ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমিনুল ইসলাম মিলন

পুলিশ আরও সাহসী হোন

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ৮ অক্টোবর ২০১৭

পুলিশ আরও সাহসী হোন

শাবাশ পুলিশ শাবাশ। আপনারা সাহসী হোন। জনগণ আপনাদের সাথে আছে। বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, পুলিশ ছুঁলে ৩৬ ঘা- এ অপবাদ থেকে আপনারা মুক্ত হোন। আমরা এটা শুনতে চাই না, আমরা চাই, পুলিশ আমাদের রক্ষক অভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালনকারী এ কথা সবাই বিশ্বাস করুক। শত অপবাদ দেয়া সত্ত্বেও জনগণের ইধপশ ড়ভ ঃযব সরহফ বা চেতনার পেছনে বিরাজ করে- পুলিশ আছে, আমি নিরাপদ। এ অনুভব আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। সত্যিকার অর্থে জনণকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, আমার বিপদের দিনে পুলিশ আমার বন্ধু। আইন-ভঙ্গকারীদের শায়েস্তা করতে পুলিশ সদা তৎপর। গত কয়েক দিনে ট্রাফিক বিভাগের এমন কয়েকটি তৎপরতা মিডিয়ার সৌজন্যে সারা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। হনগণ পুলিশকে বাহবা দিয়েছে। আইন ভঙ্গ করা সেটা ট্রাফিক আইন বা অন্য যে কোন আইনই হোক ইচ্ছে করলেই পুলিশ তাদের শায়েস্তা করতে পারে- এ প্রত্যয় জনগণের মাঝে আবার জারিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে আইনভঙ্গকারীর কোন জাত নেই, নেই কোন মর্যাদা। আইন কাউকেই Indemnity বা অব্যাহতি দেয়নি। তাই তো আমরা দেখি সংসদ সদস্য, আমলা-সচিব কেউ রেহাই পায়নি। আমরা চাই পুলিশের এই তৎপরতা অব্যাহত থাকুক, ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। তবে উল্টোপথে গাড়ি চালালেই কেবল ভঙ্গ না। ট্রাফিক আইন ভঙ্গের আরও হাজারো নতিজা আছে। ফিটনেস বিহীন গাড়ি, ভূয়া লাইসেন্সধারী গাড়ি চালক, বেপরোয়া গাড়ি চালনা, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংসহ অনেক বিষয়েই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘিত হয়। সড়কের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন থেকে এক শ্রেণির পরিবহন শ্রমিক নেতার হাতে বন্দি। কিন্তু দেখার কেউ নেই- বলার কেউ নেই। এই প্রথম দেখলাম, তৎপর সাহসি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মামলা করেছে, জরিমানা করেছে, সতর্ক করেছে, ভৎসনা করেছে। জনগণতো এটাই চায়। কিন্তু অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার, একজন আমলা-সচিব কী ভাবে পর পর দু’দিন একই স্থানে একই কায়দায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে উল্টোপথে গাড়ি চালানোর দুঃসাহস দেখায়! তিনি কি মনে করেছেন-তিনি সচিব- ট্রাফিক আইন তো দূরের কথা, অন্য কোনআইনও তার জন্য প্রযোজ্য নয়। তিনি সকল আইনের উর্দ্ধে। তার মনোভাবই সঠিক প্রমাণিত হলো। শাস্তি হলো বেচারা গাড়ি চালকের! জাতি যদি দেখতো-ওই আইন ভঙ্গকারী সচিবেরও শাস্তি হয়েছে-নিনেদ পক্ষে তাকে ও এসডি করা হয়েছে, তা হলে জনগণের প্রতীতি জন্মাতো যে, আইন সকলের জন্য সমান। কিন্তু আমাদের প্রশাসন যে সুযোগটি হারালো ফলে জনগণের কাছে বিষয়টি একটি চমক বা স্ট্যান্ট হয়ে থাকলো। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের অন্যতম একটি বড় উপাদান বে- আইন হর্ন বাজানো। ঢাকাসহ সমগ্র দেশবাসীর কাছে গাড়ির হর্ন শব্দ দূষণের অন্যতম একটি কারণ হিসাবে চিহ্নিত। বিশ্বের সকল উন্নত দেশে গাড়িতে হর্ন বাজানোর একটা অলিখিত নীতিমালা রয়েছে যা সবাই মেনে চলে। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ হর্ন বাজায় না। কিন্তু বাংলাদেশ এর বিপরীত। গাড়ির হর্ন জোরে না বাজালে চালক ও আরোহীর যেন সুখ নেই, তৃপ্তি নেই। কারণ আমি যে গাড়িতে করে যাচ্ছি, আমি যে ভিআইপি তা বোঝানোর জন্য বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজাতে হয়। এখন আর পুরানো হর্নে চলে না। তাই এর সাথে যোগ হয়েছে ‘হুটার’ নামে স্পেশাল হর্ন। যাকে অনেকে ভিআইপি হর্নও বলে। যার শব্দ অত্যন্ত কর্ষক, ঝাঁজালো ও কর্ণ বিদারক। ইদানিং অনেক বেসরকারি ধনীব্যক্তি যারা দামী দামী গাড়িতে চড়েন, তারাও এ ধরণের হর্ন তাদের গাড়িতে লাগিয়ে ফেলেছেন। এতে আর কিছু না হোক –ট্রাফিক পুলিশকে তো বোকা বানানো যায়! বাংলাদেশে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিষেধ। গাড়িতে হর্ন লাগানো, ব্যবহার, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি বিষয়ে লিখিত- অলিখিত নীতিমালা রয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের আমলাকূল তাদের দামী দামী গাড়িতে ‘হুটার’ নামে যে হর্ন ব্যবহার করছেন তা সম্পূর্ন বেআইনী। সরকার অনুমোদিত কোন সংস্থাই এটি ব্যবহারের অনুমতি দেয় নি। কিন্তু আমাদের দেশে দেদারসে এসব হর্ন যানবাহনে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা সুস্পষ্টভাবে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। বাস্তবতার নিরীখে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ, ফায়ার ব্রিগেড, এ্যাম্পুলেন্সসহ সুনির্দিষ্ট যানবাহনের ক্ষেত্রে আলাদা হর্ন, সাইরেন প্রভৃতি সংযোজনের বিধান রয়েছে। দেখি তো পুলিশ ভাইয়েরা, কাল থেকে অভিযানে নামুন, কেবল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বিশেষ কারণে অনুমোদিত ব্যক্তি/ সংস্থা ছাড়া আর সকল গাড়ি হতে ‘হুটার’ নামক দানবীয় হর্ন খুলে ফেলুন। একটু সাহসি হোন-কেউ আপনাদের কিছু বলতে পারবে না। আইন আপনাদের পক্ষে আছে, জনগণও পক্ষে থাকবে। আর একটি মারাত্মক নিয়ম লঙ্ঘন হচ্ছে গাড়িতে পতাকাদন্ড সংযোজন। যাদের গাড়িতে এই দন্ডটি বে- আইনীভাবে সংযোজিত আছে তারা সমাজ-রাষ্ট্রে ভিআইপি বলে পরিচিত। এদের গাড়ির সম্মুখের বাঁ কোণে জাতীয় পতাকা উড়ানোর জন্য পতাকাদন্ড গৌরবের সাথে শোভা যায়। যদিও এদের কারোরই সে পতাকাদন্ডে কোনদিন জাতীয় পতাকা লাগানোর সুযোগ হবে না। যতক্ষণ না তাদের কেউ পূর্ণমন্ত্রী পর্যায়ে শোভিত না হন। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার বুকে পূর্ণমন্ত্রী এবং পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের মাত্র ৪৪টি (কম/ বেশী) গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড্ডী ন থাকার কথা। গাড়ীতে পতাকাদন্ড শুধু এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমন কি প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং এঁদের সমমর্যাদার ব্যক্তিবর্গও রাজধানীতে গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের প্রাধিকারপ্রাপ্ত নন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার কার, জিপ মিলিয়ে কয়েখ হাজার গাড়িতে পতাকাদন্ড সংযোজিত অবস্থায় দেখা যায়। জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট আইন ও নিয়মাবলী রয়েছে। জাতীয় সংসদ দ্বারা অনুমোদিত এ আইন ‘ বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ রুলস ১৯৭২’ নামে পরিচিত যা ২০১০ সালের সর্বশেষ সংশোধনীসহ বর্তমানে ইধহমষধফবংয ঘধঃরড়হধষ অহঃযবস, ঋষধম ্ ঊসনষবস (ধসবহফসবহঃ) অপঃ ২০১০ নামে অভিহিত। কিন্তু আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কারোরই সে দিকে নজর নেই। বে- আইনিভাবে প্রাধিকার বহির্ভূত গাড়িতে পতাকাদন্ড সংযোজন ট্রাফিক আইন ভঙ্গের একটি বড় উদারহণ। প্রায় বছর দেড়েক আগে আগে একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘পতাকাদন্ডের যথেচ্ছাচার’ শিরোনামে একটি একটি কলাম লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম এর পরে রাজধানীতে পতাদন্ডধারী গাড়ী মাত্র ৪৪টির (কম/ বেশী) বেশী দেখা যাবে না। এর সাথে প্রতিমন্ত্রীম উপমন্ত্রী ও তাদের সমমানের ব্যক্তিকর্গ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১৫০টি পতাকাদন্ডধারী (পতাকা বিহীন) গাড়ি রাজধানীতে চলাচল করবে। কিন্তু না, সে আশার গুড়েবালি। হাজার হাজার পতাকাদন্ডধারী গাড়ি ও হুটার হর্ন শুরু রাজধানীতেই নয়, দেশের আনাচে ও চলাফেরা করছে। সংসদ সদস্য, মেয়র, বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, চেয়ারম্যানসহ কার গাড়িতে পতাকাদন্ড নেই? গাড়ীতে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের প্রাপ্যতা না তাকা সেত্ত্বও নিজ নিজ গাড়িতে পতাকাদন্ড লাগানোর হাকিকত কি? এইসব অনিয়ম লালন করার ফলে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে, আমাদের সর্বস্তরের কর্মকর্তা/ জনপ্রতিনিধিরা কি নির্দ্বিধায় অননুমোদিত সুবিধা ভোগ করেন। এখনই সুযোগ ট্রাফিক ভাইয়েরা। শুধু পূর্ণ মন্ত্রী, প্রতি-মন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী ও তাদের সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ এবং হাতেগোনা কয়েকটি প্রাধিকারপ্রাপ্ত গাড়ি ছাড়া অন্য সকল গাড়ি হতে পতাকাদন্ড নামিয়ে ফেলুন। আইনসম্মতভাবে কারোরই কিছুই বলার নেই। কালই এই অপারেশনে নামুন- প্রথমেই ধরুন কেবিনেট সেক্রেটারির গাড়ি, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ সকল সচিব, সংসদ সদস্যসহ সকল বেআইনিভাবে পতাকাদন্ড সংযুক্ত গাড়ি। সংষদ সদস্যদের নিজস্ব স্টিার আছে। জেলা- উপজেলা প্রশাসনের গাড়িতে কেন পতাকাদন্ড থাকবে। বাংলাদেশ তো এখন আর আগের মতো গরিব নয়, যে মন্ত্রীকে জেলা-উপজেলা সফরে গেলে জেলা-প্রশাসনের গাড়িতে উঠতে হয়।বাংলােেদশের সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্ব শাসিত বিভাগ- সংস্থার রয়েছে উন্নতমানের দামী গাড়ি। কেউ কারোর মুখাপেক্ষী নয়। একান্তই প্রয়োজন হলে পতাকাদন্ড সংযোজন কোন কঠিন- ব্যয়বহুল বা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো এ ডর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ বা আইন-শঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাহস করে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেনি। ফলে, আইন- ভঙ্গের এক কালো- সংস্কৃতি বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে। এই প্রথমট্রাফিক পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। জনগণ চায় এ উদাহরণ থানা, জেলা, মেট্রোপলিটন পুলিশের অন্যান্য বিভাগেও ঝড়িয়ে পড়ুক। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, জমি দখলসহ সকল অপরাধ দমনে সমগ্র পুলিশ বাহিনী তৎপর হোক। কোন দলী, ধর্মীয়, অঞ্চলগত প্রভাবের কাছে আপনারা মাথা নত করবেন না। সরকার আপনাদের পক্ষে থাকবে-জনগণ আপনাদের পক্ষে থাকবে, আপনারা ফিরে পাবেন আপনাদের হারানো ইমেজ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আত্মগ্যাগ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনন্য গৌরবগাথা। এর প্রতি সম্মান জানাতেই আপনাদের আরও সাইসি হয়ে উঠতে হবে। জনগণ অধীর আগ্রহে আপনাদের সাহসি উদ্যোগের প্রতীক্ষায় আছে। শাবাশ পুলিশ শাবাশ, আরও সাহসি হোন। লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা [email protected]
×