ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ২১৭/১০, দ্বিতীয় দিন শেষে ৮৮ রানে এগিয়ে বাংলাদেশ, হাতে আছে ৯ উইকেট

সাকিব-মিরাজের স্পিনেই বেসামাল অস্ট্রেলিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৯ আগস্ট ২০১৭

সাকিব-মিরাজের স্পিনেই বেসামাল অস্ট্রেলিয়া

মিথুন আশরাফ ॥ ‘স্পিনে আমরাই এগিয়ে।’ প্রথম টেস্ট শুরুর আগে বলেছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তাতে অসি স্পিনার নাথান লিয়ন বুঝিয়ে দেয়ার মতো উল্টো হুমকি দিয়েছিলেন। প্রথম ইনিংসে উল্টো বুঝে ফেলল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ স্পিনাররা যে কতটা বিপজ্জনক তা হাড়ে হাড়ে টের পেল অসি ব্যাটসম্যানরা। স্পিনেই কাত হয়ে গেল যেন অসিরা। অসিদের ১০ উইকেটের মধ্যে ৯টিই বাংলাদেশ স্পিনাররা দখল করে নিলেন। সাকিব মুখে শুধু বলেননি করেও দেখিয়েছেন। একাই ৫ উইকেট নিয়েছেন। তার এ বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া ২১৭ রানের বেশি করতেও পারেনি। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৬০ রান করার পর দ্বিতীয়দিন শেষ হওয়ার আগে দ্বিতীয় ইনিংসে ১ উইকেটে ৪৫ রান করায় অস্ট্রেলিয়া থেকে ৮৮ রানে এগিয়েও আছে মুশফিকবাহিনী। অসাধারণ আরেকটি দিন কাটাল বাংলাদেশ। দ্বিতীয়দিনে বাংলাদেশের কোন উইকেট পড়তো না যদি শেষবেলায় খেলতে নেমে দিন শেষ হওয়ার ২ ওভার বাকি থাকতে সৌম্য সরকার পাগলামি না করতেন। অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করে দেয়ার পর সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুই ওপেনার তামিম ও সৌম্য। দিনের তখন মাত্র ২ ওভার বাকি। এমন সময়ই অযথা মাথা গরম করলেন সৌম্য। কি সুন্দর দিনটি মিলছিল। কিন্তু দলের ৪৩ রানের সময় এ্যাগারের বলে লং অনে খেললেন। খাজা তিন চেষ্টায় ক্যাচটি ধরলেন। সৌম্য (১৫) মাথানত করে মাঠ ছাড়লেন। সৌম্য আউট না হলে পুরো ১০ উইকেট নিয়েই মাঠ ছাড়তে পারত বাংলাদেশ। আজ তৃতীয়দিনে ওপেনার তামিমের (৩০*) সঙ্গে ‘নাইট ওয়াচম্যান’ হিসেবে নামা তাইজুল ব্যাট হাতে নামবেন। দ্বিতীয়দিনের শুরু থেকেই বাংলাদেশ স্পিনাররা বোলিং দ্যুতি ছড়ান। ‘স্মিথ ফ্যাক্টর’ যখন দূর হয়ে গেল তখন টেস্টটি পুরোপুরিই বাংলাদেশের হাতে চলে আসল। দ্বিতীয়দিনের শুরুতেই স্মিথকে যখন বোল্ড করে দিলেন মিরাজ তখন বাংলাদেশ এ টেস্টে জিতে যাবে এমনকি ম্যাচ চারদিনের বেশি যাবে না এমন ভাবনাও শুরু হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা যে উপমহাদেশে স্পিন আতঙ্কে থাকেন এবং সেই স্পিন তাদের জন্য ‘মৃত্যুকূপ’ তা শুরু থেকেই বোঝা গেল। দলের ৩৩ রানের সময় স্মিথ (৮) যখন মাথা নিচু করে সাজঘরে ফিরছেন তখন অস্ট্রেলিয়ার সব আশা-ভরসারও মৃত্যু যেন ঘটল। এরপর প্রথমদিন থেকেই উইকেট আঁকড়ে থাকা ম্যাট রেনশ ও পিটার হ্যান্ডসকম্ব মিলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তাতে সাফল্যের মুখও দেখছিলেন। কিন্তু বল যে একের পর এক ঘুরছে, নিচু হচ্ছে। সেই ভীত বলগুলোকে ঠেকিয়ে মাঝে মাঝে রান নিয়ে অনেক ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। মিরাজ, সাকিব, মুস্তাফিজও বল হাতে নিয়ে কিছুই করতে পারছিলেন না। একের পর এক আপীল হয়। রিভিউ হয়। কিন্তু এ দুইজনকে আটকানো যাচ্ছিল না। যদি এ দুইজন বড় জুটি গড়ে ফেলেন তাহলে বিপদ আসতে পারে। কারণ বল যেভাবে ঘুরছে আর প্রথম ইনিংসে অসি স্পিনার লিয়ন ও এ্যাগার যেভাবে বল হাতে সফল হয়েছেন তাতে বিপত্তি বাংলাদেশের ঘাড়েও পড়তে পারে। দুইজন মিলে একটা সময় ৬৯ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে ১০০ রানও যোগ হয়ে যায়। যখন আর ২ রান যোগ হয়, এমন সময় তাইজুল ইসলাম সাজঘরে ফেরান হ্যান্ডসকম্বকে (৩৩)। রেনশ ও হ্যান্ডসকম্ব যেন খানিক আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এটাও জানা ছিল একটি ভাল বলই যথেষ্ট। হ্যান্ডসকম্ব আউট হওয়ার পর তো অস্ট্রেলিয়া ১৫০ রান করতে পারবে না এমন বিশ্বাসই সবার ভেতর জন্মে যায়। মধ্যাহ্ন বিরতি হয়ে যাবে। শেষ ওভার। সেই ওভারের প্রথম বলেই রেনশকেও (৪৫) আউট করে দেন সাকিব। স্পিন ভেল্কিতে পুরোই তছনছ হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং শিবির। প্রথমদিন ৩ উইকেটে ১৮ রান করে দিন শেষ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৬০ রান করায় ২৪২ রানে পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয়দিন মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার আগেও আরও ৩ উইকেট হারায় অসিরা। স্মিথ, হ্যান্ডসকম্ব, রেনশ; তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট হারায়। রান হয় আরও ১০৫। ৬ উইকেট হারিয়ে ১২৩ রান করে অস্ট্রেলিয়া। যেভাবে বাংলাদেশ স্পিনাররা দাপট দেখাচ্ছিলেন বোঝাই যাচ্ছিল মুহূতেই অলআউট হয়ে যাবে অসিরা। মধ্যাহ্ন বিরতির পর নামতেই সেই আলামত মিলল। প্রথম ওভারেই ম্যাথু ওয়েডকে (৫) কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাজঘরে ফেরান মিরাজ। ম্যাক্সওয়েল ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার স্পেশালিস্ট সব ব্যাটসম্যানই ততক্ষণে ড্রেসিংরুমে ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে বসে আছে। ম্যাক্সওয়েলকেও সেই মুখের অবস্থানে দ্রুতই নিতে হবে। সেই তাড়না বাংলাদেশ বোলারদের মধ্যে ছিলই। ১৪৪ রানের সময় সাকিবের বলে এগিয়ে খেলতে গিয়ে স্ট্যাম্পিং হয়ে যান ম্যাক্সওয়েলও (২৩)। স্পিনের মায়ার জালে আটকা পড়া স্মিথদের সঙ্গে একই কাতারে গিয়ে ড্রেসিংরুমে বসেন ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু ততক্ষণে ১৫০ রানের কাছাকাছি চলে যায় অসিরা। দ্বিতীয় সেশনের শুরুতেই ২ উইকেট পড়ে। কিন্তু এরপর দুই বোলার এ্যাগার ও কামিন্স মিলে যে কি ব্যাটিং করলেন তা অস্ট্রেলিয়াকে যেন নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দেয়। কোনভাবেই এ দুজনকে আটকাতে পারেননি বাংলাদেশ বোলাররা। উইকেটে টান কম হয়। রিভিউ নিয়ে কখনও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়। আবার রিভিউ নিয়ে কখনও অস্ট্রেলিয়া সফল হয়। এমন চলতে থাকে। এমন করতে করতে এ্যাগার ও কামিন্স মিলে দলকে ২০০ রানের কাছাকাছিও নিয়ে যান। দুইজন মিলে ৪৯ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। দ্বিতীয় সেশনে যাওয়ার আগে ১৯৩ রান করে অস্ট্রেলিয়া। স্পিনারদের এত চাপ সামাল দিতে না পেরে যেখানে অসি ব্যাটসম্যানরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েন, সেখানে এ্যাগার ও কামিন্স বোলার হয়েও ব্যাটসম্যানরূপে ধরা দেন। দ্বিতীয় সেশনে খেলতে নামতেই মনে করা হয়েছিল এই সেশনেই বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামবে। কিন্তু তাতো হলোই না উল্টো অস্ট্রেলিয়া ২১৭ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করে ফেলে। তৃতীয় সেশনের শুরুতে আর কোন রান যোগ করার আগেই সাকিবের বলে কামিন্স (২৫) এবং দলের ২১৭ রানে হ্যাজলউড (৫) আউট হন। সেই সঙ্গে অসিরা অলআউটও হয়। তবে এ্যাগার শেষ পর্যন্ত ৪১ রানে অপরাজিত থাকেন। সাকিব অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ৫ উইকেট শিকার করে নেন। বাংলাদেশ থেকে ৪৩ রানে পিছিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়া। যা অসিদের স্বস্তিই দিয়েছে। যেখানে ১৫০ রানও হয় না সেখানে শেষ ব্যাটসম্যানদের ঝলকে প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে থাকার ব্যবধান কমিয়ে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তবে একটি কাজ হয়েছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সবনিম্ন রানে গুটিয়ে গেছে অসিরা। এরআগে ২০০৬ সালে আশা জাগানিয়া ফতুল্লা টেস্টে প্রথম ইনিংসে যে অস্ট্রেলিয়া ২৬৯ রানে অলআউট হয়েছিল, সেটিই এরআগে বাংলাদেশের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সবনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি ছিল। তামিম-সাকিবের মতো কোন বড় জুটি হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। হতে দেননি বাংলাদেশ স্পিনাররা। অস্ট্রেলিয়ার ১০ উইকেটের মধ্যে ৯ উইকেটই স্পিনাররা শিকার করেন। ৫ উইকেট সাকিব নেন। ৩ উইকেট নেন মিরাজ। ১ উইকেট নেন তাইজুল। একটি হয় রান আউট। সাকিব ব্যাট হাতে ৮৪ রান করার পর ৫ উইকেটও তুলে নেন। বিরল এক রেকর্ড গড়েন সাকিব। শ্রীলঙ্কার বিশ্বসেরা অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরলিধরন, দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইন, লঙ্কান আরেক বাঁহাতি স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের পর চতুর্থ বোলার হিসেবে বিশ্বের সবকয়টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে টেস্টে অন্তত একবার করে হলেও ৫ উইকেট শিকারের অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী হলেন সাকিব। এই কৃতিত্বে আনন্দও যুক্ত হবে এখন যদি ম্যাচটি জেতা যায়। সেই লক্ষ্যেই দল এগিয়ে চলছে। ব্যাটসম্যানদের ওপরেই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। যদি তামিম, সাকিব, মুশফিকরা বড় স্কোর দাঁড় করাতে পারেন। তখন স্পিনারদের কাজ শুরু হবে। দুইদিনে যে অবস্থা দেখা গেছে তাতে অসিদের ৩০০ রানের ওপর টার্গেট দিতে পারলেই জয় মিলতে পারে। স্পিনে যে অস্ট্রেলিয়ার ভয়ঙ্কর ভীতি রয়েছে। সেই স্পিনেই দুইদিন যে অসিদের কাঁপন ধরিয়েছে বাংলাদেশ।
×