ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আনু মাহ্মুদ

শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারছে না ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারছে না ব্যাংক

খেলাপী ঋণের ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা সরকারী ব্যাংকগুলোর। দেশের মোট খেলাপী ঋণের প্রায় অর্ধেকই সরকারী আট ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ১২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপী ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১২ শতাংশ হয়ে যাওয়া, রীতিমতো ভয়ানক বিষয়। এ ধরনের প্রবণতা ব্যাংকিং খাতসহ গোটা অর্থনীতিকেই চরম সমস্যার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তাই খেলাপী ঋণের রাশ টেনে ধরতে শীঘ্রই কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তা না করে খেলাপী ঋণের ভার সইতে না পারা সরকারী ব্যাংকগুলোকে পুনর্মূলধনের নামে বছর বছর করদাতাদের টাকা দিয়ে যাওয়া কোনভাবেই ঠিক হবেনা। এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, খেলাপী ঋণ দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, এটা উদ্বেগজনক বিষয়। খেলাপী ঋণ এত পরিমাণে বেড়ে গেলে ব্যাংকের অনেক টাকা আটকে যায়। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। মূলধন ঘাটতি হতে পারে। তাছাড়া খেলাপী ঋণ বেশি হলে অনেক টাকা প্রভিশন রাখতে হয়। ফলে ব্যাংকগুলো এ খরচ সামাল দিতে ঋণের সুদ কমাতে পারে না। এতে নতুন উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ পড়ে। কারণ নতুন উদ্যোক্তারা উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে গেলে সমস্যায় পড়ে। এ ছাড়াও খেলাপী ঋণের বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকিং খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মার্চশেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশই খেলাপী। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের তুলনায় খেলাপী ঋণের পমিাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অল্প কিছু ঋণ খেলাপী গোটা ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে মোট খেলাপী ঋণে ৩৫ শতাংশই নিয়েছে ১২০ জন। এবারই প্রথম জাতীয় সংসদে শীর্ষ একশ ঋণ খেলাপীর নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এ ধরনের প্রবণতাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) স্থির মূল্যে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকৃত খেলাপী ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এ হার অনেক কম। ভারতের জিডিপির পরিমাণ দুই দশমিক ০৭৪ ট্রিলিয়নর ডলার (প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। আর তাদের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। অর্থাৎ ভারতের জিডিপির ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপী ঋণ। যা বাংলাদেশ থেকে অনেক কম। এরপরও ভারত সরকার খেলাপী ঋণ নিয়ে বেশ চিন্তিত। তারা খেলাপী ঋণ আদায়ে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। এমনকি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ খেলাপীকে বিদেশ থেকে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় তুলে আনার নজিরও স্থাপন করেছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বলছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত এই আট বছরের মধ্যে সাত বছরই পুনর্মূলধনের নামে ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দিয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ অর্থবছরে সরকার প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা যোগান দিয়েছে সরকারী ব্যাংকগুলোকে। করের টাকায় খেলাপী ঋণের এ অর্থের যোগান দেয়াকে নৈতিকভাবে সমর্থন করেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এভাবে সরকারী ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়া হলে করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন। তা ছাড়া সরকারী ব্যাংকগুলোও খেলাপী ঋণ বন্ধে কঠোর হবেন না। আর এখানে টাকা দিতে না হলে এই টাকা সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামাজিক খাতে ব্যয় করতে পারত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত এপ্রিলের (২০১৭) হিসাবে, ব্যাংকগুলোর কাছে সব মিলিয়ে ২ লাখ ৬২ হাজার ২২৬ কোটি টাকা ছিল। এর মধ্যে নগদও সংবিধিবদ্ধ কারণে জমা রাখতে হয় ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ ছিল ৬ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। মুনাফার জন্য বাকি অর্থ ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন বন্ড ও বিলে। ঋণের চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ ও নগদ অর্থের পরিমাণ দিনে দিনে কমছে। আর্থিক মুনাফার আশায় শেয়ারবাজারে যাচ্ছে মানুষ। ২০১৬ সালেও দেশের দুই বাজারে গড় লেনদেন ছিল ৫০০ কোটি টাকার আশাপাশে। তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই লেনদেন বাড়তে শুরু করে। বাজেট ঘোষণার পর গড় লেনদেন হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই পরিচালিত হয়। ঋণ করে চলার যে ধারা তৈরি হয়েছিল, তা পাল্টে যাচ্ছে। গত বছর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটছে মানুষ। ২০১৬ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত বেড়ে হয়েছে ৩৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ হয়েছে ৫৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এদিকে গত মে পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৪৬ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যদিও গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।
×