ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে গ্রাম বাংলা

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৬ আগস্ট ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে গ্রাম বাংলা

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ আসেন পৈত্রিক জমিদারি তদারকি করতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসরে। কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের জোয়ার আর ঠাকুরবাড়ির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে কেটেছে কবির প্রথম তিরিশটা বছর। এখানে এসে নতুন করে পেলেন স্রোতস্বিনী প্রমত্ত পদ্মা যা তাঁর সৃজনপ্রতিভার নিকটতম অনুষঙ্গ। আরও পেলেন আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপমাধুর্য। সব থেকে বেশি করে পেলেন অসহায়, পিছিয়ে পড়া, মূর্খ, মূঢ়, হতদরিদ্র জনগণের নিবিড় সান্নিধ্য যা তাঁর শৈল্পিক দ্যোতনাকে বিচিত্র আঙ্গিকে রূপময় করে তোলে। সাধারণ মানুষের নৈকট্যে কবি হয়ে যান ভিন্ন জগতের এক পরিপূর্ণ মানুষ। যার সঙ্গে তাঁর ফেলে আসা জীবনের অনেকটাই অমিল। যে সৌন্দর্যম-িত গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম পরিবেশ বাংলা সাহিত্যকে দেয় এক অকৃত্রিম নতুন সম্পদ। ছোট গল্পের শুরু আর নিরন্তর গতি পাওয়া অনেক গল্পের সম্প্রসারিত ভান্ডার। পিছিয়ে পড়া মূর্খ, নিরক্ষর প্রজাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গ্রাম বাংলা নির্জন পরিবেশের মাধুর্য স্নাত স্নিগ্ধতা। আর এরইমধ্যে নিজেকে নিমগ্ন রাখেন, সমর্পণ করেন পাশাপাশি সৃজনশীলতায়ও নিবিষ্ট হন। ছিন্নপত্র তারই একটি বিশিষ্ট আয়োজন যা কবির শৈল্পিক চৈতন্যের এক অবিস্মরণীয় নিত্যজীবন প্রবাহ। প্রতিদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা সেটা নিয়তই প্রবাহিত প্রমত্ত পদ্মার অবারিত জলরাশিই হোক কিংবা মনোমুগ্ধকর গ্রাম বাংলার শ্যামল প্রকৃতির অবাধ প্রতিবেশই হোক। হয়ত বা নির্বিত্ত, অসহায় জ্ঞানগোষ্ঠীর নীরব যন্ত্রণাও হতে পারে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার নিখুঁত ছবিও সাবলীলভাবে ওঠে আসে ছিন্নপত্রের বিভিন্ন জায়গায়। নদী বিধৌত বাংলার প্রাকৃতিক সম্ভার যেভাবে ছিন্নপত্রের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় অঙ্কিত হয়ে আছে তাতে মনে হয় জীবনানন্দের রূপসী বাংলা বহু আগেই কবির নান্দনিক চেতনা এবং সৃষ্টি বৈচিত্র্যে ধরা দেয়। ‘ছিন্নপত্রে’ বিশদভাবে বর্ণিত আছে বাংলার মনোমুগ্ধকর রূপ বৈচিত্র্য, নদী ও নারীর অপার সম্মোহনী শক্তি তার সঙ্গে পল্লীবালার নির্জন পরিবেশের বিস্ময়কর অনুভবে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ভরিয়ে রাখা। নিম্নবিত্ত, ধর্ম আর বর্ণের বেড়াজালে আবদ্ধ বিপন্ন জনগোষ্ঠীর সংঘর্ষ, বিবাদ আর টানাপোড়েনেও কবি উদ্বিগ্ন, চিন্তিত এবং উৎকণ্ঠিত। গ্রাম সমাজের এই অভেদ্য বিভেদ প্রথাকে একেবারেই মানতে পারেননি। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এসব বিভাজনকে প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। এসব প্রথাসিদ্ধ অনিয়ম আর অবিচারের নির্মম যন্ত্রণাও ছিন্নপত্রের বিষয়বস্তুর অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রথমেই ভেঙ্গে দেন জমিদারের আসন অলংকৃত করার প্রচলিত নিয়ম। শিলাইদহের সেই পুণ্যাহ বা মিলনের আয়োজন বিশেষভাবে স্মরণীয়। জমিদারের রাজসিক অভিষেক। মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম বাংলার এই অঞ্চলের অধিকাংশই গরিব মুসলমান প্রজা, নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের সংখ্যাও কম নয়। আর উপরের স্তরে বসা নায়েব আমলারা তো আছেনই। জাতি, ধর্ম আর বর্ণকে মাথায় রেখে সেভাবেই আসন নির্দিষ্ট থাকে। আর জমিদার বসেন সর্বোচ্চ আসনে। প্রজামিলনের এই দিনেই কবি এই ঐতিহ্যকে ধারার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকেন। সমস্ত ভেদাভেদ ঘুচিয়ে চাদর পাতা মেঝেতে একেবারে প্রজাদের মাঝখানে গিয়ে বসলেন। নিজেদের মধ্যে অভূতপূর্ব এক জমিদারকে পেয়ে প্রজারা মুগ্ধ, বিস্মিত, হতবিহ্বল। যে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গরিব, নগণ্য প্রজারা প্রথমদিনে তাঁকে দেখে সে ঘোর তাদের শেষদিন অবধি কাটেনি। শিলাইদহে জমিদারি দেখতে যেদিন প্রথম কাছারিতে বসেন, দেখলেন জাজিমের এক পাশ উল্টানো। প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, এ ব্যবস্থা মুসলমান প্রজাদের জন্য। এই দৃষ্টিকটু ব্যবধান তিনি উঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের আদর্শিক বোধের দৃঢ় চেতনা। জমিদার হওয়ার বিড়ম্বনায়ও তাকে পড়তে হতো। সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষের মতো তাঁর জীবনযাত্রা অতখানি অবাধ আর মুক্ত ছিল না। সৃজনশীল মানুষ, আবেগাপ্লুত হয়ে নিজের পছন্দমতো চারদিকে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করত। কিন্তু জমিদারের তকমা গায়ে লাগানো থাকত। সেটা ভেদ করা অত্যন্ত কঠিন একটা ব্যাপার ছিল। এর চমৎকার বর্ণনা আছে ছিন্নপত্রে। ‘আমার মনে মনে হাসি পায়Ñ আমার নিজের অপার গাম্ভীর্য এবং অতলস্পর্শ বুদ্ধিমানের চেহারা কল্পনা করে সবটা একটা প্রহসন বলে মনে হয়। প্রজারা যখন সম্ভবÑ কাতরভাবে দরবার করে, এবং আমলারা বিনীত করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার মনে হয় এদের চেয়ে এমনি আমি কি মস্ত লোক যে, আমি একটু ইঙ্গিত করলেই এদের জীবন রক্ষা এবং আমি একটু বিমুখ হলেই এদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আমি যে এই চৌকিটার ওপর বসে বসে ভান করছি যেন এই সমস্ত মানুষ থেকে আমি একটা স্বতন্ত্র সৃষ্টি, আমি এদের হর্তাকর্তা বিধাতা, এরচেয়ে অদ্ভুত আর কি হতে পারে। অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখ দুঃখ কাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোট ছোট বিষয়ে দরবার, কত সামান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না, কত লোকের প্রসন্নতার ওপরে জীবনের নির্ভর। আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না। জমিদারি এলাকায় বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করা, ছাত্রদের বক্তৃতা শোনা থেকে আরম্ভ করে জমিদারকে নিয়ে বিভিন্ন স্তুতিবাক্যও রবীন্দ্রনাথকে শুনে হজম করতে হয়েছে। অজ পাড়াগাঁ, ধর্মীয় গাম্ভীর্যের এক নিরস প্রতিবেশ। ফলে কট্টর মৌলভী থেকে শাস্ত্রিক ব্রাহ্মণপ-িতও কবির দর্শনার্থী হয়। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালের দেবতাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে কখন যে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ এমনকি কবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এসে অনর্গল কাব্যিক ছন্দের ঝরনাধারা প্রবাহিত হতো তা কবিকে যেভাবে দিশেহারা করে সে বর্ণনাও ছিন্নপত্রে অত্যন্ত কৌতুকের সঙ্গে ওঠে আসে। এটাই গ্রাম বাংলার ধর্মীয় বলয়ের এক অতি আবশ্যক চালচিত্র। কবির লেখায় স্পষ্ট হয় এখানে অর্থ সংগ্রহেরও একটি প্রচ্ছন্ন তাগিদ থাকে। এ ব্যাপারে ‘ছিন্নপত্র’ থেকে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যই উল্লেখ করা যাকÑ কী দিতে ইচ্ছে করেন এই কাগজে লিখে দিন, আমি নায়েব মশাইয়ের কাছে নিয়ে যাই এবং তাঁকেও শুনিয়ে আসি। আমি মনে মনে ভাবলুম, আমারও এ ব্যবসা, আমি কবিতা শুনিয়ে পয়সা পেয়ে থাকি। কিন্তু আমাকেও অনেক দ্বার থেকে রিক্তহস্তে ফিরে আসতে হয়Ñ ব্রাহ্মণকেও ফিরতে হলো।’ নদীর ওপর দিয়ে বজরা করে যাবার পথে গ্রাম বাংলার চারপাশের মনোহর দৃশ্য কবিকে যেভাবে বিমুগ্ধ করে তার একটি অভিনব বর্ণনা পাই ছিন্নপত্রের এক চিঠিতে। ‘এখন পাল তুলে যমুনার মধ্যে দিয়ে চলেছি। আমার বাঁ ধারে মাঠে গরু চড়ছে, দক্ষিণ ধারে একেবারে কূল দেখা যাচ্ছে না। নদীর তীব্র স্রোতে তীর থেকে ক্রমাগতই ঝুপ ঝুপ করে মাটি খসে পড়ছে। আশ্চর্য এই, এতবড় প্রকা- এই নদীটার মধ্যে আমাদের বোট ছাড়া আর দ্বিতীয় একটি নৌকা দেখা যাচ্ছে নাÑ চারদিকে জলরাশি ক্রমাগতই ছল্্ ছল্্ খল্্ খল্্ শব্দ করছে, আর বাতাসের হু হু শব্দ শোনা যাচ্ছে কাল সন্ধ্যার সময় একটা চরের উপর বোট লাগিয়েছিলুমÑ নদীটি ছোট্ট যমুনার একটি শাখা, একপারের বহুদূর পর্যন্ত সাদা বালি ধু ধু করছে, জনমানবের সম্পর্ক নেইÑ আর একপারে সবুজ শস্য ক্ষেত্র এবং বহুদূরে একটি গ্রাম। আর কতবার বলবÑ এই নদীর ওপরে, মাঠের ওপরে, গ্রামের ওপরে সন্ধ্যাটা কি চমৎকার, কি প্রকা-, কী প্রশান্ত, কী অগাধ সে কেবল স্তব্ধ হয়ে অনুভবকরা যায়, কিন্তু ব্যক্ত করতে গেলেই চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়। আমরা জানি এই গ্রাম বাংলার স্নিগ্ধ শ্যামল পরিবেশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিবিড় যোগসাজশে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব সৃজন ক্ষমতায় বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের নতুন ধারা তৈরি হয়। নিভৃত পল্লীর নির্জন পরিবেশের নির্মম শৃঙ্খলের চৌহদ্দীতে বসে লেখা ছোট গল্পগুলোর রসদ কবির একেবারেই হাতের কাছে ছিল। নিজেই বলেছেন অনেকটাই তাঁর দেখা বাকিটা কল্পনা মিশ্রিত ছোটগল্পের আঙিনা আর বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়। ছিন্নপত্রেও গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবন প্রবাহের বাস্তবসম্মত ছবি আমাদের মুগ্ধ করে। তেমনই একটি ঘটনা কবির দৃষ্টিতেÑ ‘আমাদের ঘাটে একটি নৌকা লেগে আছে এবং এখানকার অনেকগুলো ‘জনপদবধূ’ তার সম্মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। বোধ হয় একজন কে কোথায় যাচ্ছে এবং তাকে বিদেয় দিতে সবাই এসেছে। অনেকগুলো কচি ছেলে অনেকগুলো ঘোমটা, অনেকগুলো পাকাচুল একত্র হয়েছে। কিন্তু ওদের মধ্যে একটি মেয়ে আছে, তার প্রতিই আমার মনোযোগটা সর্বাপেক্ষা আকৃষ্ট হচ্ছে। বোধ হয় বয়স বারো-তেরো হবে, কিন্তু একটু হৃষ্টপুষ্ট হওয়াতে চৌদ্দ-পনেরো দেখাচ্ছে। এমন বুদ্ধিমান এবং সপ্রতিভ এবং পরিষ্কার সরল ভাব। একটা ছেলে কোলে করে এমন নিঃসঙ্কোচে কৌতূহলের সঙ্গে আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। মুখখানিতে কিছু যেন নির্বুদ্ধিতা কিংবা অসরলতা কিংবা অসম্পূর্ণতা নেই। বিশেষ করে আধা ছেলে আধা মেয়ের মতো হয়ে আরো একটু বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। ছেলেদের মতো আত্মসম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন ভাব এবং তার সঙ্গে মাধুরী মিশে ভারি নতুন রকমের একটা মেয়ে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে যে এ রকম ছাদের ‘জনপদবধূ’ দেখা যাবে এমন প্রত্যাশা করিনি।’ আমরা রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের মৃণ¥য়ীকে সেই আদলেই প্রত্যক্ষ করি। এভাবে তাঁর ছিন্নপত্র পূর্ণ হয়েছে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার সমারোহে এবং নিরীহ, নির্বিত্ত, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন প্রবাহের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা নিয়ে। যা বাংলার গদ্য সাহিত্যে এক অনুপম সৃষ্টি। মাধুরী স্নাত পল্লী বালার নির্মল সান্নিধ্য এবং বিত্তহীন মানুষের নিবিড় সাহচর্যে কবি নিজেকে যেভাবে সার্থক আর পূর্ণ করেছেন একইভাবে সাহিত্যের আঙিনাও সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। লেখক : সাংবাদিক
×