ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

তপন বিশ্বাস

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১১ অক্টোবর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়েরি

বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় মেক্সিকো ২৭ মে, মঙ্গলবার। চারদিনের সফর শেষে দেশে ফেরার পালা। সকাল থেকে একে একে বিদায় নিচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন আমেরিকায়। কেউ যাচ্ছেন ইউরোপ। বাকিরা সরাসরি দেশে ফিরবেন। ১২টার মধ্যে হোটেলের রুম ছাড়তে হবে। বিকাল পৌনে চারটায় ফ্লাইট হলেও ঝামেলা এড়াতে আমরা একটু আগে ভাগে রুম ছাড়লাম। ওই এলাকায় খাবার অন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় রুম ছাড়লেও আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম একদিন আগেই সস্ত্রীক আমেরকিায় গিয়েছেন। তাঁর একান্ত সচিব আবু তাহের ভাইও সঙ্গে গেছেন। ত্রাণ ও দুর্যোগ সচিব মোঃ শাহ কামাল এবং অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ অন্য প্রগ্রামে যোগদানের জন্য রয়ে যাচ্ছেন। সকালে প্রধানমন্ত্রী এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদকে বিদায় দিয়ে আমরা মুন প্যালেসে মূল ভবনের লাউঞ্চে বসে সময় কাটাচ্ছি। হাতে কিছুটা অবসর সময় থাকায় মেক্সিকোতে বাংলাদেশের এম্বাসেডর সুপ্রদীপ চাকমা আমার পাশে এসে বসলেন। ৮৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা আমার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে বললেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনাময় দেশ মেক্সিকো। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ওষুধ, সিরামিক্স, প্লাস্টিক্স, সেমি ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের। পাশাপাশি চাহিদা ভারতীয় বাংলাদেশী কাঁকড়া, চিংড়িমাছসহ সমুদ্রিক মাছের। এছাড়া রেস্টুরেন্ট ব্যবসাও জমজমাট। ভাতরীয় (বাংলাদেশ) খাবারের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ২৭০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক মেক্সিকোতে আসে। তদারকি করলে এখানে এই ব্যবসার আরও প্রসার ঘটানো সম্ভব। সিরামিকের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যের মান অনেক উন্নত। ওই পণ্য মেক্সিকোতে পাঠালে আর্থিকভাবে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হতে পারে। এছাড়া হন্ডুরাস, কোস্টারিকা, ক্যারিবিয়ান দেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া পানামাতে ‘ডিউটি ফ্রি শপ’ এ গার্মেন্টস, সিরামিক্স, প্লাস্টিকস, সেমি ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ব্যবসার প্রসার ঘটানো যেতে পারে। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম থেকে এ জাতীয় পণ্য এনে এ অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ সকল পণ্য স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা ‘পানামার ডিউটি ফ্রি শপে’ বিক্রি করছে। এ পণ্যর ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার কথায় আশান্বিত হলাম। দেশে ফিরে এ বিষয় লিখব ঠিক করলাম। লিখলামও। মুন প্যালেসে বসে আমরা গল্প করে সময় কাটাচ্ছি। চারদিনের সফরের মধ্যে কেনাকাটার সময় না পেয়ে আসার দিন সকালে আমাদের কয়েকজন কর্মকর্তা গেলেন শপিং-এ। অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা, জাকির হোসেন আকন্দসহ কয়েক কর্মকর্তা শপিং থেকে ফিরলেন। সকলে মিলে লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। অন্য সকলে এক ফ্লাইটে। আমি একা এক ফ্লাইটে। আধাঘণ্টা আগে আমার ফ্লাইট। আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। আসার সময় এয়ারপোর্টে এসে ঝামেলায় পড়েছিলাম। এয়ারপোর্টে কর্তব্যরত পুলিশ ইংরেজী বোঝে না। তারা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে বলে। তখন অবশ্য দু’জন ছিলাম। আমার সঙ্গে যুগ্ম-সচিব অর্ধেন্দুদা ছিলেন। দু’জনে মিলে অতিকষ্টে তা মোকাবেলা করেছিলাম। এবার একেবারেই একা। কোন ঝামেলা হলে কি করব, তা নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম। অর্ধেন্দুদা সকালেই আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। আমরা একদিন পরে যাওয়ায় আমাদের ভিন্ন ফ্লাইট। অধেন্দুদা চলে যাওয়ায় আমি একা হয়ে পড়েছি। অবশ্য ম্যক্সিকো সিটি থেকে আমরা একই সঙ্গে সবাই একই ফ্লাইটে আসব। নানা চিন্তা করতে করতে আমরা কানকুন এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলাম। সেখানে এসে সকলে একই সঙ্গে বোর্ডিং পাসের লাইনে দাঁড়ালাম। একই সঙ্গে আমরা কয়েকজন বোর্ডিং পাসের জন্য বুথে উপস্থিতও হলাম। আমাদের বোর্ডিং পাস দিল ঠিকই। কিন্তু লাগেজ জাপান থেকে সংগ্রহ করতে হবে। সকলের একই প্রশ্ন জাপানের ভিসা নাই। কেমনে লাগেজ সংগ্রহ করব। কিন্তু কিছুতেই তারা লাগেজ ঢাকার জন্য বুকিং দেবে না। তারা খোড়া যুক্তি দেখিয়ে দিল, এই বোর্ডিং পাস দেখালে আপনাদের লাগেজ আনতে দেবে। এটাই সে ক্ষেত্রে ভিসার কাজ করবে। সকলে বলল ঠিক আছে, আগে জাপান যাই পরে দেখা যাবে। আমার ফ্লাই টাইম চলে এলো। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। এরোম্যাক্সিকান এয়ারের ডোমেস্টিক ফ্লাইটে গিয়ে আমি আমার সিটে বসলাম। তপন বিশ্বাস মেসিকে ভেবে বিনিদ্র নিশিযাপন! ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১। ‘আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে আসবে পূর্ণশক্তির আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল। আর এ দলে অবশ্যই থাকবেন বিশ্বসেরা ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি।’ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের মুখ থেকে যেদিন এ কথাটি শুনলাম, সেদিন নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এটাও কি সম্ভব! কিভাবে! এ যে অনেক টাকার মামলা। কিন্তু অভয় দিলেন বাংলাদেশের ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি সালাউদ্দিন, ‘টাকা-পয়সা নিয়ে কোন সমস্যাই হবে না। কেননা, আমরা স্পন্সরও পেয়ে গেছি।’ এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য জানানোর পর মনে বিশ্বাস জন্মাল, তাহলে সত্যিই বাংলাদেশে খেলতে আসছে ‘লা আলবিসলেস্তে’রা (আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের নিকনেম)। এটা বেশ কয়েকমাস আগের কথা। যখনই শুনেছিলাম আর্জেন্টিনা আসবে, আসবেন মেসি; শুনেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল ধড়াস্ করে। ভয়ে নয়, অসহ্য সুখের আতিশয্যে। বালক বয়সে প্রথমবারের মতো ১৯৮৬ বিশ্বকাপ টিভির পর্দায় দেখেছিলাম। তখন কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু ঠিকই চোখ আটকে গিয়েছিল গাট্টাগোট্টা ধরনের ও রাজকুমারের মতো অপূর্ব রূপবান আর্জেন্টিনার দশ নম্বর জার্সি পরা অধিনায়কের প্রতি। যিনি সে আসরের সেরা ফুটবলার। তাঁর নাম? ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। বল পায়ে অতিমানব এই ফুটবলারের প্রতি সেই যে হৃদয়ে তীব্র ভালবাসা তৈরি হলো, সেটা এখনও আছে। আমার মতো এমন ম্যারাডোনা-ভক্ত বিশ্বে আরও আছে কোটি কোটি। ম্যারাডোনার কারণেই যে আজও ফুটবলপ্রেমীরা আর্জেন্টিনা দলকে সমর্থন করে, এটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু ১৯৯৭ সালে তিনি ফুটবল থেকে অবসর নিলে আর্জেন্টিনা ফুটবলে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তাঁর বিদায়ের পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি (২০১৪ আসরে অবশ্য ফাইনালে উঠেছিল, তবে মেসির দল হেরে গিয়েছিল জার্মানির কাছে)। আর অলিম্পিক, জুনিয়র ও ইয়ুথ লেভেল ঈর্ষণীয় সাফল্য পেলেও সিনিয়র লেভেলে কোন শিরোপা জেতেনি সেই ১৯৯৩ সাল থেকে। এ ব্যর্থতা অহর্নিশ পোড়ায় আর্জেন্টাইন ফ্যানদের। ম্যাারাডোনার পর স্যাভিওলা, আইমার, ওর্তেগা, রিকুয়েলমে, তেভেজর মতো অনেকেই এসেছেন, কিন্তু তারা কেউই ম্যারাডোনার মতো হওয়া তো দূরে থাক, তাঁর ধারে-কাছেও যেতে পারেননি। কিন্তু গত বছর পাঁচেক ধরে এমন একজন আর্জেন্টাইন ফুটবলারের বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে, যার খেলা দেখে বিশ্বের বর্তমান ও সাবেক ফুটবলাররা তো বটেই, স্বয়ং ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনাও রায় দিয়েছেন, অচিরেই এই তরুণ ফুটবলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারে পরিণত হবেন। আর্জেন্টিনাকে আবারও বিশ্বকাপ জেতাবেন ছিয়াশির মতো। এনে দেবেন একাধিক আন্তর্জাতিক শিরোপা। কীর্তিগাথায় ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে যাবার জন্য যত গুণাবলী থাকা দরকার, তার সবই আছে তার। কে তিনি? লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। রাত জেগে স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার খেলা কেন দেখে সবাই? উত্তর একটাইÑমেসির জন্য! সেই মেসি আসবেন বাংলাদেশে! এ যে অবিশ্বাস্য! স্বপ্নেও কি এদেশের কোন ফুটবলপ্রেমী ভেবেছে মেসির দল ঢাকায় খেলতে আসবে? কেউ না ভাবলেও একজন কিন্তু ভেবেছিলেন। তিনি কাজী সালাউদ্দিন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই মেসিরা বাংলাদেশে। মেসিরা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবেÑ খবরটা শুনেই প্রলয় নাচন শুরু করে দিল শরীরের রক্ত। বিশ্বাস করুন, তখন আমি কোন নিরপেক্ষ ক্রীড়া সাংবাদিক নই, পুরোপুরি আমজনতার মতো এক নিখাঁদ আর্জেন্টাইন ভক্ত! অফিসে এ নিয়ে তুমুল উৎসাহে আলোচনা। সহকর্মীদের বেশিরভাগই আর্জেন্টাইন সাপোর্টার। তখন থেকেই ‘কাউন্টডাউন’ আরম্ভ করে দিলাম, কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ৫ সেপ্টেম্বর। ৪ সেপ্টেম্বর আমাদের ক্রীড়া সম্পাদক মজিবর রহমান রুবেল ভাইয়া বললেন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ভবনে গিয়ে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচের জন্য এ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নিয়ে আসতে। রাতে কাজ শেষে সেখানে গিয়ে দেখি অন্যান্য সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরাও এসেছেন একই কাজে। সবার মুখেই মেসি আর আর্জেন্টিনা আর মনে প্রচ- উৎসাহ। সেটা হবেই বা না কেন? বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, এ ঘটনার সাক্ষী হওয়াটা যে পরম সৌভাগ্যের বিষয়। কাজেই হৃদয়ে অনাবিল চিত্তসুখের উদ্রেক হওয়াটাই যে স্বাভাবিক। কার্ড সংগ্রহ করে আবার জনকণ্ঠ অফিসে ফিরে এলাম। নিজেরটা রেখে বাকিগুলো সহকর্মীদের বিলিয়ে দিলাম। এবার বাসায় ফেরার পালা। মজিবর ভাইয়ের সঙ্গেই বের হলাম। তিনি বললেন, বাসায় ফিরে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। কেননা, কাল খুব সকালেই এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বেড়িয়ে পড়তে হবে। সেখানে কেন? আর্জেন্টিনা-নাইজিরিয়া দল আসবে। সেখানে উপস্থিত থেকে যা যা দেখবো, তার ওপর প্রতিবেদন লিখতে হবে। বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে বিছানায় গেলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুম তো আর আসে না! আর কয়েকঘণ্টা পর মেসিদের সামনাসামনি দেখতে পারবÑ এ ভাবনাতেই রোমাঞ্চে ছেয়ে গেল মন। ফলে ঘুমের হলো দফারফা! রুমেল খান [email protected]
×