ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

সরগরম দক্ষিণের পেয়ারা বাজার

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৩ আগস্ট ২০১৭

সরগরম দক্ষিণের  পেয়ারা বাজার

বাংলার ‘আপেল’ হিসেবে পরিচিতি দেশী পেয়ারা। বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলাতে কমবেশি পেয়ারার চাষ হয়। তবে বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলাতে বেশি চাষ হয়। তিন-চার মাসের এ ফল ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ ঘটে। কোন কোন এলাকায় ধানের পরেই দ্বিতীয় অর্থকরী লাভজনক ফসল হচ্ছে পেয়ারা চাষ। বরিশাল অঞ্চলে পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কমবেশি ২০ হাজার পরিবার। চাষী পরিবারগুলোর মাঝে উৎপাদিত পেয়ারা কেন্দ্র করে নগদ অর্থে লেনদেন হয় কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকা। যা মাঠ পর্যায়ে খুচরোতে ৫০-৬০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। বরিশালের পেয়ারা দেশের নানা প্রান্তের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। যে কারণে পেয়ারা চাষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি বয়ে আনছে এ অঞ্চলের সুনাম। বরিশাল অঞ্চলে পেয়ারা চাষ বলতেই সবার আগে উঠে আসে আটঘর ও কুড়িয়ানা নামের দুটি গ্রামের কথা। যা প্রকৃত অর্থেই পেয়ারা চাষের পথিকৃত। গ্রাম দুটির অবস্থান পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলায়। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে কালীচরণ মজুমদার নামে এক ব্যক্তি দেড় শ’ বছর আগে ভারতের হিন্দুদের তীর্থস্থান গয়া থেকে পেয়ারার বীজ এনে প্রথম আটঘর-কুড়িয়ানা গ্রামে চাষ শুরু করেছিলেন। যে কারণে স্থানীয়ভাবে পেয়ারার আরেক নাম ‘গইয়া’ বা ‘গয়া’। স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টিগুণ ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় পরবর্তীতে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্র পেয়ারা চাষ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বরিশাল অঞ্চলে যে পেয়ারা উৎপাদিত হয় তার একটা বড় অংশ আসে পিরোজপুরের সঙ্গীতকাঠি, খয়েরকাঠি, আদাবাড়ি, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠি, আরামকাঠি, মাদ্রা, ঝালকাঠি জেলার কীর্ত্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদলকাঠি, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি এবং বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার তেতলা, সৈয়দকাঠি, জম্বুদীপ, বিশারকান্দি, ইন্দিরহাওলা ও নরেরকাঠিসহ আশপাশের ৫৬টি গ্রাম থেকে। পেয়ারার প্রধান মৌসুম আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র ও আশ্বিন মাস। মৌসুমের প্রতিদিন এসব বাজার থেকে ট্রাক, কার্গো, ট্রলার ও নৌকা ভর্তি হয়ে পেয়ারার চালান যায় দেশের নানা প্রান্তে। উন্নতমানের পেয়ারা রফতানি হয় পর্তুগাল, মেক্সিকো, কলোম্বিয়া, ব্রাজিল, ভারত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশে। জানা গেছে, ওইসব দেশে জেলির অন্যতম উপাদান হিসেবে পেয়ারা ব্যবহৃত হয়। কৃষিপণ্য হিসেবে পেয়ারা চাষ যথেষ্ট লাভজনক। একর প্রতি জমিতে পেয়ারা চাষে খরচ ৭-৮ হাজার টাকা। এর থেকে বিক্রি নামে ২৫-৩০ হাজার টাকা। সাধারণত কান্দি পদ্ধতিতে পেয়ারা চাষ হয়। বাগানের মধ্যে সারিবদ্ধ বেড বা নালা করে পেয়ারার কলম লাগানো হয়। ঠিকমতো পরিচর্যা করা গেলে ২-৩ বছরের মধ্যে ফলন আসে। নিচে ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ একর জমিরও বহু বাগান রয়েছে। বহু চাষী অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে পেয়ারা চাষ করে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ৭-৮ টন। গত বছর বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলায় সাড়ে ৭ হাজার টন, পটুয়াখালীতে ৭ হাজার ৩৫০ টন, পিরোজপুরে ৬ হাজার ৮৯৪ টন, বরিশালে ২ হাজার ১৩৫ টন, ভোলায় এক হাজার ৯৯ টন ও বরগুনায় ৫৬০ টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়েছে। চলতি মৌসুমে উৎপাদনের পরিমাণ আরও কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতি মণ পেয়ারা এ সময় এক-দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পুরো শ্রাবণ মাসজুড়ে আসে দ্বিতীয় দফার ফলন। এ সময় পেয়ারার দাম বাগান পর্যায়ে মণ প্রতি মাত্র এক-দেড় শ’ টাকায় নেমে আসে। এর পরের দফার আবার লাভজনক হয়ে ওঠে। মণ প্রতি দাম ওঠে দেড়-দুই হাজার টাকা। গড় দাম মণ প্রতি তিন-সাড়ে তিন শ’ টাকা ধরা হলে গত মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে কেবল বাগান পর্যায়ে ২০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আর মাঠে খুচরো পর্যায়ে তা ৫০-৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
×