ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৯ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান

(গতকালের পর) গত ৮ সেপ্টেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদের উত্থান এবং বি-মৌলবাদীকরণ ব্যবস্থাপত্র সম্পর্কে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির’ সুইডেন শাখা। সেমিনারের মূল প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিকভাবে রোহিঙ্গাদের কথা বলেছি দারিদ্র্য ও অসহায়তার সুযোগে জামায়াত কীভাবে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সাহায্যের নামে তাদের জঙ্গী সন্ত্রাসী বলয়ে রিক্রুট করছে। সেমিনারে জাতিসংঘ সমিতির সভাপতি মানবাধিকার নেত্রী মোনা স্ট্রিন্ডবার্গ ইউরোপের দেশগুলোর শরণার্থীনীতির সমালোচনা করে বলেছেন তারা মানবতাবোধ বিসর্জন দিয়ে সিরীয় শরণার্থীদের বোঝা তুরস্কের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, বলছে তোমরা ওদের রাখ, টাকা যা লাগে আমরা দেব। সিরীয় শরণার্থীদের অবশ্য জার্মানি ও সুইডেনও আশ্রয় দিয়েছে। তবে দুই বছর আগে ইউরোপে যখন সিরীয় শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল তখন পশ্চিমের অনেক সভ্য বিত্তশালী দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। সিরীয়দের আশ্রয় দিতে না চাইলেও আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো গত ২০ বছরে নেপালে আশ্রয়গ্রহণকারী লক্ষাধিক ভুটানী শরণার্থীকে ভাগাভাগি করে গ্রহণ করেছে। মানবতাবাদীদের অনেকে বলছেন মুসলমান হওয়ার কারণে সিরীয় ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিমের দেশগুলোর আগ্রহ নেই। জামায়াত ও পাকিস্তানের আইএসআইর কারণে রোহিঙ্গা যুবকদের ভেতর জঙ্গী মৌলবাদের বিস্তার কীভাবে ঘটছে এ নিয়ে আমরা গত এক যুগ ধরে লিখছি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল প্রথমবার দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী সৌদি আরবে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনের মৃদু প্রতিবাদ করলেও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যারা অহরহ মুসলিম উম্মাহর কথা বলে মাতম করেÑ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৌদি আরব রাখাইন রাজ্যে তেলের পাইপলাইন বসাচ্ছে। বাংলাদেশকে কিছু ত্রাণ পাঠিয়ে এবং অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রধান মোড়ল তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। অথচ সৌদি আরব চাইলে দশ লাখ রোহিঙ্গা অনায়াসে আশ্রয় দিতে পারত, এতে তাদের তথাকথিত উম্মাহরও মান বাঁচত। মুসলিম দেশগুলোর ভেতর একমাত্র ব্যতিক্রম তুরস্ক। সুইডেন থেকে গত ১১ সেপ্টেম্বর আমি দশদিনের সফরে তুরস্ক গিয়েছিলাম টার্কিশ পেন ক্লাবের আমন্ত্রণে। এর ফাঁকে তুরস্কের লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সরকারী কর্মকর্তা ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে ইস্তানম্বুল, আঙ্কারা ও কোনিয়ায়। বলাবাহুল্য আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা। তুরস্কের সকল টেলিভিশনে দেখেছি প্রতিদিনের প্রধান সংবাদÑ মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গারা কীভাবে বাংলাদেশে আসছে, কীভাবে থাকছে, বাংলাদেশ কী করছে ইত্যাদি। আঙ্কারায় আমাদের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে তুরস্কের নেতিবাচক মনোভাব এখন আর নেই। বিশেষভাবে গত বছর গুলেনপন্থীদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর বাংলাদেশ যেভাবে এর নিন্দা করে সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের প্রতি তুরস্কের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কারণে তুরস্কের সাধারণ মানুষও বাংলাদেশের পক্ষে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে জামায়াতীরা তুরস্ককে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করেছিল বটে, তবে হালে তাদের বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র সেখানে আর কলকি পাচ্ছে না। আমি তুরস্কে থাকাকালে সে দেশের ফার্স্টলেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের অবস্থা জানার জন্য বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ ছাড়াও তুরস্ক রোহিঙ্গাদের জন্য ১ লাখ ঘর বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সাহায্য পাঠানো জরুরী। তবে তার চেয়ে বেশি জরুরী হচ্ছে মিয়ানমারে চলমান রোহিঙ্গা নির্যাতন/নিধনরোধে ত্রি-স্তর বিশিষ্ট সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো। বাংলাদেশের দুঃসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু ভারত সবার আগে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সাহায্য প্রেরণ করলেও রোহিঙ্গা গণহত্যার নিন্দা এখন পর্যন্ত করেনি। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অপর প্রধান বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান করলেও পরবর্তীকালে অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চীন রোহিঙ্গা নিধনের নিন্দার পরিবর্তে জাতিসংঘে এর বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশের দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে এসব দেশের মনোভাবও পাল্টাচ্ছে। ভারত, রাশিয়া ও চীনকে এ কথা বোঝাতে হবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলমান নির্যাতন ও জাতিগত নির্মূল বন্ধ না হলে ইসলামের নামে জঙ্গী মৌলবাদের আন্তর্জাতিক বলয় শক্তিশালী হবে এবং সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর মদদপুষ্ট বিভিন্ন জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গা তরুণদের জিহাদের জন্য রিক্রুট করছে। ২০১০ সালে নির্মিত আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘জিহাদের প্রতিকৃতিতে রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠন আরএসও’ (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) ও ‘হরকাতুল জিহাদ’-এর কয়েকজন জঙ্গীর সাক্ষাতকার রয়েছে। তারা বলেছে কীভাবে জামায়াতের মাধ্যমে তারা জঙ্গী কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে, কোথায় তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে কীভাবে তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গা জঙ্গীরা শুধু মিয়ানমার নয়, বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, বসনিয়া ও চেচনিয়ায় সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছে। আমি যখন তাদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করি তখন আইএসের উত্থান ঘটেনি। গত ১২ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ নিকোলা স্মিথের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম হচ্ছে ‘Malaysia warns Rohingya crisis could lead to ISIL attacks in Burma.’ প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাতুক সেরি হিশামউদ্দিনের সতর্কবাণী উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলমান নির্যাতনের সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছে ‘আইএসআইএল’, যার মূল্য দিতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে। বিভিন্ন রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠনের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জেনেছি এবং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নিকটও এ তথ্য রয়েছে যে, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের একটি অংশ আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের অবস্থান গুটিয়ে ‘আইএস’ও দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের কর্মপরিধি বিস্তৃত করতে চাইছে এ সম্পর্কে গত বছর প্রকাশিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র শ্বেতপত্রে বিস্তারিত বলা হয়েছে। পাকিস্তানের আইএসআইর সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী কীভাবে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়েছে, কীভাবে তাদের এনজিওগুলো এসব এলাকায় জঙ্গী মৌলবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কীভাবে রোহিঙ্গাদের ভেতর জিহাদী উন্মাদনা ছড়াচ্ছে এ নিয়ে আমরা গত ১২ বছর ধরে লিখছি। আরএসওর আরবী মুখপত্র ‘আল তাদামুন’-এ ইশতেহার ছেপে মিয়ানমারে জিহাদের জন্য অর্থ প্রেরণের জন্য জামায়াত তাদের ইসলামী ব্যাংককে কীভাবে ব্যবহার করেছে আরএসওর কমান্ডার ডাঃ মোহাম্মদ ইউনুসের হিসাব নম্বরসহ আমি লিখেছি। আইএসআই এবং জামায়াতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা নির্যাতনের সুযোগ নিয়ে মিয়ানমারের আরাকানের একটি অংশ এবং বাংলাদেশের বান্দরবান ও কক্সবাজারকে নিয়ে স্বাধীন রোহিঙ্গা মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা। এ তথ্য হরকাতুল জিহাদের প্রকাশনা থেকে ১২ বছর আগেই আমরা জেনেছি। (উর্দুতে প্রকাশিত এ গ্রন্থের নাম ‘তাযকেরায়ে আরাকান।’ লেখক : মোহাম্মদ সিদ্দিক আরাকানী, প্রকাশক : হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী মিয়ানমার, প্রকাশকাল : জুলাই ১৯৯৭।) মৌলিক অধিকার হরণ করে কিংবা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে মানুষের বিক্ষোভজনিত বিদ্রোহ কখনও দমন করা যায় না। মিয়ানমার সরকারকে এবং সাধারণ মানুষকেও এটা বোঝাতে হবে রোহিঙ্গা বা মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসী নয়। যে কোন সংজ্ঞা ও আইনে তারা সেদেশের নাগরিক। রোহিঙ্গাদের ভেতর কিছু জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন আছে এ বিষয়ে আমরা জানি। তার অর্থ এই নয় যে, রাখাইন রাজ্যের সবাই সন্ত্রাসী। সামরিক বাহিনী সন্ত্রাস দমনের নামে যেভাবে আরাকানকে রোহিঙ্গাশূন্য করতে চাইছে তার চরম মাশুল শুধু মিয়ানমারকে নয়, প্রতিবেশী সকল দেশ, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বকেও দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্যাতন বন্ধ না হলে জামায়াত, আইএসআই, আল কায়েদা ও আইএসের বিশ্বব্যাপী জঙ্গী জিহাদী কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হবে, ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হবে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য কখনও শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না। সন্ত্রাস দমনের জন্য শক্তি প্রয়োগের সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হয় জননিরাপত্তাকে। পাকিস্তানে সন্ত্রাস দমন করতে গিয়ে উত্তরাঞ্চলে আমেরিকার ড্রোন হামলায় একজন তালেবান নিহতের পাশাপাশি দশজন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হচ্ছে। যার ফলে ‘ফাটা’ ও ‘কেপি’তে তালেবানদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বৃদ্ধির পাশাপাশি আমেরিকার প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিয়ানমারে বাণিজ্যিক স্বার্থে চীন, ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব, আমেরিকা প্রভৃতি শক্তিধর দেশ চলমান রোহিঙ্গা নিধন উপেক্ষা করছে বটে, যখন একের পর এক ৯/১১-এর মতো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটবে তখন বোঝা যাবে আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। চলমান রোহিঙ্গা নিধনকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে সমালোচনা, নিন্দা ও ঘৃণা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্তিমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সেদেশের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বিপর্যস্ত হবে। এ কারণে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী অনাবাসী বার্মিজদেরও সেদেশে চলমান সংখ্যালঘু জাতিসত্তা নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। মিয়ানমারে জাতি নিধনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে তার প্রশংসা করেছে মিয়ানমার স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত এবং কিছুটা কোণঠাসা হয়েছে। যার কারণে তাদের প্রতিনিধি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ দফা প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের ‘যুদ্ধংদেহি’ মনোভাব বাংলাদেশকে বন্ধুহীন করবে, দেশে সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে এবং সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে পাকিস্তানের মতো আমেরিকা ও ন্যাটোর যুদ্ধক্ষেত্র বিস্তৃত হবে। এটি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের আইএসআইরর নীলনকশার অন্তর্গত। পাকিস্তান সেইসব আফগান ও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে যারা তাদের সন্ত্রাসী বলয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহানুভূতি যেহেতু বেড়েছে, বাংলাদেশের উচিত হবে ওআইসি ও পশ্চিমের দেশগুলোকে অনুরোধ করা যতদিন পর্যন্ত শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে না পারছে, ততদিন পর্যন্ত এর ভার যেন মিলিতভাবে বহন করা হয়। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের জন্য বাংলাদেশ ও বন্ধু দেশগুলো আন্তর্জাতিক আদালত (ওঈঈ)-এর শরণাপন্ন হতে পারে। মালয়েশিয়া গত সপ্তাহে ইটালির ‘পার্মানেন্ট পিপলস কোর্ট’কে আমন্ত্রণ জানিয়ে গণআদালত বসিয়ে মিয়ানমারের বিচার করেছে, যার রায়ে সে দেশের সরকারকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচারে বহু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা আগ্রহী হবে, যার উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা নিধনের উদ্যোগ নিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল গ্রহণ করেছে। তাদের প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে আউং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সেনাবাহিনী সে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় রয়েছে সুচির দল ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি’ (এনএলডি)। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সুচির দল জাতীয় সংসদের ৮৬% আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। দেশে ও বিদেশে সুচির জনপ্রিয়তা মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্বাভাবিকভাবেই সুনজরে দেখেনি। সেনাবাহিনী যত নির্যাতনই করুক রোহিঙ্গা সঙ্কট তীব্রতর করা এবং চলমান গণহত্যার দায় সুচিকেই নিতে হবে। সেনাবাহিনী এবং তার নির্বাচকম-লীকে তুষ্ট করার জন্য সুচি আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতনের ঘটনা যেমন অস্বীকার করছেন, তাদের যাবতীয় মৌলিক অধিকারও অস্বীকার করছেন। এরপর সামরিক বাহিনী যদি আবার ক্ষমতা দখল করে তখন সুচির পক্ষে হৃত ভাবমূর্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। এর বিপরীত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখিয়েছেন কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে জাতিবিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। এর ২০ বছর পর সর্বাধিক সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে তিনি মানবতার মানসপ্রতিমার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ মাসের শুরুতে ২০ দিনের ইউরোপ ও তুরস্কের কয়েকটি শহরে গিয়ে দেখেছি অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল। সরকারের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ১. রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তালিকা দ্রুত তৈরি করা এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করা, ২. সরকারী-বেসরকারী-আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বিত করা, ৩. স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ যতœবান হওয়া, যাতে কোন মহামারী ছড়িয়ে না পড়ে, ৪. বিশুদ্ধ খাবার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা এবং ৫. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করাÑ যাতে জামায়াত বা সমগোত্রীয়রা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব ও দারিদ্র্যের সুযোগ গ্রহণ করে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনেক সরকারী কর্মকর্তা বলছেন রোহিঙ্গারা ‘অনুপ্রবেশকারী’, তারা শরণার্থী নয়। রোহিঙ্গাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৃষ্ট সহানুভূতি হারাবে। রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’র মর্যাদা প্রদান সম্ভব না হলে তাদের আশ্রয়প্রার্থী (অংুষঁস ংববশবৎ) বলা যেতে পারে, ‘দেশছাড়া’ বলা যেতে পারে, কখনও অনুপ্রবেশকারী বলা যাবে না। আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন করে কোন দেশে ‘অনুপ্রবেশ’ একটি অপরাধ। রোহিঙ্গারা এ অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারে না। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নিরাপত্তার বিষয়কে। বান্দরবানের অধিকাংশ মাদ্রাসা এখন ‘আরএসও’সহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠনের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ গোটা পার্বত্য অঞ্চলের মাদ্রাসা এবং মসজিদ কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে, যাতে করে জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। বাংলাদেশ মিয়ানমারকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সীমান্তে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে। একই ধরনের প্রস্তাব ভারত, রাশিয়া ও চীনকেও বাংলাদেশ দিতে পারে। বাংলাদেশের এই তিন বন্ধু রাষ্ট্র কমবেশি জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের শিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালেই দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গী সন্ত্রাস দমনের জন্য যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিষয়টি এখন আরও জরুরী হয়ে উঠেছে। (সমাপ্ত)
×