ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মসিউর রহমান

বঙ্গবন্ধু ॥ রাষ্ট্রনায়কের সরকার পরিচালনাবঙ্গবন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৯ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধু ॥ রাষ্ট্রনায়কের সরকার পরিচালনাবঙ্গবন্ধ

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালনের বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রায় তিন বছর আমি এই পদে নিযুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনা বা সরকার পরিচালনা কাছ থেকে দেখবার যে সুযোগ হয়েছিল, তার ভিত্তিতে এই প্রবন্ধ রচিত। প্রশাসন ও সরকার অথবা রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে পার্থক্য আছে। সার্বিক অর্থে সরকার পরিচালনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতি সম্পৃক্ত; লেখার শেষ দিকে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করা হয়েছে। ॥ দুই ॥ ২. সকল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব মন্ত্রীদের কাছে ন্যস্ত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংস্থাপন বিভাগ (জনপ্রশাসন বিভাগ) স্বাভাবিক নিয়মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল। প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সংগঠিত করা বা তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান ছিল জটিল প্রক্রিয়া। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সৈন্যদের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা ছিল স্পর্শকাতর বিষয়। তাদের পূর্বের আচরণ ও আনুগত্য নিরীক্ষার একটি ব্যবস্থা (ডিব্রিফিং) ছিল, তারপরই তারা সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হতো। ৩. সকল মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসত। তিনি সরাসরি অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা নেননি। মন্ত্রিপরিষদের গঠন ও দায়িত্ব বিভাজন যুক্তরাজ্যের নমুনার অনুসারী। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সরাসরি নেন না; মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকে- সেখানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হেড অব সিভিল সার্ভিস। মন্ত্রিসভায় আলোচনা এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সকল মন্ত্রণালয়ের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবহিত থাকেন এবং দিকনির্দেশনা দেন। ৪. মন্ত্রিসভার নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠক হতো। নীতি ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ এ সকল বৈঠকে আলোচনা ও গ্রহণ করা হতো। মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দায়িত্ব বিভাজন এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্তসমূহের সমন্বয় সকল সরকারের জন্য দুরূহ বিষয়। ইদানীং সমন্বিত সরকার পরিচালনা (ঔড়রহবফ-ঁঢ় এড়াবৎহধহপব) নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে সরকার পরিচালনায় এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পদ্ধতি হতে ভিন্ন কোন পথ উদ্ভাবিত হয়নি। ৫. দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী যে সকল বিষয় নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হতেন অথবা মন্ত্রিপরিষদ সভা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারত না, সে সবের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হতো; বিভাগীয় মন্ত্রী অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী (দলের প্রবীণ সদস্য) কমিটির সভাপতি থাকতেন। সংশ্লিষ্ট সচিবগণ কমিটির কাজে সম্পৃক্ত হতেন। পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম লিখেছেন যে, বঙ্গবন্ধু কদাচিৎ কোন মন্ত্রণালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হলে বঙ্গবন্ধু কমিটির মাধ্যমে সুরাহার পথ বেছে নিতেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ব্যাপক আলোচনা করতেন। তার সিদ্ধান্ত সাধারণত সর্বসম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা ও দূরদৃষ্টির ফলে সরকার লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। ৬.বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের কাছে দায়িত্ব ‘ডেলিগেশন’ করতেন। লাহোরে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক স্টেটস সম্মেলনে যাবার জন্য আলজিরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান বুমেদিন এবং মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার সাদত বিমান পাঠিয়েছিলেন। তাদের বার্তা নিয়ে আসেন আলজিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা। তাঁরা প্রতিষ্ঠানে প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রমনা সদস্য বাড়াতে আগ্রহী। বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যাবেন কিনা তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সম্মেলনে যোগ দিলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রসারিত হবে; কিন্তু রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য ক্ষুণœ হতে পারে। পাকিস্তান তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর পক্ষ হতে নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দেয়া হবে; তিনি সম্মেলনে যোগ দিলে পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া সহজ হবে। বঙ্গবন্ধু দশটা/সাড়ে দশটা পর্যন্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। তারপর জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীবর্গ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। মধ্য রাতের পর সিদ্ধান্ত হয় যাবার পক্ষে। যাবার সব আয়োজন সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধুকে সকালে জানানো হয়। ৭.২০০১ সালে আলজিয়ার্সে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বার্ষিক সভা হয়। দুই সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলাম আমি। আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা প্রতিনিধি দলের প্রধানদের আমন্ত্রণ করেন। তার সঙ্গে করমর্দনের সময় জানাই আমি বাংলাদেশ হতে এসেছি। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা বললেন: ‘আমি তোমার দেশে গেছি। শেখ মুজিব!’ কয়েক মিনিট হাত চেপে রাখলেন। ৮.বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটি পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল অনুপস্থিত, প্রশাসনিক কাঠামো ছিল অবিন্যস্ত, অবকাঠামো এবং অর্থনীতি ছিল বিধ্বস্ত। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং দ্রুততার সঙ্গে এসব সমস্যা দূর করা ছিল জরুরী। ৯.স্বাধীনতা ঘোষণার সময় অস্থায়ী সরকার একটি সংক্ষিপ্ত সংবিধান-কাঠামো ঘোষণা করেছিল। বঙ্গবন্ধু অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান আদেশ জারি করেন। প্রেসিডেন্সিয়াল কাঠামোর পরিবর্তে ওয়েস্টমিনিস্টার (ডবংঃসরহরংঃবৎ) কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রকাশ। ১০. ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সকল কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্য ও প্রাদেশিক সংসদ সদস্য নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত পরিষদ ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সংসদ ও সরকার গঠিত হয়। সংবিধান প্রণয়ন পরিষদের ওপর অন্যান্য আইন প্রণয়নের ভার ছিল না, ফলে অল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন হয়। ১১. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত বেশিরভাগ কর্মকর্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এর মৌলিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। অবিশ্বাসী ছিল মুষ্টিমেয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান আগের মতো থাকবে কি-না সে সম্পর্কে অনেকের মনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ দোদুল্যমান মানসিকতা অনেক সময় স্বাধীনতার প্রতি অনাস্থা হিসেবে ভুল বোঝা হয়। স্বাধীনতার প্রতি যারা প্রকৃত অর্থে অবিশ্বাসী ছিল তাদের নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা ছিল জটিল প্রক্রিয়া। ভুল করে যাতে নির্দোষ কারও শাস্তি না হয় বঙ্গবন্ধু সেদিকে লক্ষ্য রেখেছেন, ক্ষমার দৃষ্টিতে সবাইকে দেখেছেন। ১২. পাকিস্তান সরকার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করত যথা হিলাল-ই-পাকিস্তান, খেদমত-ই-পাকিস্তান ইত্যাদি। এসব খেতাব ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের খান বাহাদুর/সাহেব, রায় বাহাদুর/সাহেব ইত্যাদির প্রতিস্থাপন। এক পর্যায়ে খেতাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ চাকরিচ্যুত হন। বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করেন এবং দেশ সেবার সুযোগ দেন। ১৩. বিশ শতকের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক শাসন এবং পূর্ব ইউরোপের অগণতান্ত্রিক কম্যুনিস্ট শাসন অবলুপ্ত হয়। দীর্ঘস্থায়ী বর্ণবাদী ও অগণতান্ত্রিক শাসনের সময় অনেকে রাষ্ট্রীয় শক্তির পক্ষে কাজ করেছে- কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে। স্বাধীনতা এবং মুক্তির পরবর্তী সময়ে সমাজের বিভেদ দূর করা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। এ সকল রাষ্ট্র দোষী ব্যক্তি আন্তরিক অনুশোচনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করার সুযোগ সৃষ্টি করে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধের মাত্রা ঠিক করা হয়। এ প্রক্রিয়া লাস্ট্রেশন বা ট্রানজিশনাল জাস্টিস (খঁংঃৎধঃরড়হ/ঞৎধহংরঃরড়হধষ ঔঁংঃরপব) নামে পরিচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু অনেক আগে এর উদাহরণ স্থাপন করেন। ১৪. যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা পুনঃনির্মাণ ছিল অত্যন্ত জরুরী। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হলে পণ্য পরিবহন সম্ভব ছিল না। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন এবং বিতরণ ছিল জরুরী। সড়ক ও রেল সেতুর পুনঃনির্মাণ এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা অগ্রাধিকার পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দরের প্রবেশমুখে বহুসংখ্যক জাহাজ ডুবে যায়, চট্টগ্রাম বন্দর মালামাল খালাসের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। রাশিয়ার সহায়তায় জাহাজ অপসারণ করে বন্দর ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়। ১৫. মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্রশস্ত্র ছিল। অস্ত্র উদ্ধার না হলে সুষ্ঠু প্রশাসন ও শৃঙ্খলা স্থাপন সম্ভব ছিল না। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ব্যবহার করে অস্ত্র উদ্ধার চেষ্টা ছিল যুক্তি বিবর্জিত। মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করবার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো। শান্তিপূর্ণভাবে অস্ত্র হস্তান্তর করবার জন্য বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানান। তার আহ্বানে বিপুল সাড়া জাগে। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং ‘সম্মোহনী ক্ষমতা’ (পযধৎরংযসধ) ছাড়া শান্তিপূর্ণ অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হতো না। (কারিশমার মূল অর্থ ছিল অলৌকিক ক্ষমতা; ম্যাক্স বেবর জাগতিক পরিবর্তনে নেতৃত্ব- ক্ষমতা বিশ্লেষণের জন্য ধারণাটি ব্যবহার করেন।) ১৬. পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অনেকের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল। রাজনৈতিক পরিবর্তনের মূল ধারা হতে বিচ্ছিন্ন দু’একটি গোষ্ঠী অস্ত্র হস্তান্তর হতে বিরত থাকে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংহত হবার পর এদের কাছ হতে অস্ত্র উদ্ধার একান্ত প্রয়োজন ছিল। অস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকলে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় না, নাগরিক-নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয় না। নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ও মৌলিক শর্ত। বিবদমান পক্ষের মধ্যে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মধ্যে আইনের শাসন সীমিত নয়; আইনের শাসনের গূঢ় অর্থ ব্যাপক এবং সেই প্রেক্ষিতে প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার ওপর অর্পিত। ১৭. বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে শ্রদ্ধা, মমতা ও দৃঢ়তার সংমিশ্রণ দেখা যায়। জনসাধারণের কল্যাণ ছিল তার নীতি ও প্রশাসনের ভিত্তি। সমাজে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সম্মান দেখাতে তিনি কার্পণ্য করতেন না। তাদের প্রয়োজনে অর্থ সাহায্য করতেন। আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় কবি জসীমউদ্দীন এবং ড. কুদরাত-এ খোদার চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য করা হয়। অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে তাদের কাছে চেক পৌঁছে দেয়া অথবা হস্তান্তর করা হতো। অর্থ সাহায্য ছিল শ্রদ্ধাঞ্জলি। ॥ তিন ॥ ১৮. প্রধানমন্ত্রীর কাছে সকল মন্ত্রণালয় হতে অনেক নথি (ফাইল) আসত। যে সকল ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ছিল মূলত আনুষ্ঠানিকতা, সেগুলো তার কাছে উপস্থাপন করে সংক্ষেপে বিষয়বস্তু মৌখিক জানানো হতো। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত জানালে নথিতে তা টাইপ করে স্বাক্ষর নেয়া হতো। বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত জানাতেন। তার ব্যক্তিগত কর্মচারীগণ সে সিদ্ধান্ত পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করত। সিদ্ধান্তের খসড়া অনুমোদন নেয়া বা লিপিবদ্ধ সিদ্ধান্ত সংশোধনের ঘটনা মনে আসে না। ১৯. যে সকল নথিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা জটিলতা থাকতো, তার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে মৌখিক জানানো হতো এবং প্রাসঙ্গিক অংশ পড়ার জন্য তাকে অনুরোধ করা হতো অথবা পড়ে শোনানো হতো। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তির দুটি পথ ছিল। এক. বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করতেন এবং তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতেন। দুই. তার নির্দেশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জানানো হতো যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি তার সঙ্গে আলাপ করতে চান। সময় নির্ধারণ করে মাননীয় মন্ত্রীকে আসবার জন্য অনুরোধ করা হতো। প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর মধ্যে আলাপের সময় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে তার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন অথবা তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পর কর্মকর্তাকে ডেকে সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দিতেন। কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর নিতেন। ২০. মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের মতামত দেবার সুযোগ ছিল না, নথিতে তারা আলাদা নোট দিতেন না। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং রাষ্ট্রপতির শাসন প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং রাষ্ট্রপতির অফিসের কর্মকর্তাগণ মন্ত্রণালয়ের ওপর খবরদারি প্রতিষ্ঠা করেন, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব বা সুপারিশের ওপর মতামত দেয়া শুরু করেন। এই পদ্ধতি ওয়েস্টমিনিস্টার সরকার কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রীগণ একক ও সমষ্টিগতভাবে দায়বদ্ধ। বিভাগীয় কর্মকর্তাগণকেও সংসদ তলব করে। দায়বদ্ধতার বাইরে কারও থাকা উচিত নয়। উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়বদ্ধতা বৃত্তে আনা যুক্তিসঙ্গত। ২১. বঙ্গবন্ধু অপ্রিয় বা কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ হতে বিরত হতেন না। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর তার সঙ্গে দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছেন এবং সচিব বা উচ্চপদে নিযুক্ত কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে তিনি বদলি করেছেন। কোন কর্মকর্তার আচরণে অনিয়ম সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হলে তাদের প্রশ্রয় দিতেন না। ২২. মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের আচরণের ওপর তার নজর ছিল। মন্ত্রীগণ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের সহচর। তাদের কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হলে বঙ্গবন্ধু ব্যথিত হতেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ কেন নেয়া হচ্ছে ব্যাখ্যা করতেন। জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ব্যক্তিগত আচরণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ হতে বাদ পড়েন। স্বাধীনতার আগে জনাব চৌধুরী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সংসদে সদস্য ছিলেন। তার গুণগ্রাহী ছিল অসংখ্য। ২৩. পাঁচশত টাকার নোট বাতিল ছিল জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। অনেক জাল নোট বাজারে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট করা টাকা অনেকের কাছে ছিল। সুষ্ঠু অর্থনীতি পরিচালনার জন্য এ সব নোট বাতিল ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় এবং সপ্তাহ শেষে আচমকা ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারও এ সম্পর্কে জানতে পারেননি। ২৪. মন্ত্রিসভা হতে তাজউদ্দীন সাহেবের অপসারণ ছিল একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। পদত্যাগপত্রটি অতি সন্তর্পণে প্রস্তুত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পদত্যাগপত্র স্বাক্ষরের জন্য পাঠালে তিনি কিছু সময় নেন-আনুমানিক তিন ঘণ্টা। স্বাক্ষরিত পদত্যাগপত্র ফেরত পাবার পর বিষয়টি প্রকাশ পায়। দু-একজন শীর্ষ নেতা বা মন্ত্রী হয়ত আগে বিষয়টির আভাস পেয়েছিলেন। ২৫. তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগের পর তার ওপর বঙ্গবন্ধুর আস্থা এবং তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন অবনতি লক্ষ্য করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে আসবার জন্য অনুরোধ করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। দু’একবার আলোচনার কিছু সময় উপস্থিত থাকবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন সাহেবকে উপদেষ্টা হিসেবে রাখবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন- খুব সম্ভব তার পদত্যাগকে সম্মানজনক রূপ দেবার জন্য। তিনি উত্তর দেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে সব সময় কাছে পাবেন, এ জন্য তাকে কোন পদ দেয়া দরকার হবে না। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন যে, জনাব তাজউদ্দীনের পদত্যাগের পর তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে তার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক রাখবেন জানতে চান। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন যে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখবার ওপর কোন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বাধা-নিষেধ নেই। ॥ চার ॥ ২৬. পাকিস্তান আমলের ঋণের দায় নেবার প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইউজিন ব্লাক প্রধানমন্ত্রীকে জানান। বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক উত্তর : যে অন্যায় রোধ করবার জন্য বাঙালী জাতি যুদ্ধ করেছে এবং প্রাণ দিয়েছে, বিশ্বব্যাংক সেই অন্যায়কে চিরস্থায়ী করতে চাইছে; বাঙালী জাতি এই অন্যায়-অবিচার মেনে নেবে না। বঙ্গবন্ধু জাতিকে আত্মত্যাগের জন্য আবার আহ্বান করবেন, জাতি তার আহ্বানে সাড়া দেবে। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তার ফলে বিশ্বব্যাংক অবস্থান পরিবর্তন করে। ২৭. বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব বিবেচনার পর বঙ্গবন্ধু মত দেন যে, স্বাধীনতার আগের ঋণের যে অংশ বাংলাদেশ ভূখ-ে বিনিয়োগ হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ভৌত সম্পদ বাংলাদেশে বিদ্যমান তার অপরিশোধিত দায় বাংলাদেশ সরকার নিতে রাজি হতে পারে। বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্তই মেনে নেয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইউজিন ব্লাকের সাক্ষাতের চার/পাঁচ সপ্তাহ পরে ওয়াশিংটন এ বার্তা জানায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে আলোচনা করে অনেক দ্বিপাক্ষিক ঋণ অনুদানে রূপান্তরিত হয়, ঋণের বোঝা লাঘব হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তানুসারে পরে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ ছিল নতুন ফসল বাজারে উঠবার পর যেন টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। তখন বাজারে দাম কম থাকে। মূল্যস্ফীতির যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা হয়নি, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ছিল নমনীয়। ২৮. এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথাপি বাধার সৃষ্টি করে। ইউএস এইডের সঙ্গে খাদ্য সহায়তা সম্পর্কে আলোচনার শেষ পর্যায়ে তারা চুক্তি সম্পাদনে অস্বীকৃতি জানায়। কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ছিল অজুহাত। কিউবাতে পাট রফতানির জন্য একটি চুক্তি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কিউবার (অথবা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের) সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলে খাদ্য সাহায্য দেয়া নিষিদ্ধ ছিল। কংগ্রেসের কাছে এই শর্ত শিথিলের সুপারিশের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের ছিল; বাংলাদেশের পক্ষে তা ব্যবহার করা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর তাদের কূটনৈতিক রূঢ়তা হ্রাস পায়। ॥ পাঁচ ॥ ২৯. বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহযোগী কর্মকর্তা বা পারসোনাল স্টাফের সংখ্যা ছিল সীমিত। একজন মুখ্য সচিব, সচিব, গণসংযোগ কর্মকর্তা, দু’জন একান্ত সচিব, তথ্য কর্মকর্তা এবং তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী। জনাব তোয়াব খান গণসংযোগ কর্মকর্তা পদে এবং প্রয়াত মোঃ হানিফ সহকারী একান্ত সচিব পদে নিয়োগ পান। জনাব তোয়াব খান এবং জনাব হানিফ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব দ্বিতীয়বার পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথা ছিল না, তাই অফিসের ছোট কলেবর দায়িত্ব পালনে বাধা হয়নি। কোন নথি চার/পাঁচ দিনের বেশি আটকে থাকত না। অফিসে আমাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার ছিল ¯েœহ, মমতাপূর্ণ, ব্যক্তিগত অবস্থা সম্পর্কে সব সময় খোঁজখবর নিতেন। অফিসের সময় অনাবশ্যক এবং স্থ’ূল আলাপে কালক্ষেপণ তিনি পরিহার করতেন। ৩০. মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস ছিলেন সিএসপি ক্যাডারভুক্ত; আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি এবং সরকারী চাকরিতে আর ফিরে যাননি। তার কাজের ধরন ছিল আমলাদের সাধারণ পদ্ধতি হতে আলাদা। সরকার পরিচালনার কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা দিলে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতেন। বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনবোধে তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করতেন। মন্ত্রণালয় হতে যে সকল নথি আসত মুখ্য সচিব তার সঙ্গে দৈনন্দিন ভিত্তিতে সম্পৃক্ত হতেন না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পৃক্ত থাকলে, নথি এলে তাকে জানাতে বলতেন। নথির বিষয়বস্তু সম্পর্কে মুখ্য সচিব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতেন। ৩১. বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর রফিক উল্লাহ চৌধুরী সচিব পদে নিযুক্ত হন। জনাব চৌধুরী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এবং সিএসপি ক্যাডারের কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল সচিবের ওপর। তিনি ছিলেন প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (প্রিন্সিপাল এ্যাকাউন্টিং অফিসার)। প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন দু’একটি অর্থ তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। যথা: প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সহায়তা তহবিল। মাস শেষে সচিব জনাব রফিক উল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘লেজারে’ হিসাব দিতেন। জনাব চৌধুরী সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেজার উপস্থাপন করতেন না। আমার কাছে লেজার হস্তান্তর করতেন এবং হিসাবের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। আমার প্রতি নির্দেশ ছিল বঙ্গবন্ধুকে সেগুলো জানানো এবং লেজার বই প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা। ৩২.আমার কৌতূহল ছিলÑজনাব চৌধুরী কেন সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে হিসাব দাখিল করেন না, আমার মাধ্যমে দেন। তিনি আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করেন। তার উপস্থিতিতে হিসাব পরীক্ষায় যাতে বঙ্গবন্ধু প্রভাবিত না হন, সেজন্য তিনি নিজে উপস্থিত থাকতেন না। কোন কর্মকর্তার স্বার্থ সম্পৃক্ত থাকলে অথবা তার নিজের সম্পর্কে আলোচনা বিষয়বস্তু হলে, কর্মকর্তা সেই প্রক্রিয়া হতে নিজেকে সরিয়ে রাখার একটি নীতি প্রচলিত ছিল। জনাব চৌধুরী কঠোরভাবে এই নীতি মেনেছেন। নীতিটি হয়ত এখনও বলবৎ, আচরণে প্রতিফলিত নয়। স্বার্থান্বেষী ক্ষমতা ব্যবহার সরকারী কর্মকর্তাকে ও সরকারকে জনসেবা হতে দূরে সরিয়ে নেয়, সরকারকে দুর্বল করে। গুনার মিরডাল লিখেছেন যে, গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতি আনুগত্য দুর্নীতির একটি প্রধান কারণ। ৩৩. বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার অনেক পরে তথ্য সচিব, অর্থনীতি বিষয়ক সচিব এবং সামরিক সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়। তথ্য সচিব পদে জনাব জহুরুল হক নিযুক্ত হন। জনাব হক পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে দায়িত্ব পালন হতে বিরত রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে পারি, জহুরুল হক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজীতে এমএ পাস করেন, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা লিখতেন। তার লেখা বক্তৃতা ছিল ব্যতিক্রম: শহীদ সাহেবের লেখায় কলমের দাগ পড়তো না, অন্যদের লেখা দাগে ভরে যেত। ৩৪. ড. সাত্তার পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্ব পান। তিনি সিএসপি অফিসার, ১৯৭১ সালের আগে টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তানে পরিকল্পনা কমিশনে দায়িত্বরত ছিলেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগটি তখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অংশ। কমিশনের কর্মকর্তা এবং সদস্যদের সঙ্গে মতপার্থক্যের জন্য তাকে সরাতে হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। ড. সাত্তার শুধু অর্থ মন্ত্রণালয় বা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না; বঙ্গবন্ধু তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব দিতেন। ৩৫. কর্নেল জামিল ফিরে আসার পর সামরিক সচিবের পদে নিযুক্ত হন (পরে ব্রিগেডিয়ার/মেজর জেনারেল)। ১৫ আগস্ট আততায়ীর আক্রমণ হতে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এসে প্রাণ দেন। জামিল ভাইয়ের কাছে শুনেছি যে, তিনি ১৯৭১ সালের আগে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহিত রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। রাশিয়া হতে চিকিৎসার পর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে আমাদের কাজে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়: দেড়টা-দুটোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দুপুরের খাবার শেষ করে বিশ্রামের জন্য বিরতি নিশ্চিত করা। জামিল ভাই এবং আমি যতেœর সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেছি। ৩৬. একান্ত সচিবদের একটি বড় দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রীর সময়ের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা। একান্ত সচিব পদে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেন নুরুল ইসলাম (অনু ভাই), মাহে আলম, মসিউর রহমান, ফরাস উদ্দিন। নুরুল ইসলাম ওয়াশিংটনে ইকোনমিক কাউন্সিলর পদে (পরে পদোন্নতি প্রাপ্ত) বদলি হলে আমি দীর্ঘদিন একা একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছি। ফরাস উদ্দিন একান্ত সচিব পদে যোগ দিলে বিকেল/সন্ধ্যার দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। অফিসের সময় এবং বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম শেষ না করা পর্যন্ত আমি দায়িত্ব পালন করতাম। ডেপুটি সেক্রেটারি (ফাইল) পদে নিযুক্ত সৈয়দ আব্দুস সামাদ নথির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন। আমার কাছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নথি আসত (যথা: পরিকল্পনা কমিশন / মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়)। (সকল একান্ত সচিব এবং উপসচিব [ফাইল] সিএসপি অফিসার ছিলেন; নুরুল ইসলাম বাদে সকলে বঙ্গবন্ধুর অনুমতিক্রমে যুক্তরাষ্ট্র হতে পিএইচডি করেছে।) ৩৭. বঙ্গবন্ধু সরকার পরিচালনায় স্পষ্ট দায়িত্ব বিভাজন ও প্রমিত পদ্ধতি স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দিতেন। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। মুক্তিযুদ্ধে যে সকল পরিবারের প্রধান প্রাণ দিয়েছেন তাদের সহায়তা ভাতা দেবার ব্যবস্থা করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম এর দায়িত্বে ছিলেন। জনাব ইমাম একটি তথ্য ভা-ার গড়ে তোলেন। ছোট কার্ডে পরিবারের পরিচয়, তাদের সহায়তার নির্ধারিত পরিমাণ, কত দেয়া হয়েছে ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ ছিল। ফলে প্রত্যেক সাহায্যের আবেদন বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থাপন করতে হতো না। তখন কম্পিউটারের প্রচলন হয়নি। প্রমিত করার ফলে ডেলিগেশন সম্ভব হয়, প্রশাসন ও সরকার পরিচালনার উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন এবং সার্বিকভাবে প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ে। ॥ ছয় ॥ ৩৮. সময়ানুবর্তিতার এবং সময়ের দক্ষ ব্যবহারের প্রতি বঙ্গবন্ধু বিশেষ মনোযোগ দিতেন। অফিস শুরু হবার নির্ধারিত সময়ের আনুমানিক কুড়ি/পঁচিশ মিনিট আগে তিনি অফিসে পৌঁছে যেতেন। দুপুরের খাবার ও বিশ্রামের জন্য বিরতি নিতেন। অফিসের সময় অনির্ধারিত সামাজিক দেখাশোনার ঘটনা ছিল বিরল। বিশ্রামের পর বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনের মাঠে বেশকিছু সময় পাঁয়চারি করতেন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং সাক্ষাত প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করতেন। বঙ্গবন্ধু ঘুমাবার সময় নিয়মানুবর্তী ছিল। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সহজ শরীরচর্চা তার অশান্ত রাজনীতি এবং দীর্ঘ কারাবাসের অভ্যাস, যা সুস্থ থাকার জন্য ছিল অপরিহার্য। ৩৯. রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনা এবং প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য আছে। সরকারের অংশ হিসেবে ‘ব্যুরোক্র্যাসি’ যে কাজ করে, তাকে প্রশাসন বলা যায়। তারা বিধিনিষেধ অনুসরণ করেন, রাজনৈতিক অথবা অন্য কোন ক্ষমতাবলে নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেন। সরকার অথবা রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ অনেক ব্যাপক। লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনের মূল নীতি-কৌশল নির্বাচন, বিধিনিষেধ তৈরি, রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাÑ এসব রাষ্ট্র পরিচালনার অংশ। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ‘সার্বভৌমত্ব’ প্রতিষ্ঠা করে। ৪০. ম্যাক্স বেবর ব্যুরোক্র্যাসি ও রাজনীতিবিদদের বৈশিষ্ট্য এবং রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধতা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ব্যুরোক্র্যাসি নিয়মনীতি মেনে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। রাজনীতিবিদগণ স্থির লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকেন; লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন কোন উত্তেজনা তাদের পথভ্রষ্ট করে না। রাষ্ট্র ক্ষমতার বৈধতার তিনটি দিক চিহ্নিত হয়েছে: ঐতিহ্য বা ধারাবাহিকতা, মুক্তবুদ্ধি-যুক্তিবাদ (ৎধঃরড়হধষ-ষড়মরপধষ) এবং সম্মোহনী নেতৃত্ব। ম্যাক্স বেবরের মুক্তবুদ্ধি-যুক্তিবাদ ধারণায় এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের চিন্তা এবং পুঁজিবাদের উন্মেষকালে অর্থনীতি পরিচালনার নীতি প্রতিফলিত। নেতৃত্বের সম্মোহনী ক্ষমতা বা কারিশমা রাষ্ট্র গঠনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর মুক্তবুদ্ধি-যুক্তিবাদী রাষ্ট্র ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠার ডাক আসে। বঙ্গবন্ধুর সরকার পরিচালনা বিচারের জন্য এই তিনটি দিকই প্রাসঙ্গিক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশদ্রোহীগণ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে; নতুন চেতনায় রাষ্ট্র গঠন থেমে যায়। ৪১. বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সঙ্কটকালে এবং বিশ্ব বৈরী অবস্থায় দেশ পরিচালনার ভার নেন। তাকে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সাফল্য এনে দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা সফল তারা স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সফল রাষ্ট্রনায়ক।
×