ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বাড়ছে উষ্ণতা ॥ বাড়ছে ঝড় ও বন্যা

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাড়ছে উষ্ণতা ॥ বাড়ছে ঝড় ও বন্যা

এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতি বৃষ্টিজনিত বন্যা এক প্রলয়ঙ্করী রূপ নিয়ে হাজির হয়। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালে বন্যায় কমপক্ষে ১২শ’ জনের প্রাণহানি ঘটে ও লাখ লাখ লোক গৃহহারা হয়। শত শত কোটি টাকার সম্পদ ও ফসল বিনষ্ট হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা কয়েক কোটি। আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনে হারিকেন হার্ভের কারণে সৃষ্ট অতি বৃষ্টিজনিত বন্যায় কমপক্ষে ৪০ জন মারা গেছে এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ৩ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। একই মাসে (আগস্টে) সিয়েরা লিওনে প্রবলবর্ষণে ভূমিধসে কমপক্ষে এক হাজার নরনারী-শিশুর মৃত্যু হয়েছে- যদিও প্রকৃত সংখ্যা কখনই জানা যাবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ফল এই ঝড়-বন্যার প্রকোপ কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সেই উপায় বের করতে গিয়ে দিশেহারা। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল-এই অঞ্চলটি পৃথিবীর স্থলভাগের সামান্য অংশ হলেও এখানে লোকবসতি বেশি। বিশ্বের প্রতি দশ জনের একজন এখানে বাস করে। ফলে বন্যা এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি বছরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহের পর বর্ষার আগমনকে জনগোষ্ঠী স্বস্তি নিয়ে স্বাগত জানালেও বন্যার করাল গ্রাস তাদের জীবনকে অভিশপ্ত করে তোলে। এবারের আগস্টে বন্যায় বাংলাদেশে দেড় শ’রও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়। প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ লোক বন্যাদুর্গত হয়েছে। গৃহহারা হয়েছে অসংখ্য মানুষ। ব্রহ্মপুত্রের পানির প্রবল তোড়ে বেশ কিছু বাঁধ ভেঙ্গেছে। রেললাইন ভেঙ্গে দূরে সরে গেছে। ফলে ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষকের পক্ষে নতুন করে ধানের চারা রোপণ করার উপায় নেই। বিশ্বের চতুর্থ ধান উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ মোটামুটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এবার দু’দফা বন্যায় উৎপাদন মার খেয়েছে। মজুদে টান ধরেছে। ফলে দেশটিকে এখন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। ভারতে এবারে বন্যায় প্রাণহানি হয়েছে প্রায় এক হাজার। এদের অর্ধেকই মারা গেছে দেশের দরিদ্রতম রাজ্য বিহারে। সেখানে ১ কোটি ২০ লাখ লোক বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে ওঠে। ২৯ আগস্ট ৩৩ সেন্টিমিটার বৃষ্টিতে মুম্বাই কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ৩১ তারিখে সেখানে একটি ভবন ধসে পড়ে। নেপালেও বন্যায় দেড় শ’র মতো লোক প্রাণ হারায়। প্রলয়ঙ্করী বন্যা এ অঞ্চলে আগেও হয়েছে। ২০০৭ সালের বন্যায় ভারতে ও বাংলাদেশে ৩ হাজার ৩শ’ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১০ সালের বন্যায় পাকিস্তানে মারা যায় ২ হাজার ১০০ জন। ২০১৩ সালে শুধু ভারতেই বন্যায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার লোকের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে এ বছরের বন্যা ১৯৯৮ সালের পর থেকে সবচেয়ে ব্যাপক। সে সময় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এক হাজারেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৩ কোটি লোক। ১৯৭৪, ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালেও প্রবল বন্যা হয়েছিল। রাজধানী ঢাকাও জলমগ্ন হয়েছিল। বর্ষার ধারা পাল্টেছে তবে উপমহাদেশে এবারের বর্ষা মৌসুমের বর্ষণ অন্য বারের চেয়ে বেশি হয়েছে এ কথা বলার উপায় নেই। ভারতের উত্তরাঞ্চলজুড়ে বৃষ্টিপাতের যে দীর্ঘমেয়াদী গড় আছে তার সঙ্গে তুলনা করলেই তা চোখে পড়বে। এপ্রিলে অসমে, জুলাইয়ে গুজরাটে, আগস্টে বিহারে এবং অতি সম্প্রতি মুম্বাইয়ে বন্যা হওয়া সত্ত্বেও এবারের বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এখনও গড় হিসাবের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। এটা একটা পরিবর্তিত প্যাটার্নের অংশ। ভারত উপমহাদেশে যত বৃষ্টিপাত হয় তার ৮৫ শতাংশই হয় বর্ষা মৌসুমে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে। দু’-এক বছর ধরে খরা চলার পর বর্ষার ধারা প্রায় স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসায় উপমহাদেশজুড়ে একটা স্বস্তির কারণ ঘটে। তবে একই সময় আরেকটা ব্যাপারও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। তা হলো স্বল্প সময়জুড়ে হঠাৎ করে মুষলধারে বর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সেটা ঘটছে জুলাই ও আগস্ট মাসে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ডের গবেষকদের প্রকাশিত ‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ নামে এক নিবন্ধে বলা হয় যে দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষা মৌসুমে অতিমাত্রায় আর্দ্র বায়ু প্রবাহের তীব্রতা এবং ঘন ঘন অতিমাত্রায় শুষ্ক বায়ু প্রবাহ ১৯৮০ সাল থেকে বেড়ে চলেছে। ঝড় ও বন্যা বাড়ছে ওদিকে হারিকেন হার্ভের প্রভাবে দক্ষিণ টেক্সাসে প্রবল বর্ষণজনিত যে বন্যা হয়েছে আমেরিকার ইতিহাসে তা অতি ভয়াবহ। হিউস্টনের হ্যারিস কাউন্টিতে এক শ’ ঘণ্টায় সাড়ে চার ট্রিলিয়ন লিটারেরও বেশি পানি ঝরেছে। এই বৃষ্টিপাত ৮ বছরের এক দাঁড়িয়ে থাকা শিশুকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্যই যথেষ্ট। ২৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ২৯ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত ৫০ ইঞ্চিরও (১২৭ সেমি) বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। হার্ভের বৃষ্টিপাত সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়া গেলে সমভূমির সব থেকে উঁচু জায়গাটা ১ সেন্টিমিটার পানিতে তলিয়ে যেত। আবহাওয়া সম্পর্কিত যত বিপর্যয় ঘটে থাকে তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী ঝড় ও বন্যা এবং সেগুলো উত্তরোত্তর বাড়ছে। সারা বিশ্বে ঝড় ও বন্যা ১৯৮০ সালে ঘটেছিল প্রায় ২শ’টি। আর গত বছর তা ৬শ’ ছাড়িয়ে গেছে। এগুলোর কারণে ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ছে এবং সেটা সারা বিশ্বেই। এক হিসাবে দেখা যায় যে ১৯৭০ সালে ঘরবাড়িতে থাকা যত মানুষ হারিকেনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল ২০১০ সালে তাদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। অধিক থেকে অধিক সংখ্যক লোক উপকূলীয় শহরগুলোতে বসবাসের জন্য চলে যাওয়ায় এই সংখ্যা বাড়ছে। জাতিসংঘের হিসাবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঝড় ও বন্যায় ধ্বংসলীলার পরিমাণ ১০৭ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে হারিকেনের ক্ষয়ক্ষতি প্রকৃত হিসাবে বছরে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে। আর ইউরোপে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ২০৫০ সাল নাগাদ ৫ গুণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বন্যা ও সামুদ্রিক ঝড়ের প্রকোপ বাড়ার একটা কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। ঘন ঘন ও তীব্র আকারে হারিকেনের প্রাদুর্ভাবের তারতম্য প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে। বিগত দশকে আমেরিকায় অস্বাভাবিক কম হারিকেন হয়েছে। তার পরও জলবায়ু পরিবর্তনের একটা প্রভাব হিসেবে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে ঝড় ও বন্যা বাড়ছে। উষ্ণতা বাড়ার কারণে সাগরও উষ্ণ হচ্ছে। তার ফলে সাগরের জলরাশি দ্রুততর হারে বাষ্প হয়ে উবে যাচ্ছে। উষ্ণ বায়ু অধিকতর জলীয় বাষ্প ধারণ করে। আবহাওয়া ব্যবস্থার অভ্যন্তরে এই জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হলে তা থেকে এনার্জি নির্গত হয়। এই এনার্জিই ঝড়ের তা-বে এবং বন্যার তীব্রতার ইন্ধন যোগায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে সামুদ্রিক ঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসও বেড়ে যায়। ফলে বন্যা হয়। হারিকেন হার্ভে অস্বাভাবিক বিধ্বংসী রূপ ধারণ করার একটা কারণ হলো স্থলভাগে এসে আছড়ে পড়ার আগে সহসাই এটা শক্তি অর্জন করেছিল। তারপর স্থলভাগেই দীর্ঘ সময় থেকে গিয়ে হিউস্টনে প্রবল বৃষ্টি ঝরিয়ে আবার মেক্সিকো উপসাগরে ফিরে গিয়েছিল। সরকারগুলোর ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনাও বন্যার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। ব্যাপক নগরায়নের ফলে খালি জমি থাকছে না। কংক্রিটে ছেয়ে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টির পানি টেনে নেয়ার মতো মাটি থাকছে না। হিউস্টনের বন্যা এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ২০০০ সাল থেকে সেখানে নগরীর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বাড়তি ১৮ লাখ লোকের জন্য সেখানে বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে। উপকূলীয় প্রেইরি অঞ্চল আগে বৃষ্টির পানি শুষে নিত। সেখানে এই নতুন আবাসনের ফলে মাটি কংক্রিটে ছেয়ে গেছে যার ফলে বৃষ্টির পানি শুষে নেয়ার উপায় নেই। সর্বোপরি আছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিশাপ। এই অভিশাপের কারণে বৃষ্টিবিধৌত অঞ্চলগুলোতে বর্ষণ বেশি হচ্ছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রবণ অঞ্চলগুলোতে ঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আশু যে কাজগুলো করণীয় তা থেকে পিছিয়ে থাকছে বিশ্বের দেশগুলো। তার ফলে বিরূপ প্রভাব এসে পড়ছে কোটি কোটি মানুষের জীবনে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×