ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিথ্যা মূল্য ঘোষণায় ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ

আইনী জটিলতায় ঝুলে গেল বিএটিবির কর আদায় প্রক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৩ অক্টোবর ২০১৭

আইনী জটিলতায় ঝুলে গেল বিএটিবির কর আদায় প্রক্রিয়া

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ গত পাঁচ বছরে মিথ্যা মূল্য ঘোষণায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটি) বিরুদ্ধে। আর এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মামলাটি বিচারাধীন থাকার মধ্যেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় বিএটি। কিন্তু এনবিআরের পক্ষ থেকে বিএটিকে একটি ভাল করদাতা প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রতিবছর সরকারী কোষাগারে মোটা অঙ্কের রাজস্ব জমা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বিষয়টি বিচারাধীন এবং আইন আদালতে নিষ্পত্তি করা উচিত। ফলে আইনী জটিলতায় দীর্ঘমেয়াদে ঝুলে গেল ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর কর আদায় পক্রিয়া। বিদেশী কোম্পানি হিসেবে বিএটিবির প্রতি যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা মানছে না কোম্পানিটি। ফলে প্রতি মাসেই শত কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বর্তমানে দেশে সিগারেটের বাজার প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে নিম্নস্তরের সিগারেটের দখলে রয়েছে মোট বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ। সে হিসেবে নিম্নস্তরের সিগারেটের বাজার প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল বিএটিবির দখলে আছে নিম্নস্তরের বাজারের ৬৩ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ১১ কোটি টাকার নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি করে। প্রতি প্যাকেটে ১০ শলাকা করে থাকলে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটি নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি করে সাড়ে ৪২ কোটি প্যাকেট। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রিস্টল ও পাইলট সিগারেট বিক্রির ওপর অতিরিক্ত ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট আরোপ করে বিএটিবির কাছে দাবিনামা জারি করে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-মূসক)। এতে অভিযোগ করা হয়, ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জানুয়ারি সময়কালে বিএটিবি স্তরের চেয়ে নিচের দামে ব্রিস্টল ও পাইলট সিগারেট বিক্রি করেছে। দাম কমানোর ফলে এনবিআর ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা কম রাজস্ব পেয়েছে বলে দাবিনামায় উল্লেখ করা হয়। যদিও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করেছে- এ ধরনের কোন প্রমাণ নেই বলে বিএটিবি জানায়। জানা গেছে, ভ্যাট আইনে সিগারেটসহ কোন পণ্যের মূল্য নির্ধারণের জন্য রাসায়নিক পরীক্ষার বিধান নেই। এরপরও বিএটিবির দুটি ব্যান্ডের সিগারেটের ওপর অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা সংস্থার (বিসিএসআইআর) মাধ্যমে রাসায়নিক পরীক্ষা করে এনবিআর। বিএটিবির পক্ষ থেকে এই পরীক্ষার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করা হয়। এর প্রেক্ষিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, এ ধরনের পরীক্ষার জন্য একমাত্র যোগ্য প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই। রায়ে শুধু বিএটিবি নয়, সকল কোম্পানির সিগারেট বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে পরীক্ষার নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে দুটি ব্র্যান্ডের সিগারেট পরীক্ষা করা হলে বিসিএসআইআরের রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হয়। জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছিল এনবিআর। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট ভূতাপেক্ষভাবে নির্ধারণ ও আদায়ের দাবিনামা জারি ও কার্যকর করার আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত কোন সুযোগ নেই। কারণ যে পণ্য ইতোমধ্যে বিক্রি করা হয়ে গেছে, ভোক্তা বা ক্রেতার কাছ থেকে সেই পণ্যের ওপর নতুন করে ভ্যাট আদায় করা সম্ভব নয়। বিএটিবি কর্মকর্তারা জানান, তিন বছর ধরে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। এ কারণে এনবিআরের তৎকালীন চেয়ারম্যানের পরামর্শে উচ্চ আদালতে রিট করে বিএটিবি। আগামী ৫ অক্টোবর এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়। কোম্পানির পক্ষ থেকে ব্রিটিশ হাইকমিশনকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়। তাদের দাবি, এনবিআরের বিশাল ভ্যাট পরিশোধের দাবির সঙ্গে কোম্পানির টিকে থাকার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এনবিআর যে ১৯২৪ কোটি টাকা দাবি করছে, তা কোম্পানিটির এক বছরের কর পরবর্তী মুনাফার তিন গুণেরও বেশি। ক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করা না হলেও, বিপুল পরিমাণ এই ভ্যাট পরিশোধ করতে হলে কোম্পানির দেউলিয়া হয়ে যাবেÑযা এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ব্রিটিশ বিনিয়োগের বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের প্রশ্ন দেখা দেয়ায় আদালতের বাইরে সমঝোতা বৈঠক করে বিরোধ নিষ্পত্তির অনুরোধ জানিয়ে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে ব্রিটিশ হাইকমিশন। চিঠিতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টি সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয় আন্তরিক বলে আশা প্রকাশ করা হয়। এতে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের আইনগত মতামত উল্লেখ করে বলা হয়, ‘সিগারেট হলো কনজ্যুমার পণ্যÑ যার দামের মধ্যেই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেহেতু সিগারেট বিক্রির সময়ই তা পরিশোধ করা হয়, তাই পূর্ববর্তী ঘটনার প্রেক্ষাপটে উৎপাদকের (বিএটিবি) কাছে ভ্যাট দাবি করার কোন সুযোগ ছিল না। চিঠিতে আদালতের বাইরে বিরোধটি নিষ্পত্তির জন্য অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগ কামনা করে বলা হয়, বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) সাধারণত কম আনুষ্ঠানিক, কম ব্যয়বহুল এবং এতে সময়ও কম লাগে।
×