ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ মাস বয়সেই শিশু মানসিক দৃঢ়তার শিক্ষা পায়

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

১৫ মাস বয়সেই শিশু মানসিক দৃঢ়তার শিক্ষা পায়

‘প্রথমবার যদি সফল হতে না পার, আবারও চেষ্টা কর, চেষ্টা চালিয়ে যাও’ এমআইটি দ্বারা পরিচালিত এই গবেষণা প্রকাশ করে যে, ১৫ মাস বয়সী শিশুরা এই উপদেশটি মেনে চলা শিখতে সক্ষম। যেসব শিশু প্রাপ্তবয়স্কদের অনায়াসে দ্ব্যর্থহীনভাবে সফল হতে দেখে, তাদের তুলনায় যেসব শিশু প্রাপ্তবয়স্কদের ভিন্ন দুইটি কাজে সাফল্য অর্জনের পথে সংগ্রাম করতে দেখে- তারা নিজেদের জীবনের ক্ষেত্রেও কঠিন কাজগুলো সম্পাদনে অধিকতর সচেষ্ট হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ মাস বয়সী শিশুরা কঠোর পরিশ্রমের মূল্যায়ন বুঝতে সক্ষম। গবেষকরা অনুসন্ধানে পেয়েছেন যেসব শিশু একজন প্রাপ্তবয়স্ককে দুইটি ভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে পরিশ্রম করতে দেখে, তারা নিজেদের কঠিন কাজেও অধিক চেষ্টা করেÑ সেসব শিশুর তুলনায় যারা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে সহজেই সফল হতে দেখে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা বড়দের নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাবার অল্প কিছু উদাহরণ দেখেই প্রচেষ্টার মূল্য বুঝতে শিখে, তবে এই প্রভাব কতটা দীর্ঘ হয় তা নিয়ে গবেষকরা কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। যদিও পরীক্ষাটি গবেষণাগারের পরিবেশে করা। গবেষকরা মতামত প্রকাশ করেন যে, এর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল সেসব বাবা-মার জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে যারা নিজেদের ছেলেমেয়ের মধ্যে কঠোর অধ্যবসায় চর্চার অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে তোলার আশা রাখেন। এমাইটির কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক লরা শুল্জ জানান, ‘বাবা-মায়ের উপর সবসময় একধরনের চাপ থাকে বাচ্চাদের সামনে সবকিছুকে সহজভাবে তুলে ধরার এবং তাদের সামনে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পরার। পরীক্ষাগারে চর্চার মাধ্যমে আপনি এমন কোন কিছুই শিখতে পারবেন না যা বাবা-মার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রযোজ্য। তবে এই গবেষণা থেকে অন্ততপক্ষে এই ধারণা পাওয়া যায়, এটা শিশুদের উপলব্ধি করানো খুব একটা খারাপ ব্যাপার নয়। আপনারা আপনাদের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। শুল্জ এই গবেষণাপত্রের সিনিয়র লেখক, যা সায়েন্স সাময়িকীর সেপ্টেম্বরের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করা হয়। এমআইটির স্নাতক ছাত্রী জুলিয়া লিওনার্ড এবং স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত ইউনালি এই গবেষণাপত্রের সহ-রচয়িতা। সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় কঠোর পরিশ্রমের মূল্য খুঁজে দেখা হয়েছে। কিছু অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, শিশুর বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ যতটা না তার সাফল্য নিশ্চিত করে, তার থেকে বেশি শিশুর অধ্যবসায় বা তাদের ‘চারিত্রিক দৃঢ়তা’ সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। অন্যান্য অনুসন্ধানে অধ্যবসায় বা প্রচেষ্টার উপর শিশুর বিশ্বাসকেও প্রভাবক হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। যাদের ধারণা বুদ্ধিমত্তার একটি নির্দিষ্ট স্তরের উপর সফলতা নির্ভরশীল, তাদের তুলনায় যারা বিশ্বাস করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার মাধ্যমে ভাল ফল পাওয়া যায়- তারা অধিক উন্নতি করে। কিভাবে শিশুরা খুব অল্প বয়সে এই সিদ্ধান্ত নেয়া শিখতে পারে, কখন চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত এবং কখন সচেষ্টা থাকা নিরর্থকÑ এই বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়নে লিওনার্ড এবং শুল্জ আগ্রহ প্রকাশ করেন। শুল্জর পূর্ববর্তী কাজগুলো দেখায় যে, শিশুরা অল্পকিছু উদাহরণ থেকেই কার্যকরী সম্পর্কগুলো শিখতে পারে। লিওনার্ড বলেন, ‘আমরা ধারণা করছিলাম যে কখন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত সে সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারে শিশুরা তাদের স্বাভাবিক দ্রুত শেখার প্রবণতাকে কাজে লাগাতে পারে কিনা।’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে তারা একটি পরীক্ষার পরিকল্পনা করেন যেখানে ১৫ মাস বয়সী শিশুরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে দুটি কাজ সম্পাদন করতে দেখে একটি বাক্স থেকে একটি খেলনা ব্যাঙ বের করা এবং একটি আংটা থেকে চাবির চেইন আলাদা করা। শিশুদের সমান দুইটি দলে ভাগ করে একদলকে দেখানো হয় যে, উক্ত ব্যক্তি ৩০ সেকেন্ড সময়ে কাজটি ৩ বার করতে সক্ষম হয়, অপর দল দেখে তিনি ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত চেষ্টা করে তারপর সফল হোন। পরীক্ষকরা তারপর শিশুগুলোকে একটি সঙ্গীত সৃষ্টিকারী খেলনা দেখান। খেলনার গায়ে একটি বোতাম থাকে যা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এই বোতামটিতে চাপ দিলে খেলনাটি চালু হবে। তবে প্রকৃতপক্ষে বোতামটি কাজ করত না। খেলনার পাদদেশে আরেকটি লুকোনো কার্যকরী বোতাম ছিল। পরীক্ষক পরের বোতামটিকে শিশুদের দৃষ্টির আড়ালে রেখে খেলনাটিকে চালু করে দেখান যে, এটি থেকে সঙ্গীত সৃষ্টি হয়, এরপর খেলনাটি বন্ধ করে শিশুদের হাতে তুলে দেন। প্রতিটি শিশু খেলনাটির সঙ্গে খেলার জন্য দুই মিনিট করে সময় পায় এবং গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন শিশুরা কতবার করে বোতামটিতে চাপ দেয় যেটা দেখে মনে হচ্ছিল সেটা খেলনাটিকে চালু করবে। তাদের পর্যবেক্ষণে বের হয়ে আসে যেসব শিশু প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিটিকে বারবার চেষ্টা করতে দেখেছিল তারা প্রায় দ্বিগুণ বেশি বার বোতামটি স্পর্শ করে- অন্য শিশুদের তুলনায় যারা পরীক্ষকটিকে তার কাজে সহজেই সফল হতে দেখেছিল। তারা সাহায্য চাওয়া বা খেলনাটি ছুড়ে দেয়ার আগেও প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ চেষ্টা চালায়। লিওনার্ড জানান, ‘বাচ্চারা কত সময় যাবত খেলনাটির সঙ্গে খেলেছিল বা কতবার তাদের মা-বাবার কাছে দিয়েছিল তাতে কোন পার্থক্য ছিল না। মূল পার্থক্য ছিল তারা সাহায্য চাওয়ার আগে মোট কতবার বোতামটিতে চাপ দিয়েছিল সেই সংখ্যায়।’ গবেষকরা আরও পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, বাচ্চাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করাও একটা ভূমিকা পালন করে। পরীক্ষক যখন বাচ্চাদের নাম ধরে ডেকে, তাদের সঙ্গে দৃষ্টি সংযোগ রেখে এবং সরাসরি কথা বলেছিল তখন বাচ্চারা আরও বেশি চেষ্টা করেছিল তখনের তুলনায় যখন পরীক্ষক সরাসরি বাচ্চাদের সঙ্গে জড়িত হননি। শুল্জ বলেন, ‘অন্যান্য গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে আমরা যে ফল পেয়েছি, তা হলো শিক্ষক স্থানীয় আচার-ইঙ্গিত এই প্রভাব বিস্তারে একটি পরিবর্ধক হিসেবে কাজ করে। এই আচার-ইঙ্গিতগুলো ছাড়া প্রভাবটি হয়ত হারিয়ে যায় না, তবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে।’ গবেষকদের মতে, পরীক্ষাগুলো থেকে একটি মূল তথ্য পাওয়া যায় যে মানুষ ছোটবেলা থেকে শিখতে শুরু করে পরিশ্রম বণ্টনের ক্ষেত্রে কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আমরা একরকম গোঁড়া বা অতিনিষ্ঠ এক সমাজ, বিশেষ করে এই বোস্টন শহরে। আমরা প্রচেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রমকে মূল্য দিয়ে থাকি। তবে সত্যি বলতে এই গবেষণার মূল গুরুত্ব হলো, আপনি আসলে কোন বিষয়ের বা কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের পেছনে বিপুল পরিমাণ পরিশ্রম দিতে চান না। প্রচেষ্টা একটি সীমিত সম্বল। আপনি কোথায় একে প্রয়োগ করবেন কিংবা কোথায় করবেন না?’ গবেষকরা আশাবাদ তারা অনুসন্ধান করে দেখবেন প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রভাবটি কত সময় পর্যন্ত কার্যকর হয়। গবেষণার আরেকটি সম্ভাব্য পন্থা হলো বিভিন্ন প্রকারের কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে এই প্রভাবটি সমান শক্তিশালী কিনা। উদাহরণস্বরূপ, যদি শিশুদের কাছে এটি আরও অস্পষ্ট করে দেয়া যে বড়রা আসলে কি করতে চাচ্ছে। সূত্র : ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি সরবরাকৃত উপকরণ
×