ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কানিজ ইসমত জাহান জিতু

মুশফিকদের প্রোটিয়া চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মুশফিকদের প্রোটিয়া চ্যালেঞ্জ

এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন মাইলফলক অর্জিত হবে- এমন ঘোষণা দিয়েই অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম তার সতীর্থদের নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেছেন। দুই টেস্টের সিরিজ দিয়ে প্রোটিয়া ভূমিতে পূর্ণাঙ্গ সিরিজের চ্যালেঞ্জ শুরু। প্রায় ৯ বছর পর আবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ২০০৮ সালের নবেম্বরে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে গিয়েছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে। সেই দলে ছিলেন বর্তমান টেস্ট স্কোয়াডে থাকাদের মধ্যে তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস ও মুশফিকুর রহীম। বাকিদের কারও দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলার সুযোগ হয়নি। আর এবার দলের সঙ্গে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানও না থাকায় আরেকটি বড় ঘাটতি আছে। টানা খেলার ক্লান্তির জন্য বিশ্রাম চেয়ে নিয়েছেন সাকিব। এরপরও মুশফিকের এমন ঘোষণা কিছুটা উচ্চাকাক্সক্ষাই বলা যেতে পারে। কারণ বিদেশী কোন দলই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তেমন সুবিধা করতে পাওে না। আর বাংলাদেশ দল তো সর্বশেষবারও গিয়ে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারের চরম লজ্জা নিয়ে ফিরেছে। তবে গত দুই বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেটেও দুরন্ত হয়ে ওঠা টাইগাররা এখন বেশ আত্মবিশ্বাসী। বিশেষ করে গত মার্চে শ্রীলঙ্কার কঠিণ পরিবেশেও জয় পাওয়া এবং ঘরের মাটিতে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয়ার পর এখন যেকোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নামার আগে উজ্জীবিত, আত্মপ্রত্যয়ী সব ক্রিকেটার। তবে সেটা এখন মাঠে করে দেখানোর চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে আরেকটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলবে আইসিসির নতুন করে প্রণীত কিছু নিয়ম-নীতি। এই সিরিজেই তা চালু হবে। এবার সফরে ২ টেস্ট, ৩ ওয়ানডে ও ২ টি২০ ম্যাচের সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ দল। দুইভাগে বিভক্ত হয়ে এবার দক্ষিণ আফ্রিকা রওনা হওয়া দলটি বাংলাদেশ সময় অনুসারে দু’দিনের মধ্যেই এক হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা রওনা হওয়া দলটির সঙ্গে যেতে পারেননি পেসার রুবেল হোসেন ভিসা জটিলতায় এবং তামিম ইকবাল আইসিসি বিশ্ব একাদশের সঙ্গে পাকিস্তান সফরে থাকায়। তবে তামিম দু’দিন পরই দলের সঙ্গে যোগ দেন এবং সফরের একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচও খেলতে নামেন। বেনোনিতে তিনদিনের সেই প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয়নি রুবেলের। তিনি ম্যাচের তৃতীয় দিন দলের সঙ্গে যোগ দেন সেটা শেষ হওয়ার পর। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে টানা তিনদিন বেনোনির উইলোমুর পার্কে অনুশীলন করেই প্রস্তুতি ম্যাচে স্বাগতিকদের আমন্ত্রিত একাদশের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে নামে বাংলাদেশ দল। সেই দলটিতে পরিচিত কোন মুখই ছিল না। বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংটা ভাল হলেও বড় ধাক্কা হয়ে আসে প্রথমদিনেই নির্ভরযোগ্য ওপেনার তামিমের বাঁ পায়ের হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি। তিনি আর ম্যাচেই নামেননি। গ্রেড ওয়ান টিয়ার ধরা পড়ার কারণে শঙ্কা তৈরি হয়। কারণ এ ধরনের ইনজুরি সারতে সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। তবে জাতীয় দলের ফিজিও থিহান চন্দ্রমোহন জানিয়ে দেন তামিমকে নিয়ে শঙ্কা নেই, প্রথম টেস্টেই খেলবেন তিনি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান এ বাঁহাতি ওপেনার। তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক রান ও সেঞ্চুরির মালিক। আর প্রোটিয়া ভূমিতে তার খেলার অভিজ্ঞতাও আছে। তৃতীয় ওপেনার হিসেবে দলের সঙ্গে থাকা ইমরুল কায়েসও ২০০৮ সালের সফরে ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নিজের ফর্মের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন। তবে প্রস্তুতি ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ এক অর্ধশতক হাঁকিয়ে নিজেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। এটা দলের জন্য বড় সুসংবাদ। এছাড়া শ্রীলঙ্কা সফরের দ্বিতীয় টেস্টে একাদশ থেকে ছিটকে পড়া তিন নম্বর পজিশনের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক সৌরভ এবার ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ছিলেন উপেক্ষিত। অনেক সমালোচনার পর দ্বিতীয় টেস্টে খেলার সুযোগ পেলেও ব্যাটিং পজিশন ঠিক ছিলনা তার। খুব বড় কোন ইনিংসও খেলতে পারেননি। তবে প্রস্তুতি ম্যাচে তিনি রানে ফিরেছেন, একটি দারুণ অর্ধশতকও এসেছে তার ব্যাট থেকে। দীর্ঘদিন পর টেস্ট দলে ফিরেছেন অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ব্যাট হাতে স্বীকৃত এ ক্রিকেটার বল হাতেও কার্যকর সেটার প্রমাণ তিনি টেস্টের এক ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কন্ডিশনে মাহমুদুল্লাহ বরাবরই বেশ ভাল। যেমনটা তিনি করে দেখিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে। তাই সাকিবের অনুপস্থিতিতে তার ওপর বিশেষ আস্থা অধিনায়ক মুশফিকের। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচের উভয় ইনিংসে ব্যর্থ ছিলেন এ মিডল অর্ডার। তবে টানা ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরতে থাকা ওপেনার সৌম্য সরকারও রানে ফিরেছেন প্রথম ইনিংসে অর্ধশতক হাঁকিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে পারেননি ফিল্ডিংয়ের সময় কাঁধে ব্যথা পাওয়ায়। তবে তার ইনজুরি একেবারেই সাধারণ মানের, তাই চন্দ্রমোহন বেশ জোরের সঙ্গেই জানিয়েছেন পচেফস্ট্রমে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম টেস্টেই খেলতে পারবেন তিনি। ২৮ সেপ্টেম্বর এই শহরের সেনওয়েস পার্কে নামবে বাংলাদেশ দল প্রথম লড়াইয়ে। প্রস্তুতি ম্যাচে চিরাচরিতভাবেই ফিল্ডিংয়ে দুর্দশা ছিল, ৪-৫টি ক্যাচ মিস করেছেন দেশের ক্রিকেটাররা। আর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে ছিল বেহাল দশা। সাব্বির রহমানের উভয় ইনিংসে খেলা অর্ধশতকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ। পেসারদেরও ঘাম ঝরেছে প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে নিতে অথচ প্রোটিয়া অখ্যাত স্পিনারদের বলে উইকেট বিলিয়ে এসেছেন ব্যাটসম্যানরা। মূল লড়াইয়ে এসব কাটিয়ে ওঠাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের বর্তমান দলটির মাত্র তিন ক্রিকেটারের অভিজ্ঞতা আছে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে টেস্ট খেলার। অধিনায়ক মুশফিক, ওপেনার তামিম ও ইমরুল খেলেছিলেন ২০০৮ সালের নবেম্বর মাসে হওয়া সফরে। সেটাই সর্বশেষ প্রোটিয়া ভূমিতে বাংলাদেশ দলের শেষবার খেলা। তবে এর মধ্যে আরেকটি সিরিজ হয়েছে দু’দলের। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিল প্রোটিয়া শিবির। দুই বছর পর আবার মুখোমুখি হচ্ছে দু’দল। বাংলাদেশ দলের জন্য এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে কোনবারই ভাল কোন স্মৃতি ছিল না। এবার অবশ্য নতুন কোন মাইলফলক অর্জিত হবে বলেই ঘোষণা দিয়ে গেছেন অধিনায়ক মুশফিক। তবে কথার সঙ্গে কাজের প্রয়োগের জন্য ভিন্ন পরিবেশ এবং উইকেটের ভিন্নতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশ দলকে। এবার দলের সঙ্গে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব নেই। তিনি টানা খেলার ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কাছ থেকে বিশ্রাম চেয়ে নিয়েছেন। ফলে দুই টেস্টের জন্য ঘোষিত দলে নেই তিনি। প্রথম টেস্টে সে কারণে নিশ্চিতভাবেই খেলবেন না সাকিব। তবে তিনি চাইলে দ্বিতীয় টেস্টেই খেলার জন্য সুযোগ রয়েছে তার। এমনটাই দল ঘোষণার সময় জানিয়েছিলেন নান্নু। কিন্তু সেটা না হলে শেষ পর্যন্ত ওয়ানডে সিরিজে দলের সঙ্গে যোগ দেবেন সাকিব। সুতরাং তাকে ছাড়াই এবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে হবে বাংলাদেশ দলকে। সদ্যসমাপ্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করে টাইগাররা ঘরের মাটিতে। আর প্রথম টেস্টে অসিদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন সাকিব। মিরপুর টেস্টে বল হাতে ১০ উইকেট শিকারের পাশাপাশি প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে খেলেছিলেন ৮৪ রানের দারুণ এক ইনিংস। আর ২০০৮ সালে সর্বশেষবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দুই টেস্টে ব্যাট হাতে না জ্বলতে পারলেও বল হাতে ভালই করেছিলেন। ব্লুমফন্টেইনে হওয়া প্রথম টেস্টে ৫ উইকেট এবং দ্বিতীয় টেস্টে ৬ উইকেট শিকার করেছিলেন এ বাঁহাতি স্পিনার। তবে উভয় টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হার দেখেছিল বাংলাদেশ। এবার তাই অভিজ্ঞ সাকিবকে ছাড়া বড় রকমের চ্যালেঞ্জেই পড়তে হবে মুশফিকদের। তবে এ বিষয়ে অধিনায়ক বলে গেছেন, ‘সাকিব না থাকা অবশ্যই অনেক বড় ঘাটতি, তার বিকল্প নেই। তার পরিবর্তে আমাদের একজন ব্যাটসম্যান ও একজন বোলার নিতে হয়। তবে এটাও ঠিক সাকিবকে ছাড়াও আমরা জিতেছি ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। আর রিয়াদ ভাই (মাহমুদুল্লাহ) দলে আসায় কিছুটা সেই ঘাটতি পূরণ হয়েছে বলেই মনে করি।’ ২৮ সেপ্টেম্বর ম্যাচের আগে আরও তিন দিন অনুশীলন করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। নিজেদের মানিয়ে নেয়া এবং উইকেট পরিস্থিতি বুঝে ওঠার মিশনটা ভালভাবেই শেষ হয়েছে। পেসারদের নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ। তবে স্কোয়াডে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়া পাঁচ পেসার- মুস্তাফিজুর রহমান, শফিউল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেন ও শুভাশিষ রায় মোট ৪৭ টেস্ট খেলেছেন যার মধ্যে ২৪টিই খেলেছেন রুবেল। তারা কেউ আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলেননি। আর প্রথম টেস্টের সেনওয়েস পার্কে এর আগে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে তিনটি। এর মধ্যে ২০০২ ও ২০০৮ সালে দুটি ওয়ানডে এবং ২০০২ সালে খেলেছিল একটি মাত্র টেস্ট ম্যাচে। অর্থাৎ দীর্ঘ ১৫ বছর পর আবার এখানে টেস্ট খেলতে নামবে বাংলাদেশ দল। এ কারণে উভয় দলেরই এখন আর কোন ক্রিকেটারই নেই যার সেনওয়েস পার্কে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা আছে পরস্পরের বিরুদ্ধে। অবশ্য, স্বাগতিক দল হিসেবে প্রোটিয়াদের কাছে ভেন্যুটি খুবই পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশের এই দলটির জন্য একেবারেই আনকোরা নতুন ভেন্যু পচেফস্ট্রমের সেনওয়েস পার্ক। ১৫ বছর আগে (২০০২, অক্টোবর) এখানে খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতৃত্বে টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ এবং ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল। সেই দলের এখন আর কেউ নেই বর্তমান স্কোয়াডে। তবে ২০০৮ সালে এই ভেন্যুতে হওয়া ওয়ানডে ম্যাচে খেলেছিলেন তামিম, মুশফিক ও ইমরুল। তারা ফিরেছেন ৯ বছর পর। আর টেস্ট দল হিসেবে ফেরা ১৫ বছর পর। এখানে প্রস্তুতি ম্যাচের মতোই উইকেট হবে। আবহাওয়া বাংলাদেশের মতোই প্রায়। তবে তাপমাত্রা কিছুটা কম। বেনোনির প্রস্তুতি ম্যাচে ছিল কিছুটা ধীরগতির উইকেট, সেখানে প্রোটিয়া স্পিনাররা সুবিধা পেলেও এমন কন্ডিশনে সবসময়ই পেসাররা সফল। তাই সেনওয়েস পার্কে বেনোনির মতো উইকেট থাকলেও পেসারদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সবমিলিয়ে নিজেদের বর্তমান অবস্থান, পারফর্মেন্স এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুসারে প্রত্যাশার চাপে থাকা মুশফিকদের জন্য কঠিণ চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে। এর সঙ্গে যোগ হবে আইসিসির নতুন কিছু নিয়ম। সেই নিয়মে ব্যাটের কাঠামোয়, রানআউটের পদ্ধতিসহ কিছু বিষয়ে আসছে ভিন্নতা। এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে টাইগাররা কতখানি সুবিধা করতে পারে সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
×