ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ কামরুল হাসান খান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অনুস্মরণীয়, অনুকরণীয়

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৯ আগস্ট ২০১৭

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অনুস্মরণীয়, অনুকরণীয়

১৯৭১ সালের রক্তস্নাত ২৫ মার্চের কালরাত। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, গাজী গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য নেতাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রায় সারাক্ষণ নিচের লাইব্রেরি রুমে বসেছিলেন। সেদিন সবার চোখে-মুখে ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই সেনাপতির সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করছেন। এরই মাঝে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য ছাত্র ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ এবং নির্দেশ দিয়ে এক এক করে বিদায় দেন। সেদিন খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর বন্ধুরা তাঁকে ঢাকা ছেড়ে যেতে সম্মত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি সাংবাদিকদের পরে বলেছিলেন ‘আমার জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল। আমি যদি সেখানে না থাকতাম তবে আমার খোঁজে ইয়াহিয়া খান গোটা শহর জ্বালিয়ে দিত।’ বঙ্গবন্ধু বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তাঁর জীবনে গ্রেফতার কোন নতুন বিষয় ছিল না। তাঁকে হতোদ্যম করার জন্য বহুবারই কারাগারে আটক করা হয়েছে। কিন্তু সামরিক শাসকদের চক্রান্ত সব সময়ই ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে। এবার তারা তাঁকে মেরে ফেলতেও পারে, তবে সেটা তাঁর কাছে গৌণ ব্যাপার ছিল। একটি দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পালিয়ে যেতে পারেন না। সে রাতে এত উত্তেজনার মাঝেও বঙ্গবন্ধু শান্তভাবে পাইপ টানছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁর যা কিছু করণীয়, সবই তিনি করেছেন। ইতোমধ্যে সারা পূর্ববঙ্গের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তিনি বাঙালী জনগণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে ফেলেন। শুধু গ্রেফতার কেন, যে কোন পরিস্থিতির জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে একটি দেশের জন্মের প্রসব বেদনার সময় আঁতুর ঘরে ফেলে কি কখনও কোন জনক চলে যেতে পারেন? উদ্বৃত ঘটনা এবং কথার মধ্য থেকে বোঝা যায় জনকের দায়িত্ববোধ, চূড়ান্ত ঈড়সসরঃসবহঃ, সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং ঝুঁকি নেয়ার অসম সাহস। একা একটা মানুষ পাকিস্তান নামক একটি রক্তপিপাসু সামরিক জান্তার দেশের মুখোমুখি। তাঁকে উড়িয়ে দিতে পারত, নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত- এসব তিনি কিছুই ভাবেননি। তিনি প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন তেইশ বছরের তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্বাধীনতার গর্ভপাত গোলা-বারুদ, আগুন, কান্না আর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এটি কেবল সম্ভব ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষেই। ‘কায়হান ইন্টারন্যাশনাল’ পত্রিকার সাংবাদিক আমির তাহেরি একাত্তরের জুলাই মাস নাগাদ জেনারেল টিক্কা খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন কেন? ‘টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, স্যার শুনুন, শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন।’ আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। সাংবাদিক আরও জানতে চাইলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে যেতেন তবে সেক্ষেত্রে আপনি কি করতেন স্যার?’ উত্তরে টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি খুব ভাল করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তাঁর জনগণকে পরিত্যাগ করবে না। আমি গোটা ঢাকা শহরে তাঁকে খুঁজে বেড়াতাম এবং একটি বাড়িও তল্লাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তাঁর মতো অন্য নেতাদের গ্রেফতারের কোন অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তাঁরা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন। ‘জেনারেল টিক্কার এই উক্তি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধুই তাদের চিন্তার প্রধান কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের ঘটনা সম্পর্কে মেজর সিদ্দিক সালেক তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন ‘যখন প্রথম গুলিবর্ষণ করা হয় তখন রেডিও পাকিস্তানে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো পূর্বে রেকর্ডকৃত বাণী। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। কয়েক মিনিট পর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর তার বেতার কণ্ঠ শুনতে পেলেন (বিগ বার্ড ইন দ্য ফেজ)। ২৫ মার্চ রাতে যখন প্রায় বারোটা বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল, বঙ্গবন্ধুর পার্সনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদ টেলিফোন ধরলে ওপাশ থেকে বলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে বলেন মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে। মেশিন নিয়ে কি করব? তখন বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোরশেদকে বললেন, ওই ব্যক্তিকে বল মেশিন ভেঙ্গে সে যেন পালিয়ে যায়। লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়ার করেস্পন্ডেন্ট ডেভিড লোশাক, যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ভাষণটি উল্লেখ করেন, তিনি লিখেছিলেন যে, গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল এবং যাতে মনে হচ্ছিল খুব সম্ভবত ওটা আগেই রেকর্ড করা ছিল। পাকবাহিনী ট্রান্সমিটার খুঁজতে ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশনের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলী নূরুল হকের ওয়্যারলেস কলোনির বাসা ঘেরাও করে এবং ২৯ মার্চ তাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে তেইশ বছর ধরেই বাঙালী জাতির চেতনাকে উজ্জীবিত করার জন্য এবং বাঙালীর সার্বিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুকে দিনের পর দিন নিরলস আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। আর তার ফলে শাসকগোষ্ঠী বরাবর তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবেই অভিযুক্ত করেছে। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তিনি একই কথা শত-সহস্রবার উচ্চারণ করে বলেছেন- ‘আমরা আমাদের অধিকার চাই- রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সমতা। শুধু মুখের ভাষা প্রকাশের অধিকারই নয়- একটা গোটা জাতিকে তিনি মুক্ত করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নাগপাশের বন্ধন থেকে। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকরা কেবল রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়েই নিরব থাকেনি, তাঁকে বহুবার প্রাণনাশের চেষ্টাও করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একদিন হঠাৎ মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তাঁর আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো নয়। তিনি তিলে তিলে নিজেকে এই সংগ্রামের জন্য নিবেদন করেছেন- কঠোর ত্যাগের মধ্য দিয়ে আপোসহীন মনোভাব নিয়ে প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধিকারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যখন নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম ফলপ্রসূ হবার সকল সম্ভাবনা রুদ্ধ বলে নিশ্চিত জেনেছেন, তখনই সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বঙ্গবন্ধু বিনম্র ও কোমল স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি যে বাংলার মানুষকে কত গভীরভাবে ভালবাসতেন সে কথার প্রমাণ তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক একবার বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘What is your qualification?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ও খড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব’.- চট্ করে বিদেশী ঝানু সাংবাদিক অন্য একটি প্রশ্নবান ছুড়লেন, What is your disqualification?’ বঙ্গবন্ধুও শান্ত স্বরে জবাব দিলেন, ‘ও খড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয’- বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অসাধারণ মাটির মানুষ। বাংলার মাটির সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের যোগ অতি ঘনিষ্ঠ ছিল বলেই হয়ত তাঁর প্রকৃতি নরম স্বভাবের হয়ে গড়ে উঠেছিল। তাঁর প্রিয় বই ছিল নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বানার্ড শ, কেনেডি এবং মাও সেতুং-এর গ্রন্থাবলী। প্রতিবারই জেলে যাবার সময় বঙ্গবন্ধু ‘সঞ্চয়িতা’টা হাতে তুলে নিতেন। বইটার গায়ে পড়েছিল জেলের সেন্সরের অনেকগুলো সিল। কারাগারের মুহূর্তগুলোতে বঙ্গবন্ধু পড়াশোনা করতেন একাগ্রচিত্তে। বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন এবং প্রায়ই শোনাতেন পরিবারের লোকদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছিলে এক সম্মোহনী শক্তি, ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, Charisma| তিনি তাঁর নেতৃত্বের জাদুস্পর্শে ঘুমন্ত, পদানত বাঙালীদের জাগিয়ে তুলে উদ্দীপ্ত করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিনে তাকে রাজনীতির কবি (Poet of Politics) হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেছে, ‘মুজিব মৌলিক চিন্তার অধিকারী বলে ভান করেন না।’ তিনি যেমন ছিলেন নির্ভীক, তেমনি ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। মনের দিক থেকে একদিকে পরিচ্ছন্ন ও অপরদিকে দুর্জয় সাহসী বলেই তিনি অকপট ও সরল হতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। একবার তিনি একজনকে দেখলে ও সামান্য আলাপ করলে দশ বছর পরও তিনি বলে দিতে পারতেন, অমুক স্থানে, অমুক সময় তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের ভূমিকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার ক্ষতচিহ্ন। নাগরিকদের খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব ছিল প্রকট। কল-কারখানায় উৎপাদন শূন্যের কোঠায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু রাখা ও এককোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনসহ দেশের সমস্যা ছিল অগণিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তিনি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা করে বিশ্বজুড়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের পঞ্চাশ লাখ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাবে। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। এমনি একটি ভয়াবহ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শাসনভার গ্রহণ করেছিল। নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিক অসুবিধা ও সঙ্কটগুলো কাটিয়ে উঠেছিল। দেশের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তদনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রাথমিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটি সুনিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার সামর্থ্য অর্জন করেছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- ১. ভারতীয় বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন- ১২ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে। ২. ১৯৭২ সালের সংবিধান- তিরিশ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করে, তারই আদর্শ হিসেবে রচিত হলো রক্তে লেখা এক সংবিধান ৪ নবেম্বর ১৯৭২। ৩. ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ৪.প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা- বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশের জনগণের দ্রারিদ্র্য দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জাতির জনক প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ ছিল- ক. মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ। এজন্য যারা কর্মহীন বা আংশিক কর্মহীন তাদের সবার কর্মসংস্থানের আয়োজন প্রয়োজন। তাছাড়া জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং সেইসঙ্গে এই আয়ের বণ্টনের জন্য যথাযথ আর্থিক ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন ত্বরান্বিত হওয়া প্রয়োজন। খ. জনগণের অত্যাবশ্যক পণ্যের চাহিদা যাতে মেটে সেজন্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ভোজ্যতেল, কেরোসিন ও চিনি। গ.কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত কাঠামোতে এমনভাবে রূপান্তর সাধন প্রয়োজন যাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়, কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে এবং শ্রমশক্তির শহরমুখী অভিবাসন বন্ধ হয়। ৫.বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরী মনোভাব নয়।’ প্রথম তিন মাসের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩টি দেশের স্বীকৃতি লাভ। ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ২ বছর ২ মাসের মধ্যে। সর্বমোট ১২১টি দেশ স্বীকৃতি প্রদান করে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উত্থান ঘটে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তিনি পরিণত হলেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বের ছাপ রাখতে সমর্থ হন। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ এবং বিশ্ব শান্তির প্রতি ছিল তাঁর সুদৃঢ় সমর্থন। এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করে ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দুর্নীতির বিরদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারে ছেঁয়ে যাবে।’ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুতদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।’ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির সব স্বপ্ন/ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে ফেলেছিল। তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও বাবার আদর্শকে আঁকড়ে ধরে রেখে আবার বাঙালী জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। দেশবাসী আশা করে, জাতির জনকের আদর্শ অনুসরণ করে সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক সামাজিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলবে, যেখানে দেশবাসী নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন আমাদের রাজনীতির বড় পাথেয়। দেশগঠনে এবং বৈপ্লবিক কর্মকা-ে তারুণ্যের কোন বিকল্প নেই। ছাত্রদের ওপর দায় চাপিয়ে অভিভাবকের দায়িত্ব এড়ানো যাবে না। অভিভাবকের দুর্বলতার কারণেই আজকে ছাত্র রাজনীতি যদি দুর্বল হয়ে থাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে। এই বাংলাদেশের গৌরবের, অর্জনের অনেকখানিই ছাত্র রাজনীতির ফসল। তরুণরা যা পারে, অন্যরা তা পারে না। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে ছাত্র-রাজনীতিকে পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত করতে হবে। সঠিক পথে রাখতে হবে। তারুণ্যের শক্তিই আমাদের দেশ গড়ার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×