ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হতাশ চাষী ও ব্যবসায়ীরা

মেহেরপুরে পাটের বাজারে ধস

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মেহেরপুরে পাটের বাজারে ধস

সংবাদদাতা, মেহেরপুর ॥ সরকারী বেঁধে দেয়া দামে পাট বিক্রি করতে পারছেন না মেহেরপুরের পাট চাষীরা। মণ প্রতি ৯শ থেকে ১ হাজার টাকা দরে পাট বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। ফলে হাসি নেই চাষীদের মুখে। এদিকে সরকারী পাট ক্রয় কেন্দ্রে চাষীদের কাছে থেকে পাট কেনার কথা থাকলেও সময়মতো পাটের মূল্য না দিতে না পারায় চাষীরা পাট দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। সোনালী আঁশখ্যাত পাটের সে সুদিন আর নেই। তারাপরও লাভের আশায় পাট চাষ করে যাচ্ছেন পাট চাষীরা। বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটের ফলনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, আবার পাটের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া এবং বাজার সঙ্কটের কারণে মিলছে না ক্রেতা। এ অবস্থায় গতবারের মজুদকৃত পাট নষ্ট হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। চলতি মৌসুমে সরকার মণপ্রতি পাটের মূল্য নির্ধারণ করেছেন ১ হাজার ৭৫০ টাকা। যার প্রভাব নেই মেহেরপুরের বাজারে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামের অর্ধেক দামে পাট বিক্রি করতে হচ্ছে চাষীদের। ফলে উৎপাদন খরচই উঠছে না তাদের। বিঘা প্রতি পাট উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। উৎপাদিত পাট বাজারে বিক্রি করে দাম পাচ্ছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। সাধারণত বিঘাপ্রতি ১২ থেকে ১৪ মণ হারে পাটের ফলন হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ১০ মণ হারে পাটের ফলন হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছর জেলায় ২৫ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৩৫ মেট্রিক টন। এ বছর পাট চাষের খরচ ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে যে তারতম্য দেখা দিয়েছে তাতে চাষীরা হতাশার মধ্যে রয়েছে। মেহেরপুর সদর উপজেলার হরিরামপুর গ্রামের পাট চাষি রুহুল আমিন জানান, দুই বিঘা জমিতে ২৬ হাজার টাকা ব্যয়ে পাট চাষ করেছিলেন তিনি, পাট বিক্রি করে ঘরে এসেছে ১৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা তিনি লোকসান গুনেছেন। একই উপজেলার গোভীপুর গ্রামের পাট চাষী জিনারুল ইসলাম জানান, ৪১ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন তিনি। উৎপাদন শেষে ৩৪ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পেরেছেন পাট। তিনি আরও জানান, বিঘাপ্রতি পাট চাষে সেচ সার দিয়ে ৫ হাজার ৮শ টাকাসহ অন্যান্য খরচসহ অন্তত ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়। পাট বাজারে বিক্রি করে কাটা, বাঁধা, জাগ দেয়া ও পাট ছাড়ানোর অর্ধেক কাটায় উঠছে না এ বছর। মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের চাষী আব্দুস সালাম জানান, এ বছর ব্যাংক ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পাট চাষ করেছি। আমিসহ আমাদের এলাকার অধিকাংশ কৃষকই ঋণ নিয়ে পাট চাষ করেছে। পাট বিক্রি করে লোকসান হওয়ায় কিভাবে ঋণ পরিশোধ হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সবাই। বুড়িপোতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজামাল জানান, জনপ্রতি শ্রমিকের মজুরি দিতে হচ্ছে ৩ থেকে ৪শ টাকা। আবার সময়মতো পাওয়াও যাচ্ছে না। একে তো পাটের দাম নেই তার উপরে শ্রমিকের উচ্চমূল্য তাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। ফলে আগামী বছর মেহেরপুরে পাট চাষ কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন পাটের আড়তে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাটের গুণগত মান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দামে পাট বিক্রি হচ্ছে। শহরের আড়তগুলোতে প্রতি মণ পাট ১ হাজার ১৬০ থেকে ১ হাজার ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার এ জেলার গাংনী উপজেলাতে প্রতি মণ পাট ১ হাজার ১শ’ থেকে ১ হাজার ১৭০ টাকা, মুজিবনগর উপজেলার কেদারগঞ্জে ১ হাজার ১৩০ থেকে ১ হাজার ২শ টাকা, আমঝুপিতে ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ২শ টাকা, বারাদীতে ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ২শ টাকা দরে পাট বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর যেসব ব্যবসায়ী চাষীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাট কিনছেন তারা প্রতি মণ পাট ৮শ থেকে ১ হাজার ৫শ টাকা দাম দিচ্ছেন। অন্যদিকে পাট মজুদকারকদের অবস্থারও বেশ বেহালদশা। গত বছর সরকার কর্তৃক পাটের মূল্য মণ প্রতি ২ হাজার ৪শ টাকা নির্ধারিত থাকায় মজুদকারকরা ভাল দাম পাওয়ার আশায় হাজার হাজার মণ পাট ক্রয় করে। কিন্তু পরবর্তীতে পাটের নি¤œ মূল্য ও ক্রেতার অভাবে অধিকাংশ মজুদকারকের পাট অবিক্রীত অবস্থায় গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে। মেহেরপুর সদরের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী আকছেদ আলী জানান, গত বছর কয়েক হাজার মণ পাট মণ প্রতি ১ হাজার ৫শ টাকা গড় দামে কিনেছিলাম কিন্তু ভাল ক্রেতা না পাওয়ায় পাট লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছে। আর অবশিষ্ট পাট ক্রেতার অভাবে গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে। পাট ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যানুসারে এ জেলায় শুধু গত বছরেরই প্রায় ৪ থেকে ৫ লক্ষাধিক মণ পাট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। তন্মধ্যে মেহেরপুর জেলা শহরের কাথুলী রোডের পাট ব্যবসায়ী হেকমত হোসেনের প্রায় ৮ হাজার মণ, বড় বাজারের পাট ব্যবসায়ী আবু হানিফ বাবুর প্রায় ৫ হাজার মণ, পাট ব্যবসায়ী রশিদের প্রায় ৩ হাজার মণ, রফিক জালালের প্রায় ৩ হাজার মণ, ইয়াছিন আলীর প্রায় আড়াই হাজার মণ, দিঘির পাড়ার পাট ব্যবসায়ী মুক্তারের প্রায় ৩ হাজার ২শ মণ, ট্যাঙ্গার মাঠ গ্রামের পাট ব্যবসায়ী দারা মিয়ার প্রায় ৫ হাজার মণ, বামনপাড়ার পাট ব্যবসায়ী আকছেন মিয়ার প্রায় ৩ হাজার মণ ও ছোট বড় প্রায় সকল মজুদকারকের পাট ক্রেতার অভাবে গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক এস এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পাট চাষ জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। কৃষকেরা পাট চাষে আগ্রহ হারালে এ জেলার জমির উর্বরা শক্তিও কমে যাবে। পাট চাষ করে কৃষক লাভবান হলে এ চাষে আগ্রহ বাড়ত। লোকসান হলে চাষীরা পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফলে পাট চাষ কমে যাওয়ায় জমির উর্বরা শক্তি কমে যাবে। কৃষক আশায় বুক বেঁধে থাকেন পাট বিক্রি করে সংসারের মানুষের মুখের হাসি ফোটাবার পাশাপাশি পরবর্তী আবাদ করার টাকা সঞ্চয় করার। চলতি বছর মেহেরপুরের পাট খুব ভাল হয়েছে, দাম ভাল পেলে চাষীরা আবারও বেশি বেশি পাট চাষ করবে।
×