ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুচির প্রতি মালালা

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সুচির প্রতি মালালা

বিশ্বের চরম নিগৃহীত গোষ্ঠী রোহিঙ্গারা এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মধ্যে টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জীবন তাদের নিভু নিভু সলতের মতো; যেন দপ করে নিভে যাওয়ার অপেক্ষা কেবলই। সবহারা হয়ে সর্বস্বান্ত মানুষগুলো নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। জনসংখ্যার আধিক্য যে দেশে বেশি সে দেশে তারা বসবাস করছে শরণার্থী হিসেবে এবং তা চার দশক ধরে। ১৯৭৮ সাল থেকে নাফ নদীর বানের মতো দলে দলে আসছে বাংলাদেশে। কিন্তু স্বদেশে আর ফেরা হয় না। জাতিসংঘ তাদের নাগরিকত্ব ও জন্মভূমিতে বসবাসের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিপরীতে কোন শক্তপোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারছে না। অবশ্য জাতিসংঘের অধীনস্থ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা চাচ্ছে শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা থাক। কিন্তু মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে না নিধনযজ্ঞ বন্ধে। মৃত্যু আর দেশত্যাগ রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে জুটলেও জাতিসংঘ ভরসা দিতে পারছে না। জাতিসংঘ চাইলেই যে কাজ হয় না তার নিদর্শন সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অনাগ্রহী মিয়ানমার সরকার বলছে, রোহিঙ্গা নিপীড়ন হচ্ছে না। অথচ পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। বাধ্য করা হচ্ছে দেশত্যাগে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা এমনকি ওআইসি রোহিঙ্গা নিধন বন্ধের জন্য বার বার আহ্বান জানালেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন্ পথে সে প্রশ্নের জবাব মেলে না। কোফি আনান রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেয়ার পরামর্শ দিলেও মিয়ানমার তাতে রাজি নয়। বরং সুপারিশ পেশের পরই নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া শুধু নয়, বেপরোয়া গুলি, বোমা চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে শিশু, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে। মূলত গণহত্যা চলছে সেখানে এবং তা সুপরিকল্পিতভাবেই। মিয়ানমারে ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক পালাবদলে শান্তিতে নোবেল জয়ী আউন সান সুচির দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানের একটি পথরেখা তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু সুচি এই সমস্যার মূলে যেত চাননি। সঙ্কটের জন্য রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করে সুচি গত ডিসেম্বরে বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টা যতটা, তার চেয়ে বড় করে দেখানো হচ্ছে। সুচির এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিশ্বের মানবতাবাদীমহল। সুচি মূলত সেনাবাহিনীর অপরাধ ঢেকে রাখারই চেষ্টা করছেন। এছাড়া রাখাইন জাতিগত সংঘাতের জটিল ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ শতসহস্র সমস্যা সত্ত্বেও আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য নানামুখী প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী পাকিস্তানের নারী শিক্ষা আন্দোলন কর্মী মালালা ইউসুফজাই রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বিষয়টির স্থায়ী সমাধান চেয়েছেন। মালালা শান্তিতে নোবেল জয়ী সুচির উদ্দেশে বলেছেন, তিনি যেন রোহিঙ্গাদের প্রতি তার দেশের লজ্জাজনক আচরণের নিন্দা করেন। এ সহিংসতায় সুচির নিন্দার অপেক্ষায় বিশ্ব, অপেক্ষায় রোহিঙ্গা মুসলমানরা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা সেখানে বাস করে আসছেন, সেই মিয়ানমারেই যদি তাদের আবাস না হয়, তাহলে তাদের আবাস কোথায় বলে মালালা প্রশ্ন তুলেছেন। রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা মালালার হৃদয়কে করুণ ক্রন্দনে মথিত করে বলেই তিনি এমনটাও বলেছেন যে, তার নিজের দেশ পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের উচিত বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা। শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য ও শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা হবে এমন আশাবাদী মালালা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে শিশু হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ। বলেছেন, শিশুরা তো কাউকে আক্রমণ করেনি। কিন্তু তাদের ওপর তারপরও নিপীড়ন চলছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী সুচি তার দেশে কোন শান্তি আনা দূরে থাক বরং অশান্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে। সুচির উচিত রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রদান এবং সহিংসতা বন্ধ করা। রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজটি দ্রুত শুরু করা না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে বাধ্য।
×