ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জবাব ভালই দিচ্ছেন ওয়ার্নার ও হ্যান্ডসকম

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জবাব ভালই দিচ্ছেন ওয়ার্নার ও হ্যান্ডসকম

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ একদিনেই বদলে গেল সব। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেটে প্রথমদিন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা রান করতে হিমশিম খেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনার নাথান লিয়ন ম্যাজিক দেখিয়েছেন বল হাতে। সেই উইকেট ভোল পাল্টে ফেলে দ্বিতীয়দিন। টেলএন্ডারদের হারিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ৩০৫ রানে শেষ হওয়ার পর স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালিয়েছে অসি ব্যাটসম্যানরা। ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথ ও পিটার হ্যান্ডসকম্বোর অর্ধশতকে ২ উইকেটে ২০৫ রানে শেষ করেছে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয়দিন। এখনও ৮০ রানে পিছিয়ে থাকলেও হতাশা সঙ্গী হয়েছে বাংলাদেশ দলের। আর অনেকটাই শক্ত অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলেছে অস্ট্রেলিয়া। কারণ তাদের হাতে আছে আরও ৮ উইকেট। অথচ ক্যারিয়ারে চতুর্থবার ৭ উইকেট শিকার করা লিয়নের দাপুটে দিন কেটেছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে। সেখানে নখ-দন্তহীন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের তিন স্পিন ত্রাস- সাকিব আল হাসান, মেহেদি হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলাম। সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে মাত্র দুই উইকেট তুলে নিতে পেরেছে বাংলাদেশের বোলাররা। স্পিনবান্ধব উইকেট ব্যাটিং সুবিধা হয়ে পড়ার ফলে ভয়াবহ একটা দিন পার করেছে মুশফিকরা। প্রথমদিন শেষে ছিল সাম্যাবস্থা। উভয় দল ভাল অবস্থানে থাকার দাবি জানিয়েছিল দিনশেষের নৈপুণ্যে। তবে সন্তুষ্টির মাত্রা একটু বেশিই ছিল বাংলাদেশের। কারণ ম্যাচের প্রথম ৩ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই ওপরের সারির ৫ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ফেলেছিল স্বাগতিক দল। প্রথমদিনের উইকেটটা ছিল একেবারেই দুর্বোধ্য। সর্বোচচ ৬৬ রান করা সাব্বির রহমান সেটাই বলেছিলেন দিনশেষে। তারপরও বাংলাদেশের তৃপ্তির কারণ ছিল দিনের বাকি ৩ ঘণ্টায় মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে সবমিলিয়ে ৬ উইকেটে ২৫৩ রানে স্বস্তি নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল মুশফিকুর রহীমরা। তাকে নিয়ে দ্বিতীয়দিন প্রত্যাশাটাও ছিল বড়। তার সঙ্গে আরেক স্বীকৃত ব্যাটসম্যান নাসির হোসেন বেশ ভালভাবেই ব্যাটিং করে আশা জাগিয়েছিলেন ভাল একটি সংগ্রহ পাওয়ার। দ্বিতীয়দিন সকাল থেকেও দারুণ সুস্থির ছিলেন দুই ব্যাটসম্যান। নির্বিঘেœই দিনের প্রথম এক ঘণ্টার অগ্নিপরীক্ষাটা পেরিয়ে যাচ্ছেন তারা এমনটাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু আগের দিন ১৮তম অর্ধশতক পাওয়া মুশফিকই প্রথম ভুলটা করলেন প্রায় ৪০ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর। মাত্র ৬ রান যোগ করতে পেরেছিলেন তিনি এদিন। ৬৮ রানে বিদায় নেন আগেরদিনই ৫ উইকেট শিকার করা অফস্পিনার নাথান লিয়ন। চলতি টেস্টে প্রথম দিনেই অসিদের নায়ক হয়ে যাওয়া এ ডানহাতি দারুণ এক ফ্লাইটে পুরোপুরি অবশ্য পরাস্ত করতে পারেননি মুশফিককে। কিন্তু ব্যাটের কানায় লাগার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা স্টাম্পে লাগলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় বাংলাদেশ অধিনায়ককে। সপ্তম উইকেটে সবেমাত্র জমতে থাকা নাসিরের সঙ্গে তার জুটিটির যবনিকা ঘটে ৪৩ রানেই। ১৬৬ বলে ৫ চারে ৬৮ রান করার পর বিদায় নেন মুশফিক। এরপর অবশ্য মেহেদি হাসান মিরাজ দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিলেন নাসিরকে। দীর্ঘদিন পর অবশ্য বেশ সাবলীল খেলছিলেন এ অলরাউন্ডার। অষ্টম উইকেটে প্রায় একঘণ্টা নাসির-মিরাজ জুটি মাঠে থেকে ২৮ রান যোগ করেন। এতে করে তিন শ’ রান ছোঁয়ার কাছাকাছি চলে যায় বাংলাদেশ দল। ক্যারিয়ারের সপ্তম ফিফটি মিস করেছেন নাসির মাত্র ৫ রানের জন্য। ৯৭ বলে ৫ চারে ৪৫ রান করার পর উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। পরের ওভারেই মিরাজ রানআউটের শিকার হলে তিন শ’ ছোঁয়াই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশের জন্য। তবে ম্যাক্সওয়েলকে দারুণ এক ছক্কা হাঁকিয়ে তাইজুল ইসলাম দলের সংগ্রহ তিন শ’ ছাড়িয়ে নিয়ে যান। পরের ওভারেই তাইজুলকে শিকার করে ইনিংসে ৭ উইকেট পূর্ণ করেন লিয়ন। ৩০৫ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান বাংলাদেশের। এর আগে ফতুল্লায় ২০০৬ সালে ৪২৭ রানের ইনিংসটিই এখন পর্যন্ত অসিদের বিরুদ্ধে টাইগারদের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। লিয়ন ৯৪ রানে নেন ৭ উইকেট। এ নিয়ে মোট ৬ জন বোলার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখালেন টেস্টে। আর স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল, দানিশ কানেরিয়া ও রঙ্গনা হেরাথের পর চতুর্থ স্পিনার হিসেবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই কীর্তি গড়লেন লিয়ন। লিয়নের ভয়াল ঘূর্ণি থাবা হানার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ দল। কারণ স্পিনত্রয়ী সাকিব-মিরাজ-তাইজুল আছেন বাংলাদেশের স্কোয়াডে। যদিও প্রথমদিন শেষে সাব্বির বলেছিলেন উইকেটের চরিত্রই বোঝেননি তারা। আভাস দিয়েছিলেন দ্বিতীয়দিন ভিন্ন আচরণ করতে পারে উইকেট এবং একেকটা দিন একেক রকম চরিত্র নিয়ে হাজির হতে পারে। যদিও অসিরা ব্যাটিংয়ে নামার পর শুরুতেই আঘাত হেনে দর্শকদের এবং দলের ক্রিকেটারদের উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। মিরপুর টেস্টে দেশের এই অন্যতম পেসস্তম্ভ ছিলেন একেবারেই অকেজো। কিন্তু প্রথম আঘাতটা হানলেন তিনিই। ওপেনার ম্যাট রেনশ তার বলটিকে গ্ল্যান্স করার পর দর্শনীয় ক্যাচ ধরেন মুশফিক ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রায় অসম্ভব সেই ক্যাচটি লুফে দলের প্রথম সাফল্যে বড় ভূমিকা রাখা মুশফিকই সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছেন দিনের শেষভাগে। মিরাজের নিচু হয়ে আসা বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে বড় শট খেলতে চেয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। স্বভাববিরুদ্ধভাবে একেবারেই ধীরস্থিরভাবে খেলা ওয়ার্নার ওই একটিই সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বল ধরতেই পারেননি মুশফিক, ফলে নিশ্চিত স্টাম্পিং থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ওয়ার্নার দিনশেষে ক্যারিয়ারের ২৫তম অর্ধশতক হাঁকিয়ে অপরাজিত থাকেন ১৭০ বলে ৪ চারে ৮৮ রান নিয়ে। এর আগে পর্যন্ত পুরোপুরি দুর্ভোগের দিন গেছে মিরাজ-সাকিবদের। লিয়নের ঘূর্ণিঝড় ওঠা উইকেট যেন মরে যায়। সাগরিকায় বাংলাদেশী স্পিনারদের ওপর বিরূপ হয়ে ওঠা উইকেটে অসি ব্যাটসম্যানরা অনায়াসে ব্যাটিং করেছেন। মনোসংযোগে বিন্দুমাত্র চিড় ধরানোর মতো কোন বোলিং দেখা যায়নি। ওয়ার্নারের সঙ্গে অসি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ দ্বিতীয় উইকেটে ৯৩ রানের দারুণ এক জুটি গড়েন। প্রাথমিক যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল রেনশকে হারিয়ে সেটা পূরণ করে উল্টো বাংলাদেশ শিবিরে হতাশার সৃষ্টি করেন তারা। ক্যারিয়ারের ২১তম অর্ধশতক পেয়ে যাওয়ার পর স্মিথকে শিকার করে ব্রেক থ্রু আনেন তাইজুল ইসলাম। তাকে সরাসরি বোল্ড করে দেন তাইজুল। ৯৪ বলে ৮ চারে ৫৮ রান করার পর স্মিথের ইনিংসে ইতি ঘটে। তখনও ৪০ পেরোতে পারেননি বিধ্বংসী মনোভাবের ওয়ার্নার। পুরোটা সময় তিনি এমন নির্জীব থেকেই খেলে দিন শেষ করেছেন। স্মিথ আউট হওয়ার পর পিটার হ্যান্ডসকম্বোকে নিয়ে নির্বিঘেœ শেষ করেছেন দ্বিতীয়দিন। তৃতীয় উইকেটে ১২৭ রানের বিশাল জুটি গড়েছেন তারা, থেকেছেন অবিচ্ছিন্ন। হ্যান্ডসকম্বো ক্যারিয়ারের চতুর্থ এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রথম অর্ধশতক হাঁকান। তিনি ব্যাট করছেন ১১৩ বলে ৫ চারে ৬৯ রান নিয়ে। ৬৪ ওভার ব্যাট করে মাত্র দুই উইকেট খোয়ানো অসিরা ২২৫ রান নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট চিত্তেই মাঠ ছেড়েছে। সারাদিন ঘাম ঝরিয়েছেন সাকিবরা। অথচ লিয়নের সাফল্য দেখে মিরাজকে দিয়ে বোলিং আক্রমণ শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু উইকেটের গতি-প্রকৃতি পাল্টে পুরোপুরি ব্যাটিং স্বর্গে পরিণত হওয়ার কারণে তারা হয়ে গেছেন নখ-দন্তহীন। সবমিলিয়ে হতাশার একটি দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশ দল।
×