ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

মৎস্য রফতানিতে সম্ভাবনার হাতছানি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ আগস্ট ২০১৭

মৎস্য রফতানিতে সম্ভাবনার হাতছানি

বাংলাদেশে রফতানি আয়ে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ক্রমে স্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছে। প্রতি বছর বাড়ছে রফতানি আয়। হিমায়িত চিংড়ি ছাড়াও রফতানি হচ্ছে জীবিত মাছ, শুঁটকি, লবণাক্ত ও পানিশূন্য মাছ, কাঁকড়া এবং হাঙরের পাখনাসহ মৎস্যজাত নানান পণ্য। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে বাংলাদেশের মাছের বাজার গড়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ছাড়াও এ খাতে বাড়ছে বাণিজ্য এবং কর্মসংস্থান। সরকারী উদ্যোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির এ খাতটি আরও ব্যাপক সম্ভাবনাময় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠবে, যার আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ খাতটি দিচ্ছে অনন্ত সম্ভাবনার হাতছানি। বাংলাদেশে মৎস্য খাতের অবদান নিঃসন্দেহে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আমিষ ঘাটতির ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬ এর তথ্যানুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ আসে মৎস্যখাত থেকে। আর কৃষিজ আয়ের ২৩ দশমিক ৮১ ভাগ দখল করে আছে মৎস্যখাত। সরকারের মৎস্যবান্ধব বিভিন্ন কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নে প্রতি বছর বাড়ছে মাছের উৎপাদন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ০১ লাখ মেট্রিকটন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেখানে মাছের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৮৪ লাখ মেট্রিকটন। আর পরবর্তী অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন আরও বেড়ে ৩৮ দশমিক ৫৫ লাখ মেট্রিকটনে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। উৎপাদন প্রবৃদ্ধির এ ক্রমধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২০-২১ সালে দেশে মোট মাছের উৎপাদন বেড়ে ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ মেট্রিকটনে পৌঁছাবে। যা বর্ধিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের পরেও উদ্ধৃত্ত থাকবে। মাছের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে দেশে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানিও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যা এ খাতটিকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২৬ হাজার ৬০৭ মেট্রিকটন মাছ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। যার মাধ্যমে ৭০০ দশমিক ২৯ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। যা ছিল ওই বছর মোট রফতানি আয়ের ৭ দশমিক ৫৭ ভাগ। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই বছর রফতানি আয়ের ৬০৪ দশমিক ০৩ কোটি টাকা অর্জিত হয়েছে কেবলমাত্র হিমায়িত চিংড়ি থেকে। অন্যান্য হিমায়িত মাছ থেকে ৩৮ দশমিক ৩১ কোটি টাকা, শুঁটকি মাছ থেকে ১২ দশমিক ২৬ কোটি টাকা, লবণাক্ত ও পানিশূন্য মাছ থেকে ৯ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা, কাঁকড়া ও ইল থেকে ২১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা ও হাঙরের পাখনা এবং মাছের ফোটকা থেকে অর্জিত হয়েছে ১৪ দশমিক ২৫ কোটি টাকা। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৯২০ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ১৩০৬ দশমিক ৯৪ কোটি টাকার মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য। এভাবে প্রতি বছর মাছ রফতানি বেড়েছে। তবে ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি সবচেয়ে বেশি গতি লাভ করেছে। ওই বছরে মোট রফতানি হয়েছে ৭৫২৯৯ মেট্রিকটন। যার দ্বারা অর্জিত হয়েছে ৩৩৯৬ দশমিক ২৮ কোটি টাকা। ওই বছরেও মাছ ও মাছজাত পণ্য রফতানির শীর্ষে ছিল হিমায়িত চিংড়ি। ৪৯ হাজার ৯০৭ মেট্রিকটন চিংড়ি রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ২৮৬৩ দশমিক ৯২ কোটি টাকা। ওই বছর অন্যান্য হিমায়িত মাছ রফতানি হয়েছে ২৩৫ দশমিক ১৫ মেট্রিকটন। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৪৯৫ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৩২৪৩ দশমিক ৪১ কোটি টাকা মূল্যের ৭২৮৮৮ মেট্রিকটন মাছ ও মাছজাত পণ্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৩৪০৮ দশমিক ৫২ কোটি টাকা মূল্যের ৭৭৬৪৩ মেট্রিকটন মাছ। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪৬০৩ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা মূল্যের ৯৬৪৬৯ মেট্রিকটন মাছ রফতানি হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৪৭০৩ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা মূল্যের ৯২৪৭৯ মেট্রিকটন মাছ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট রফতানির পরিমাণ কিছুটা কমে ৪১৫৮ দশমিক ৯৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ওই বছরে ঘেরে মড়কের কারণে হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতে মন্দা দেখা দেয়। যার প্রভাবে রফতানি কম হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাছ ও মাছজাত পণ্য রফতানি মন্দা কাটিয়ে ওঠে। ওই বছর ৪৭৭৬ দশমিক ৯২ কোটি টাকা মূল্যের ৭৭৩২৮ মেট্রিকটন মাছ ও অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়। ওই বছরে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি বেড়ে ৪১১৮ দশমিক ৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৪৬৬০ দশমিক ৬০ কোটি টাকা মূল্যের ৮৩৫২৪ মেট্রিকটন মাছ ও অন্যান্য পণ্য। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, হিমায়িত চিংড়ির পাশাপাশি অন্যান্য মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানিও গত কয়েক বছরে যথেষ্ট বেড়েছে। যেমন ২০০৯-১০ অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ১০ দশমিক ৪১ কোটি টাকার। পরের অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ১১ কোটি টাকায়। ২০১১-১২ অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি আরও বেড়ে ৯৫ দশমিক ৭৭ কোটি এবং পরের অর্থবছরে ১৬৯ দশমিক ৪৯ কোটি টাকায় পৌঁছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৬৪ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা এবং পরের অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি হয় ১৯৯ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে মৎস্য ও মৎস্যজাত রফতানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয় সামুদ্রিক প্রাণী চিল্ডফিশ। হিমায়িত চিংড়ি ও কাঁকড়ার পাশাপাশি রফতানি বাড়ে জীবিত মাছ, শুঁটকি ও লবণাক্ত মাছসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্যের। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মৎস্য সেক্টরে অগ্রগতি ক্রমে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাড়ছে মাছের উৎপাদন। অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে বাড়ছে সক্ষমতা। মাছে-ভাতে বাঙালীর চিরায়ত সত্য বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। সেসঙ্গে বাড়ছে রফতানি। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। মৎস্যখাতের ঈর্ষণীয় এ সাফল্য এনে দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। যা দেশের অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ করবে।
×