ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুদের পাশাপাশি ১২ থেকে সর্বোচ্চ ৩২ ধরনের সার্ভিস চার্জ গুনতে হচ্ছে গ্রাহকদের

ক্রেডিট কার্ডে সুদের লাগাম টানবে কে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৭ আগস্ট ২০১৭

ক্রেডিট কার্ডে সুদের লাগাম টানবে কে?

রহিম শেখ ॥ আধুনিক শহুরে জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ক্রেডিট কার্ড। ‘ইলেক্ট্রনিক মানি’খ্যাত এ কার্ডে বাকিতে কেনাকাটা বা প্রয়োজনে অল্প পরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংক থেকে ধার নেয়া যায়। কিন্তু সুবিধার তুলনায় চড়া সুদ দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। সামগ্রিক ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এলেও ক্রেডিট কার্ডে ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের খরচ কমানোর বদলে আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ মাস ব্যাংকগুলো আগের মতোই ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের ওপর যেমন খুশি তেমন সুদের হার আরোপ করতে পারবে। এছাড়া ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে গ্রাহকের ওপর সার্ভিস চার্জের খড়গ তো আছেই। ক্রেডিট কার্ড নিতে চাইলে কমপক্ষে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ৩২ ধরনের সার্ভিস চার্জ গুনতে হবে গ্রাহকদের। জানা গেছে, সাধারণ মানুষ ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পণ্য কেনেন কিন্তু ব্যাংকের কাছে ক্রেডিট কার্ডই একটি পণ্য। ব্যাংক এ পণ্যের বিপরীতে বিভিন্ন অঙ্কের বার্ষিক সেবা মাসুল (চার্জ) আদায় করে। প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রাহককে ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া পরিশোধ করতে হয়। বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হলেই আসে সুদের প্রশ্ন। অন্যান্য ঋণের সুদের হার বার্ষিক হারে আরোপিত হলেও ক্রেডিট কার্ডে সুদ দিতে হয় মাসিক ভিত্তিতে। ব্যাংকভেদে ২.৫০ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। সে হিসাবে ক্রেডিট কার্ডে বার্ষিক সুদহার দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশে। এর মধ্যে বেসরকারী সিটি, ব্র্যাক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং বিদেশী খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সুদহার আদায় করছে গ্রাহকের কাছ থেকে। ক্রেটিড কার্ডের মাত্রাতিরিক্ত এ সুদহারের লাগাম টানতে মাত্র দুই মাস আগে এ সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ক্রেডিট কার্ডে সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি ঠিক করে দেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো ওই নীতিমালার বিরোধিতা করে চাপ দিয়ে আসছিল। অবশেষে ব্যাংকগুলোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে প্রস্তাবিত পদ্ধতিতেই ক্রেডিট কার্ডে সুদহার নির্ধারণের সুযোগ করে দিয়ে গত বৃহস্পতিবার সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো তাদের অন্য যে কোন ঋণের সর্বোচ্চ সুদের সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডে পাঁচ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত কোন নীতিমালার আওতায় আসবে না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তারা আগে গ্রাহকদের কাছ থেকে যেভাবে সুদ নিত এখনও সেভাবেই নেবে। তিনি বলেন, ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এবিবি) নেতারা ক্রেডিট কার্ড নীতিমালা এখনই বাস্তবায়ন না করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের ওই প্রস্তাবগুলো বাস্তবসম্মতই ছিল। এ কারণে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন নীতিমালা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারী একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার সারা দুনিয়ায়ই বেশি। কেননা এ ঋণগুলোতে কোন ধরনের জামানত থাকে না। ফলে খেলাপী ঋণ আদায় করা কঠিন হয়। ইংল্যান্ড-আমেরিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ক্রেডিট কার্ডের সুদ অন্যান্য ঋণের সুদহারের দুই-তিনগুণ বেশি। আমাদের দেশেও এ ঋণের সুদহার কমবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে দেশের ভেতরে ও বাইরে মোট তিন হাজার ৯৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর জন্য গ্রাহকদের দেশ-বিদেশের অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) বুথ, পয়েন্ট অব সেল (পস) মেশিন ও ই-বাণিজ্যের সাইটগুলোর মাধ্যমে ৩১ লাখ ৩৪ হাজার ২০২টি লেনদেন (ট্রানজেকশন) করতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে পস মেশিনে ২৩ লাখ ৪৪ হাজার। এটিএম বুথে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৫৪০টি এবং ই-বাণিজ্যে এক লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৫টি লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাই মাসে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে বার্ষিক ১৪ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে। বেশিরভাগ ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের সুদ ৩০ শতাংশের উপরে। বর্তমানে সবচেয়ে কম ১৪ শতাংশ সুদ নিচ্ছে সোনালী ব্যাংক। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক (ডিবিবিএল) সুদ নিচ্ছে ১৮ শতাংশ করে। পাঁচটি ব্যাংকের সুদ নির্ধারিত ২৪ শতাংশ। ব্যাংকগুলো হচ্ছে জনতা, ঢাকা, আইএফআইসি, প্রিমিয়ার ও এসআইবিএল। যমুনা ব্যাংক ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। এবি ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ২০ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের সুদ ২৭ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংকের ৩৩ থেকে ৩৬ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংকের ২৮ শতাংশ এবং ওয়ান ব্যাংকের ২৮.৫০ শতাংশ থেকে ৩১.৫০ শতাংশ। ১২টি ব্যাংক সুদ নিচ্ছে ৩০ শতাংশ করে। ব্যাংকগুলো হলো- ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন (ইবিএল), এক্সিম, মিডল্যান্ড, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, এনসিসি, প্রাইম, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট ও ইউসিবিএল। দি সিটি ব্যাংকের সুদহার ৩৪.৫০ শতাংশ। এর বাইরে ৩০ শতাংশ সুদ নিচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান নিচ্ছে ১৯.২৫ শতাংশ সুদ। কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের সুদহার ২১ থেকে ২৪ শতাংশ। এ সুদের হার বাদ দিলে ক্রেডিট কার্ড নিতে চাইলে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ৩২ ধরনের সার্ভিস চার্জ গুনতে হবে গ্রাহকদের, যার মধ্যে সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা দিতে হবে কার্ডের বার্ষিক চার্জ হিসাবে। সাপ্লিমেন্টারি কার্ডের ক্ষেত্রে গুনতে হবে এক হাজার টাকা। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্কাই লাউঞ্জ ভিজিট ফি, অভ্যন্তরীণ স্কাই লাউঞ্জ ভিজিট ফি, গ্লোবাল লাউঞ্জ এ্যাকসেস ফি, কার্ড রিপ্লেসমেন্ট ফি, পিন রিপ্লেসমেন্ট ফি, লেট পেমেন্ট ফি, ক্যাশ উইথড্রয়াল/এ্যাডভান্স ফি (নিজস্ব এটিএম এবং অন্য এটিএম বুথে), রিটার্ন চেক ফি, ডুপ্লিকেট ই-স্টেটমেন্ট ফি, ওভারলিমিট ফি, সেলস ভাউচার রিট্রিয়াল ফি, সার্টিফিকেট ফি, রিস্ক এ্যাসুরেন্স ফি, কার্ড চেক বই ফি, কার্ড চেক প্রসেসিং ফি, ক্রেডিট ভেরিফিকেশন/সিআইবি ফি, ট্রানজেকশন এ্যালার্ট ফি, ইএমআই আর্লি সেটেলমেন্ট ফি, প্রি-পেইড কার্ড ইনিশিয়াল লোড ফি, প্রি-পেইড কার্ড রিলোড ফি, প্রি-ক্লোজার/রিফান্ড ফি, এটিএম রিসিপ্ট ফি নির্ধারণ করা আছে ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে।
×