুধু কিশোরীর হত্যাযজ্ঞই নয় মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ও। যা নারী-পুরুষ কারও জন্যই শুভ সঙ্কেত হতে পারে না। গত ১৩ অক্টোবর খুলনায় ঘটে যায় এমনই একটি অন্যমাত্রার কিশোরী নিপীড়ন। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ১৩ বছরের চাঁদনীকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে পাড়ার বখাটে শামীম ওরফে শুভ প্রায়ই বিরক্ত করত অশালীনভাবে। এরই জের ধরে রাতে শুভ কয়েক বখাটেকে নিয়ে চাঁদনীর ঘরে আক্রমণ করে। তারা চাঁদনীকে মারধর করতে থাকলে এক পর্যায়ে তার বাবা এসে মেয়েকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে পরিণতিতে তাকেও বখাটেরা আঘাত করতে থাকে। চাঁদনী সহ্য করতে না পেরে পাশের ঘরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। বাবা রবিউল ইসলাম সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। তিনি এ অমানবিক নির্মমতার বিচার চেয়ে মামলা করলে অভিযুক্তরা ধরা পড়ে। এখন তারা বিচারের মুখোমুখি হলেও কখন যে ছাড়া পেয়ে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই ধরনের জঘন্য অপরাধকে আরও জোরদার করে বলে অনেকেই মনে করেন। এ ছাড়া ২৫ অক্টোবর সাতক্ষীরার শ্যামনগরের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী জয়শ্রী চক্রবর্তীও উন্মত্ত নরপশুদের নির্মমতা সহ্য করতে না পেরে ওড়না-পেঁচিয়ে চিরদিনের মতো নিজেকে শেষ করে দেয়। বখাটে শেখর ম-ল এবং তার কয়েক দুষ্ট সহযোগী জয়শ্রীকে শারীরিক হয়রানি করেও তাদের আশা মেটেনি। কাঁচি দিয়ে তার মাথার চুলও উত্ত্যক্তকারীরা কেটে দেয়। এই অসহনীয় অপমানে দগ্ধ হয়ে জয়শ্রী ঠাকুরঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মাহুতি দেয়। তার স্বজনরা একটু দেরিতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যায়। ২৫ অক্টোবর ঘটে যাওয়া অপমৃত্যুর জন্য মামলা করা হয় ২৭ অক্টোবর। এই সুযোগে আসামিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তার পরও পুলিশ তাদের আটক করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময় হয়ত তারা ধরাও পড়বে। কিন্তু শেষ বিচার কি হয় সেটাই দেখার বিষয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে না পারলে এই ধরনের অপরাধ আরও বাড়বে বৈ কমবে না। এ জন্য যেমন সুষ্ঠু আইনানুগ ব্যবস্থা প্রয়োগ জরুরী একইভাবে গণসচেতনতাকেও বিশেষ বিবেচনায় আনা অপরাধ নিরসনের অন্যতম পন্থা হিসেবে ভাবা যেতে পারে। মানুষের প্রতি মানুষের সহনীয় বোধ, অধিকার চেতনা এবং স্বাধীন মনোবৃত্তি তৈরি করতে না পারলে কাউকে সম্মান কিংবা মর্যাদার আসনে বসানো অত্যন্ত কঠিন। এই ধরনের মানবীয় এবং সহনীয় গুণাবলী আরও সাংবিধানিক নীতি-নৈতিকতা আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হলে প্রত্যেক মানুষকে তার যথার্থ অধিকার আর স্বাধীনতা দিতে পর্বতপ্রমাণ বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
×