ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এম. নজরুল ইসলাম

জঙ্গীবাদমুক্ত দেশগড়ার শপথের দিন আজ

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২১ আগস্ট ২০১৭

জঙ্গীবাদমুক্ত  দেশগড়ার শপথের দিন আজ

আজ ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে যেন থমকে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেদিন রচিত হয়েছিল এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সৌম্য বিকেলে সেদিন অন্ধকার নেমে এসেছিল ঢাকার রাজপথে। দিনের আলো যেন নিভে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই। রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলপূর্ব সমাবেশ চলছিল। খোলা ট্রাকে বানানো উš§ুক্ত মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বক্তৃতা শেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার উদ্বোধন ঘোষণা করবেন; ঠিক সেই সময় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলো পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা। মুহূর্তে যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো গোটা এলাকা। শেখ হাসিনা সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন। আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। দলীয় সভানেত্রীকে বাঁচানোর জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এই গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফও পরে মারা যান। হামলায় আহতের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোঃ হানিফ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, আব্দুর রহমান, আখতারুজ্জামান, এ্যাডভোকেট রহমত আলীসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। শেখ হাসিনার ওপর এটাই প্রথম আক্রমণ নয়। এর আগেও একাধিকবার তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই একের পর এক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন তিনি। রাজনীতির কঠিন ব্রত থেকে তাঁকে বিরত রাখতে না পেরে শেষে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম সরাসরি তাঁর ওপর হামলা চালান হয়। লালদীঘি ময়দানে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। নেতা-কর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে সেবারও প্রিয় নেত্রীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। সেদিন নিহত হয়েছিলেন ২৪ নেতাকর্মী। আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো হামলা হয় তাঁর ওপর। ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনে মধ্যরাতে গুলিবর্ষণ করে। গ্রেনেড হামলা চালায়। নেত্রী তখন ওই বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ঘাতকদের অপচেষ্টা সেখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবার আক্রান্ত হন তিনি। উপনির্বাচনের ভোটের পরিস্থিতি দেখতে গ্রীন রোডের ভোটকেন্দ্রে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সন্ত্রাসীরা গুলি ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আবার আক্রমণ করা হয় তাঁকে। নাটোর রেলস্টেশনে তাঁকে বহনকারী রেলগাড়ির কামরা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তখন বিরোধী দলের নেতা। ওই সমাবেশেও তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্মারক বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সভামঞ্চ লক্ষ্য করে একটি মাইক্রোবাস থেকে গুলি চালানো হয়। ২০০০ সালের ২০ জুলাই শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তাঁর জনসভাস্থলের অদূরে হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থল। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেটে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালায় স্থানীয় এক যুবদল নেতা। একইভাবে তাঁর গাড়িবহরে হামলা হয় ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কলারোয়ায়। সে হামলাতেও তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোটের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। ২০০৪ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রথম হামলাটি হয় ২ এপ্রিল, বরিশালের গৌরনদীতে। জামায়াত-বিএনপি ঘাতকচক্র তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করে। এ বছরই সবচেয়ে বড় হামলাটি হয় ২১ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। বর্বর এ হত্যাকা-ের ঘটনা মনে হলে আজও অজানা ভয় ও আতঙ্কে শরীর শিউরে ওঠে। কোন গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও সভ্য দেশে নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে জনসভায় এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবা যায় না। লক্ষণীয় যে, গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর এলাকায় নিয়োজিত পুলিশ হামলাকারীদের আটক করার ব্যাপারে কোন চেষ্টাই করেনি। শুধু তাই নয়, গ্রেনেড হামলার পর দ্রুত ঘটনার আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। এত বড় একটি হত্যাকা-ে সে সময় ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোটের অনেক নেতা শোকাহত হওয়ার বদলে হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছিলেন। মামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার নানা রকম চেষ্টা করা হয়েছিল। তারই একপর্যায়ে হাস্যকর জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করা হয়েছিল। বাঙালীর শোক ও স্মরণের মাস আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এ মাসে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন ঘাতকদের বুলেট থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য একের পর এক হামলা করা হয়েছে। এই আগস্টে, বিগত জোট সরকারের আমলে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জোট সরকার সমর্থিত জঙ্গীরা তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়ে। আগস্ট শোকের শুধু নয়, আমাদের শক্তি সঞ্চয়েরও মাস। এই মাসেই আমরা জাতির পিতাকে হারিয়েছি। আবার শোককে শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে পথচলার দৃপ্ত শপথ নিয়েছি। আজ ২১ আগস্ট জাতিকে পাঠ করতে হবে নতুন শপথ। দীক্ষা নিতে হবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার নতুন মন্ত্রে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×