ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং বাংলাদেশের নতুন প্রস্তাব

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১ নভেম্বর ২০১৭

আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং বাংলাদেশের নতুন প্রস্তাব

যোগাযোগই হচ্ছে আজকের দুনিয়ার উন্নয়নের চাবিকাঠি। যার যত যোগাযোগ সেই তত এগিয়ে যায়। দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অন্য দেশের সঙ্গে যে দেশের যত বেশি যোগাযোগ সেই দেশই তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। আমাদের সামনে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো-অভিন্ন ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেখানে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়নের ফলেই গড়ে উঠেছে শক্তিশালী ইউরোপ। দুর্বল দেশগুলো শক্তিশালী অর্থনীতির ছায়ায় বেড়ে উঠছে। একইভাবে আসিয়ান গঠন করে এগিয়ে যাচ্ছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সার্ক গঠনের প্রায় তিন দশক হতে চললেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে কাটছে না এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অনাস্থা ও অবিশ্বাস। মূলত এই আঞ্চলিক জোটের মধ্যে দুই বিপরীত মেরুর দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের পারস্পরিক বিরোধের কারণেই এগোচ্ছে না এই জোট। আঞ্চলিক যোগাযোগ তো দূরের কথা, মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গঠন করেও তেমন একটা অগ্রগতি হচ্ছে না। এই ব্যর্থতা থেকেই চিন্তা আসে আঞ্চলিক জোটের মধ্যে উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের। সেই থেকে কাজ শুরু হয় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন গঠনের। এক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রগতিও হয়েছে। ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে সড়ক পথে যাত্রীবাহী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যান চলাচলে মোটরযান চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর এই চুক্তি থেকে পিছুটান দেয় ভুটান। দেশটি জানায়, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে আপাতত তাদের পক্ষে বিবিআইএনে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু ভুটানের স্থানীয় রাজনীতি বা বিরোধী দলের বিরোধিতা করার কারণে দেশটির বর্তমান সরকার চুক্তিটি করতে পারছিল না। এখানে ওই দেশটির ক্ষমতাসীন দলের ভোটের হিসাব জড়িত রয়েছে। বিবিআইএন-এমভিএ ২০১৫ সালের ১৫ জুন সই হওয়ার পর গত বছর জুলাইতে ভুটানের সংসদের নিম্নকক্ষ এর অনুমোদনও দেয়। কিন্তু ওই বছরের নবেম্বরে চুক্তিটি উচ্চকক্ষে তোলা হলে তা প্রত্যাখ্যান করেন আইনপ্রণেতারা। অবশ্য ভুটান জানিয়েছে, দেশটির পার্লামেন্টে বিরোধিতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে সরকার চুক্তিটি অনুমোদন করাতে পারেননি। এ ছাড়া দেশটির সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এই মুহূর্তে এ ধরনের চুক্তি পাস করাতে গিয়ে কোন রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে চায় না ভুটান। তবে নির্বাচনের পর চুক্তিটির ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে দেশটির পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ভুটানের কারণে চুক্তিটি বাধার মুখে পড়ায় দেশটিকে পাশ কাটিয়ে শুধু বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে মোটর ভেহিকল চুক্তি করার বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছিল। কিন্তু এতে এই চুক্তিটির গুরুত্ব অনেক কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব কারণে এখন অবশ্য ভুটানকে সঙ্গে রেখেই নতুন করে ‘বিবিআইএন মোটর ভেহিকল চুক্তি’ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে ভুটানের পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হচ্ছে না। চুক্তি হবে ভুটানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর। কারণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের স্বার্থে চুক্তিটি করার আগ্রহ রয়েছে দেশটির। আগামী ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়। ওই বৈঠক সামনে রেখে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে (বিবিআইএন) নিয়ে যে, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়নে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। অবশ্য ভুটানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিবিআইএন মোটরযান চলাচল চুক্তিটি করার বিষয়ে তাদের পরবর্তী সংসদ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই চুক্তির আওতায় কোন রকম বাধা ছাড়াই এই চারটি দেশের এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্যবাহী গাড়ি (ট্রাক, টেইলার), যাত্রীবাহী বাস বা ব্যক্তিগত মোটরযান প্রবেশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির জন্য পৃথক ট্রানজিট ফি দিতে হবে। পাশাপাশি পণ্যবাহী গাড়ির জন্য পৃথক কর ও শুল্ক দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি পণ্যবাহী গাড়ির ট্রানজিটের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আর্থিক গ্যারান্টি দিতে হবে। প্রতিটি দেশে গাড়ি প্রবেশের ক্ষেত্রে নিজ নিজ কাস্টম নীতিমালা অনুসরণ করবে। ইতোমধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিবিআইএন নোডাল অফিসার্স কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে চার দেশের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা অংশ নেন। ওই বৈঠকে যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচলে প্রটোকলের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। তবে প্রটোকলটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল প্রটোকল চূড়ান্তের পর তা চার দেশের সরকার কর্তৃক অনুমোদন করতে হবে। এরপর প্রটোকল সই করা হবে। সেটি পুনরায় চার দেশের সরকার পর্যায়ে অনুসমর্থন করতে হবে। বিবিআইএন চুক্তির অন্য অংশটি ছিল ব্যক্তিগত গাড়ি ও পণ্যবাহী মোটরযান চলাচল। এ অংশের প্রটোকলের খসড়া প্রণয়নে চার দেশ এখনও ঐকমত্য হতে পারেনি। সম্ভাব্য রুট নির্ধারণ, ব্যক্তিগত গাড়ি বা পণ্যবাহী মোটরযান বছরে কী পরিমাণ চলাচল করবে, মাশুল কী হবে ইত্যাদি বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর পাশাপাশি এই চার দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালে একে অপরের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্যিক চাহিদা রয়েছে। রয়েছে ভ্রমণের বিষয়ও। কিন্তু দেশ চারটির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রানজিট সুবিধা না থাকায় বাণিজ্য সম্পাদনে অতিরিক্ত সময় ও অর্থদন্ড লাগছে। বিষয়টি মাথায় রেখে চার দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বাণিজ্য সম্পর্ক আরও উন্নয়নে চার দেশের সরকার প্রধানরা ট্রানজিট চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর শুরু হয় চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট কার্যকর এবং আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগের বিবিআইএন চুক্তি করা সম্ভব হলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্থল বন্দরগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্য অনেক বাড়বে। তাই এ চুক্তিটি করার ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থলবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি সিলেট ও দুই পার্বত্য জেলায় চারটিসহ নতুন ১২টি স্থলবন্দর নির্মাণেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেনাপোল এবং নেপাল ও ভুটানের নিকটবর্তী বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন ঘোষিত স্থলবন্দরগুলো নির্মাণের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে রেখেছে সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সফরের সময়। এ সময়ে দুই দেশের মধ্যে যৌথ পরামর্শক কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে ভুটানকে রেখে বিবিআইএন মোটরযান চুক্তিসহ নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসে বাংলাদেশ। নতুন প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কাকেও এই উপ-আঞ্চলিক জোটে নিয়ে আসার কথা রয়েছে। প্রস্তাবে ঢাকা-চেন্নাই-কলম্বো বিমান চলাচল, চট্টগ্রাম-কলকাতা-কলম্বো জাহাজ চলাচল, পঞ্চগড়-শিলিগুড়ি রেল যোগাযোগ, ভারতীয় ভূখ-ের ওপর দিয়ে ভুটানের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ, বাংলাদেশের নাকুগাঁও স্থলবন্দর থেকে ভারতের ডলু হয়ে ভুটানের গাইলেফুং স্থলবন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগের কথা রয়েছে। বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, নতুন এই প্রস্তাব ভারত ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনার কথা বলেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও বলেছেন, দুই দেশের বন্ধুত্বের কারণেই আমরা দারুণ এক সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিবেশীদের মধ্যে অবশ্যই সহযোগিতার সম্পর্ক থাকা উচিত। আসলে বিশ্বে কোন দেশই স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। ফলে কোন না কোন সম্পদের জন্য এক দেশকে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। আর এই যোগাযোগ ওই নির্ভরশীলতাকে অনেকাংশে সহজ করে দেয়। বিবিআইএন কাঠামো কার্যকর হলে এই চার দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে। বিশেষ করে, ভুটান নেপালের কোন সমুদ্র বন্দর নেই। এই দুই দেশ বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে বাণিজ্য বাড়াতে পারবে। সেই সঙ্গে উপকৃত হবে চার দেশের মানুষ। আবার নেপাল ছাড়া ভারত, ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য অনুকূলে নয়। চুক্তি করা গেলে ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং ভুটানে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে। এছাড়া চারদেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ারও নতুন সুযোগ তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন বাজার। এ জন্য অবশ্য বিবিআইএনকে অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা মুক্ত বাণিজ্য এলাকায় পরিণত করতে হবে। এতে অবশ্য এই চার দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য যেমন অবাধ হবে, তেমনি সম্ভাবনাময় এসব দেশের সীমান্ত এলাকারও ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। তবে এ উদ্যোগকে সফল করতে হলে চার দেশের সরকারকে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আসলে একটি উদ্যোগ থেকেই আর একটি উদ্যোগের জন্ম নেয়। এই চারটি দেশ মোটামুটি সমমনা সম্পন্ন। এ কারণেই নতুন এই উপ-আঞ্চলিক জোট নিয়ে নতুন করে আশার সঞ্চয় হয়েছে। সার্ক যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে এই চার দেশ মিলে আঞ্চলিক যোগাযোগে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের দেশগুলো একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে শুধু নেতিবাচক মানসিকতার কারণেই সার্ক অঞ্চলের দেশগুলো যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই পড়ে আছে। এখানে অবশ্য বড় দেশের অনেক ছাড়ের বিষয় আছে। আশা করছি, বড় দেশ হিসেবে ভারত সেই ছাড় দেবে। বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রাখবে এই উপ-আঞ্চলিক জোটকে। যেখানে প্রত্যেক দেশ নিজস্ব স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে একযোগে স্ব-স্ব দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একযোগে কাজ করে যাবে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×